সাবধান, ছোট্ট একটা ভুল ডেকে আনতে পারে মৃত্যু !!
ঘটনা – ১, আমার এক রোগীনিকে ইনসুলিন প্রেসক্রিপশন করে দেওয়ার পর পরবর্তী তে পর পর দুই ভিজিটেই দেখলাম যে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। ডোজ বাড়িয়েও লাভ হচ্ছে না। অবশেষে রোগীকে চেম্বারের বাইরে বসিয়ে রেখে রোগীর ছেলেকে বললাম বাড়ী থেকে ইনসুলিন আর সিরিঞ্জ নিয়ে আসতে। দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। ইনসুলিন আমার প্রেস্ক্রিপশন অনুযায়ী ঠিকই কিনেছে 40iu/ml, কিন্তু সিরিঞ্জ কিনেছে 100iu/ml, অর্থাৎ 100iu/ml সিরিঞ্জ দিয়ে 40iu/ml ইনসুলিন দিলে প্রতি 100 ইউনিটের বিপরিতে প্রকৃতপক্ষে ইনসুলিন দেয়া হবে 40 ইউনিট। অর্থাৎ আমি যে পরিমাণ প্রেসক্রাইব করলাম তার আড়াই ভাগের এক ভাগ। ডায়াবেটিসের কি দোষ কন্ট্রোল না হওরার পিছনে ?
আবার মনে করি যদি এভাবেই যদি 40iu/ml ইনসুলিন আর 100iu/ml সিরিঞ্জ দিয়ে ডোজ বাড়াতে বাড়াতে একসময় ডায়াবেটিস হয়তো নিয়ন্ত্রনে আসলো আর রোগী হঠাৎ একদিন সিরিঞ্জ 100iu/ml না কিনে 40iu/ ml কিনলো। তাহলে কি হবে ? রোগী হঠাৎ করেই যে পরিমাণ ইনসুলিন পাচ্ছিল তার আড়াই গুন বেশী ইনসুলিন পাবে। ভাবতে পারেন কেউ কি ভয়াবহ পরিস্থিতি (হাইপোগ্লাইসেমিয়া অর্থাৎ রক্তে শর্করা অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়া ) হবে তখন।
ঘটনা -২, আমার এক রোগী ডায়াবেটিস এর কারনে পায়ে পচন । বেশ কয়েকদিন হল ভর্তি। রোগীর এক আত্মীয়া নার্স হিসাবে পরিচয় দিলো। রোগীর সাথেই ক্লিনিকে থাকে। সে নিজেই রোগীকে ঔষধ খাওয়ানো আর ইনসুলিন ও অন্যান্য ইনজেকশন দেয়ার মতো কাজগুলো করে। রাত ১২.৩০ মিনিটে হঠাৎ করে ক্লিনিক থেকে ফোন আসলো স্যার রোগী খারাপ, কেমন যেন করছে। বললাম ব্লাড সুগার কর। একটু পরেই রিপ্লাই আসলো, স্যার 2mmol/litre. অর্থাৎ গুরুতর হাইপোগ্লাইসেমিয়া অর্থাৎ রক্তে শর্করা অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে । যে কোন সময় রোগী মারা যেতে পারে।
বললাম তাড়াতাড়ি শিরায় ২৫% গ্লুকোজ রানিং দাও আর পানিতে গ্লুকোজ গুলে খাওয়াও। যতটা দ্রুততার সাথে সম্ভব হাসপাতালে গেলাম। যেয়ে দেখি শিরায় 25% গ্লুকোজের অনেকটাই চলে গেছে। ব্লাড সুগার করে দেখলাম 12mmol/L. স্বস্তি পেলাম যাক এ যাত্রায় রোগীটি প্রাণে বাঁচলো। রোগীর সাথে থাকা রোগীর আত্মীয়া
নার্সকে বললাম রোগীর ব্যবহৃত ইনসুলিন আর সিরিঞ্জ নিয়ে আনতে, যা সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই। ইনসুলিন 100iu/ml সিরিঞ্জ 40iu/ml. অর্থাৎ প্রতি 40 ইউনিটের বদলে 100 ইউনিট। অর্থাৎ রোগীর ইনসুলিনের আদেশ ছিল 20+20+16 ইউনিট, অথচ রোগীকে দেয়া হচ্ছে তার আড়াই গুণ বেশী। অর্থাৎ রোগীকে দেয়া হচ্ছে 50+50+40 ইউনিট করে ইনসুলিন। রোগীর সাথের নার্সের কাছে জানতে চাইলাম আগাগোড়াই কি এই সিরিঞ্জ দিয়ে ইনসুলিন দিচ্ছেন ? বললো না। এই সিরিঞ্জটা আজকেই নুতন আনা। আগেরগুলো ভোঁতা ( ধার অর্থাৎ Sharpness কমে যাওয়া ) হয়ে গিয়েছিল। ব্যাথা লাগে তাই নুতন আনা। পুরাতন সিরিঞ্জটা দেখাতে বললাম। ঠিকই 100iu/ml. নার্স কে বললাম এই যে সিরিঞ্জ টা 100iu/ml এর বদলে 40iu/ml ব্যবহার করছো খেয়াল কর নাই কেন ? প্রথমত কোন উত্তর নাই।পরে ধমক দেয়ায় উত্তর দিল খেয়াল করি নাই।হাইপোগ্লাইসেমিয়ার আর দোষ কি? একটু বেখেয়ালির জন্যই রোগীটা মারা যেতে পারতো।
ঘটনা – ৩, আমার এই লেখাটি ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার কিছুদিন পরের কথা। কুষ্টিয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি ক্লিনিকে অপারেশন করতে গেছি। এমন সময় ক্লিনিকের মালিক স্বয়ং ওটিতে উপস্থিত হলেন। তিনি নিজেও একজন সুনামধন্য ব্যাস্ত চিকিৎসক। আমার এই লেখাটি নিয়ে তার সাথে আলাপের এক পর্যায়ে তিনি তার ক্লিনিকে ভর্তি একটি রোগীর বিষয়ে বললেন। ইনসুলিনের ডোজ বাড়িয়েও ডায়াবেটিস কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। বলেই তিনি ওটি থেকে বের হয়ে গেলেন আর ফিরে এলেন রুগীটির ইনসুলিন আর সিরিঞ্জ হাতে। বললেন আপনার কথাই মিলে গেলো। দেখেন ইনসুলিন 40 iu/ml আর সিরিঞ্জ 100 iu/ml. ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণ হবে কিভাবে ?? আমার এই লেখাটির দেয়া ছবিটি সেই রুগীটির ইনসুলিন আর সিরিঞ্জের।
আমাদের দেশে অনেক দরিদ্র অশিক্ষিত ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী আছে যাদের বাড়ীতে নিজে নিজে ইনসুলিন ইনজেকশন নেয়া লাগে।
আর শিক্ষিত হলেই যে তারা সকলেই সবসময় ইনসুলিন ঠিকঠাক মতো দিতে পারবেন তারও কিন্তু গ্যারান্টি নেই। কেননা এবিষয়ে তারা কিন্তু লে-ম্যান। আর কিছু কিছু বেখেয়ালি অথবা বেশী বোঝেন এমন মানুষের সংখ্যাও কিন্তু আমাদের সমাজে কম না।
জেলা শহর, উপজেলা,ইউনিয়ন পর্যায়েও এখন অনেক ক্লিনিক যেগুলোতে অধিকাংশ সময়েই পাস করা নার্সদের বদলে অর্ধশিক্ষিত মেয়েদের বা নারীদের দিয়ে নার্সিং এর মত গুরুত্ত্বপুর্ন কাজ করানো হয়। রাজধানীর সকল ক্লিনিকেই যে শুধুমাত্র কোয়ালিফাইড নার্সই কাজ করে একথাও জোর গলায় বলার উপায় নেই। আর নার্স কোয়ালিফাইড হলেই যে ভুল করবে না তারই বা গ্যারান্টি কি।
আমাদের দেশে ইনসুলিন বাজারজাত করে এমন অধিকাংশ কোম্পানিরই অনেক প্রকার ইনসুলিন আছে যেগুলো 100iu/ml এবং 40iu/ml উভয় রুপেই বাজারে পাওয়া যায়। সিরিঞ্জও 100iu/ml ও 40iu/ml এই দুই প্রকারেই পাওয়া যায়।
তবে পেনফিল হিসাবে যে সকল
ইনসুলিন পাওয়া যায় সেগুলোর কথা আলাদা। কেননা পেনফিল ইনসুলিন এর ক্ষেত্রে এধরনের ভুলভ্রান্তির সুযোগ কম।
দেশের আনাচে কানাচে এধরনের ভুল যে প্রায়শই হচ্ছে না তার কিন্তু কোন গ্যারান্টি নেই।
এই সকল ভুলের কারনে কারও কারও ডায়াবেটিস সময় মত নিয়ন্ত্রণ না হওয়ায় বিভিন্ন রকম জটিলতা হচ্ছে। আবার কারও কারও রক্তের শর্করা অতিমাত্রায় কমে যাওয়ায় মরতে মরতে বেঁচে যাচ্ছে বা হয়তো মরেই যাচ্ছে। অনেক সময় এমনও হয় সংশ্লিষ্ট কেউ হয়তো বুঝতেই পারলো না কি কারনে রোগীটি মারা গেল।
আপাতত পেনফিল ইনসুলিন পেনফিল এর জায়গায় না হয় থাক। কিন্তু সিরিঞ্জ দিয়ে যে ইনসুলিন ইনজেকশন দেয়া হয় সেগুলোকে অবশ্যই 100IU/ml আর 40iu/ml এর গোলক ধাঁধাঁ থেকে মুক্ত করে একই ধরনের ডোজ ফর্ম এর আওতায় আনা উচিৎ। তা না হলে এরকম অঘটন গুলো ঘটতেই থাকবে।
এতে করে হয়তো ইনসুলিন এর উৎপাদন বা ব্যবসা করে এধরনের প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিবর্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তবে রাষ্ট্র এবং জনগনের কল্যানের স্বার্থে ব্যবসায়ীদের কথা ভাবলে আমাদের চলবে না।
তবে আরও ভালো হয় পেনফিল, 100iu/ml ও 40iu/ml নির্বিশেষে এসকলের মধ্য থেকে বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে যে ডোজ ফর্ম আমাদের দেশের জন্য সবচাইতে সুবিধাজনক সেই একটি মাত্র ডোজ ফর্ম আমাদের দেশের জন্য নির্বাচন করা।
ব্যবসায়ীদের যা হয় হোক।
ডা সুরেশ তুলসান।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ।