ডা. আবু হেনা – রাজশাহীর আইসিইউ’র পথিকৃৎ

আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) শব্দটার সাথে আমরা বেশ পরিচিত। এখানে অজস্র রোগী জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে জীবনের খেরোখাতায় চোখ বুলায়, অনেকে আবার পৃথিবীর আলো-বাতাসে আরো কয়েকদিন বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দোটানায় ভুগে, স্রষ্টার সকাশে মগ্ন থাকে প্রার্থনায়।

অন্যান্য অঞ্চলের মত দেশের উত্তরাঞ্চলেও আইসিইউর (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) প্রবল সংকট ছিল এবং আছে। ২০১১ সালের পূর্বে বিভাগীয় শহর রাজশাহীর প্রধান চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই কোন আইসিইউ ছিল না! ফলে রোগীদের আইসিইউ সেবার জন্য অন্য জায়গায় স্থানান্তর করতে হত। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের অভাবে অন্য জায়গায় স্থানান্তরের আগেই প্রাণ হারিয়েছে অগণিত মুমূর্ষু রোগী!

যখন এ মৃত্যুর মিছিল আরো দীর্ঘ হতে আরম্ভ করেছে তখনই রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের জন্য ত্রাতা হয়ে এলেন ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল; বর্তমানে তিনি এই হাসপাতালে (রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) আইসিইউর সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার পাশাপাশি মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে তিনি আইসিইউ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। প্রতিটি স্বপ্ন বাস্তবায়নের পিছনে থাকে অজস্র বাঁধা-বিপত্তি, আর পরাজয়। কিন্তু ডা. আবু হেনার মত স্বপ্নদ্রষ্ঠারা কখনোই দমে যান না।

তার একক প্রচেষ্টায় জনবল সংকটের পরেও হাসপাতালের পরিচালককে রাজি করিয়ে ২০১১ সালে চালু করেন ২ শয্যাবিশিষ্ট আইসিইউ। যেখানে কতৃপক্ষের সহায়তার তুলনায় ব্যক্তি উদ্যোগই ছিল মূখ্য। অজস্র বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে বাস্তবে রূপ পায় তার লালিত স্বপ্ন। তবে মাত্র ২শয্যার আইসিইউ বিভাগীয় শহরের জন্য পর্যাপ্ত নয়।

এর তিন বছর পর ২০১৪ সালে তিনি ২ শয্যার আইসিইউকে ১০ শয্যায় রূপান্তরিত করেন। কিন্তু এবারও একই বাঁধা – জনবল সংকট! কিন্তু মানুষটা যে ডা. আবু হেনা, যিনি দমে যাবার পাত্র নন। তিনি বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারীকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে আইসিইউতে কাজ করার উপযোগী করে তুলার চেষ্টা করলেন এবং সফল হলেন।

এরপর কেটে গেল ৬ বছর। সমগ্র বিশ্ব কোভিড নাম মহামারীতে আক্রান্ত। কোভিডে আক্রান্ত বেশিরভাগ মুমূর্ষু রোগীর জন্যই আইসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন! এবারও ত্রাণকর্তা ঐ একই চিকিৎসক! কর্তৃপক্ষকে রাজি করিয়ে চালু করলেন ১০ শয্যা বিশিষ্ট কোভিড আইসিইউ। স্বেচ্ছায় নিলেন এই আইসিইউ পরিচালনার দায়িত্ব। কোভিডের ভয়াবহতায় পরবর্তী বছরেই (২০২১ সাল) এ আইসিইউকে ২৫ শয্যায় রূপান্তর করা হয়।

২০২২ সালে তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চালু হয় ১১ শয্যার সরকারি-বেসরকারী পর্যায়ে দেশের প্রথম ও সর্ববৃহৎ জেরিয়াট্রিক আইসিইউ। একইসাথে চালু করা হয় ৪ শয্যার পেডিয়াট্রিক আইসিইউ।

২০২৩ সালে দেশে প্রথমবারের মত ‘আইসিইউ মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব’ চালু করেন। এ ল্যাব থাকায় আইসিইউর রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য বাইরে যাবার প্রয়োজন পড়ে না। সার্বক্ষণিক সব ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষার সুবিধা পাওয়া যায় এখানে।

২০২৪ সালে দেশে প্রথমবারের মতো তার হাত ধরেই যাত্রা আরম্ভ করেছে ‘এডাল্ট আইসিইউ’, ‘জেরিয়াট্রিক আইসিইউ’ ও ‘পেডিয়াট্রিক আইসিইউ’ – এর সমন্বয়ে গঠিত ৪০ শয্যার আইসিইউ কমপ্লেক্স।

এতটুকুতেই দমে যাবার পাত্র নন তিনি। এখনো বাকি আছে তার স্বপ্নের কিয়দাংশ। সরকারি কর্তা হিসেবে তিনি স্বপ্ন দেখেন তার আইসিইউ কমপ্লেক্সে ১২ শয্যার প্যালিয়াটিভ ইউনিট চালু হবে, আইসিইউ কমপ্লেক্স হবে ৬০ শয্যার। একই সাথে চালু হবে অবস্টেট্রিক্স আইসিইউ।

আমরা কেউ ভবিষ্যত জানি না। জানি না তার স্বপ্নের সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হবে কী-না! তবে একক প্রচেষ্টায় তিনি যা করে দেখিয়েছেন, তা দক্ষিণ এশিয়া নয় বরং সারা বিশ্বেই হয়ত বিরল।

প্রতিনিয়ত অজস্র মানুষকে আমরা অভিবাদন জানালেও সবসময়ই আড়ালে থেকে যায় আমাদের জন্য, দেশের জন্য, দশের জন্য লড়ে যাওয়া সত্যিকারের নায়কেরা। এমনই একজন ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, যিনি নিজের জন্য স্বপ্ন দেখেননি, দেখেছেন আমাদের জন্য। যিনি ২ শয্যার আইসিইউকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আইসিইউতে রূপদান করেছেন। তার জন্য প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে শুভকামনা এবং টুপি খোলা শ্রদ্ধা।

আপনার অন্য স্বপ্নগুলোও বাস্তবায়িত হোক, ঠিক স্বপ্নের মত করে।

প্ল্যাটফর্ম/

Moin Uddin Ahmad Sibli

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo