সংবাদপত্র ও খবরে এসেছে ,সিজার করে টুইন বেবির একটিকে বের করে আরেকটি শিশু পেটের মধ্যে রেখেই ডাক্তারের রোগীর পেট সেলাই ।
খবরের কাগজে এধরনের শিরোনাম আসলেই আঁতকে উঠার মতই । এতে বেড়েছে ডাক্তারের প্রতি ক্ষোভ এবং কমেছে বিশ্বাস । ফলশ্রুতিতে সেই কর্তব্যরত চিকিৎসক মানে , ডাঃ হোসনে আরা এখন হয়রানির শিকার ।
প্রথমেই বলি আমি ডাঃ হোসনে আরাকে চিনি না ,ডাক্তার বলে একজন ডাক্তারের পক্ষ হয়ে লিখছি তাও নয়। শুধু একজন মানুষ অন্যায়ের শিকার হচ্ছেন তাই কিছু না লিখে পারলাম না । তাই আপনি যদি ডাক্তার না হয়ে থাকেন এই বিষয়ে আপনার একটু জানা উচিত ।
মূল ঘটনা আসলে কি ?
ডাঃ আরা জানতেন দুইটা বাচ্চা কারণ আল্ট্রাসনোগ্রাফি তাই বলেছে কিন্তু তিনি সিজার করতে গিয়ে দেখেন মহিলার জরায়ুতে আসলে একটা বাচ্চা ।
তাহলে আরেকটি বাচ্চা গেলো কোথায় ?রিপোর্ট কি ভুল ছিল ?
ঘটনা হল ,মহিলার জরায়ুতে ছিল একটা বাচ্চা আর আরেকটি বাচ্চা ছিল জরায়ুর বাইরে পেটের ভিতর।
এমন কি হতে পারে ?
হতে পারে । বলা যায় এটি একটি বিরল ঘটনা । আমরা ডাক্তারি ভাষায় বলি হেটারোটপিক প্রেগনেন্সি ।
সিজার করার আগে বুঝার কোনো উপায় নেই । যিনি আল্ট্রাসনোগ্রাফি করেছেন তিনি হয়তো সে রকম দক্ষ নন অথবা যেহেতু এইটি খুবই বিরল ,তাই এরকম হতে পারে উনার এই ব্যপারে ধারনা হয় নাই ।
তাহলে উনি সিজার করার সময় জরায়ুর বাইরের বাচ্চাটি বের করলেন না কেন ?
কারণ তাতে মায়ের মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল । সিজার একটি অনেক বড় অপারেশন ,অনেক রক্তপাত হয় ,পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া দ্বিতীয় অপারেশনটি করলে মাকে বাঁচানো যেত না । আমরা এইটাকে বলি স্টেজড সার্জারি।
প্রথমে করা হয় সবচেয়ে জরুরীটা এরপর দ্বিতীয়টি । যেমন মনে করুন কারও একটি জটিল ব্রেন টিউমার হলো ,ডাক্তারগন প্রথম দিন হয়তো মাথার তালু খুলবেন একটু শুরু করবেন এরপর আবার তালু আগের জায়গায় রেখে দিয়ে অন্যদিন দ্বিতীয় ধাপে অপারেশন করবেন ,দীর্ঘক্ষণ কোনো রোগীকে অজ্ঞান করে রাখা মোটেই নিরাপদ নয় । ডাঃ আরা অনেক বুদ্ধিমত্তার সাথে রোগীটিকে পরিচালনা করেছেন । প্রথমে জরায়ুর বাচ্চাটা বের করেছেন এরপর দ্বিতীয়ধাপে অস্বাভাবিক অবস্থা সমাধান করার জন্য ঢাকা মেডিকেলে যেতে বলেছিলেন রোগীর পক্ষকে।
আমি যেহেতু বর্তমানে একজন অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি ,এই পরিস্থিতিতে যদি কোনো অস্ট্রেলিয়ান সার্জেন হতেন তাহলে তিনিও ঠিক একই কাজটি করতেন ।
আমাদের সবসময় উদ্দেশ্য থাকে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা । আরো একটা জিনিস এখানে জানা উচিত যে জরায়ুর বাইরে যেসব গর্ভ হয় সেসব সাধারণত অস্বাভাবিক বাচ্চা হয় এবং এরা বাঁচে না ।
সুতরাং এখানে লক্ষনিয় বিষয় হল, মায়ের জীবন আগে তারপর অন্য বিষয় ও পরবর্তী পদক্ষেপ ।
এতকিছু বুঝিয়ে বলার পরও পত্রিকার রিপোর্টার তাহলে এই আজগুবি গল্প কেন ছড়ালেন ?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আপনাকে একটা গল্প শুনতে হবে ।
আমার এক বন্ধু চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে একটা ক্লিনিকে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করতো । একদিন কিছু লোকজন একটা এগার বছরের ছেলেকে তার কাছে নিয়ে এসেছিলো একটা আল্ট্রাসনোগ্রাফী করে দেয়ার জন্য ।
কারণ জানতে চাওয়ায় ছেলের বাবা -মা বললো ,ছেলের পেট ফুলে গেছে তারা দেখতে চায় পেটে কোনো বাচ্চা আছে কিনা । আমার বন্ধুতো অবাক ,মেয়ে হলে তাও একটা কথা ছিল ,এগারো বছরের ছেলের পেটে বাচ্চা ? কিভাবে সম্ভব ?
এরপর লোকজন বললো,” স্যার মানুষের বাচ্চা না ,আপনি দেখেন কোনো কুত্তার বাচ্চা আছে কিনা ”
ঘটনা কি ?
আরো ভালভাবে সবকিছুর অবস্থা নিয়ে জানা গেলো ছেলেটাকে একমাস আগে একটা কুকুর কামড় দিয়েছিলো তার কিছুদিন পর ছেলের পেট ফুলে যায় । গ্রামের লোকজন আর কোয়াক ডাক্তার সন্দেহ করা শুরু করেছে যে ওর পেটে কুকুরের বাচ্চা জন্ম নিয়েছে। আমার বন্ধু যতই বুঝায় এটা অসম্ভব কিন্তু রোগীর লোকজন কিছুতেই মানতে নারাজ । সাথে এলাকার একজন মেম্বার সাহেবও আছেন ,তারা আলট্রাসনোগ্রাম করে ঘটনার সত্যতা প্রমান করতে চায় । শেষ পর্যন্ত ক্লিনিক ম্যানেজারের চাপে আমার ঐ বন্ধু আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে কন্ফার্ম করে যে পেটে আসলেই কোন কুকুরের বাচ্চা নেই। কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে পেট ফুলেছে ।
কুকুর কামড় দিলে পেটে কখনো বাচ্চা হয়না এবং আল্ট্রাসনোগ্রাফির কোন প্রয়োজন নেই এই জ্ঞান ও তথ্য পত্রিকায় না দিয়ে লোকাল পত্রিকা নিউজ করেছে “কুকুরের কামড়ে এগার বছর ছেলের পেটে বাচ্চা ”
যদিও খবরের শেষ লাইনে একটু করে লিখছে ,আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে কিছু পাওয়া যায়নি ।
এখন প্রশ্ন হলো এই আজগুবি খবর সাংবাদিক কেন রিপোর্ট করলেন ?
উত্তর হলো এই তথাকথিত সাংবাদিক সাহেবও হয়তো ভেবেছিলেন ,কুকুর কামড় দিলে মানুষের পেটে বাচ্চা হয় । সুতরাং আপনিই বুঝে দেখেন সংবাদদাতাকে এই রোগীর হেটারোটপিক প্রেগনেন্সি বুঝানো এত সহজ নয় ।
এখন আসল প্রসঙ্গ হল ডাঃ হোসনে আরাকে বাঁচাতে হবে । একজন মানুষ কি করে কতটা অমানবিক কষ্ট করে ডাক্তার হন সেটা ডাক্তারি না পড়লে জানা যায়না তার উপর তিনি যদি নারী ডাক্তার হয়ে থাকেন সেটা আরো কঠিন । ডাঃ আরা মনে কতটা কষ্ট পেয়েছেন ,তার পরিবার কতটা ভোগান্তিতে আছেন সেটা মিডিয়াতে আসা উচিত । যে সাংবাদিক এই সব আজগুবি খবর ছড়িয়েছেন তার নামে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে । মানুষের মনে ডাক্তারের সম্পর্কে এভাবে ক্ষোভ এবং হতাশা তৈরী করে সাংবাদিক কি দেশের অনেক বড় ক্ষতি করছেন না ?
শুধু ডাক্তারগন প্রতিবাদ করে এই সমস্যার সমাধান হবে না । দেশ জাতি একসাথে এগিয়ে আসতে হবে। এইসব মিথ্যা অবিচারের বিচার না হলে দেশের জন্য ভয়ানক পরিণতি অপেক্ষা করছে । রাষ্ট্রও তার দায় এড়াতে পারবে না ।
(নীচে একটা ছবি দেয়া হলো যেখানে দেখানো হয়েছে ,একজন মায়ের জরায়ুর বাইরে পেটের ভিতর আরেকটি শিশু )
ডাঃ শামসুল আলম, বিশেষজ্ঞ- ফ্যামিলি মেডিসিন, অস্ট্রেলিয়া।