ডেঙ্গুঃ ভয়াবহতা ও বাস্তবতা

জায়ান, বয়স বছর দশেক, কলেজিয়েট স্কুলে তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ে। অদ্ভুত এক লক্ষী বাচ্চা। এই সেদিন জায়ান, আমার ছেলে অহন ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছে আর দিবা, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছি।

দিবা, জায়ানের মা, জগন্নাথের এডমিনেস্ট্রেটিভ অফিসার। আমাকে আন্টি আন্টি ডাকে। খুব আন্তরিক। আমরা পারিবারিক ভাবে এটাচড্। ‘ আন্টি, বাচ্চাদের কেনো পরীক্ষা দিতে হয়? এতটুকু এতটুকু বাচ্চা! পরীক্ষার কী বোঝে?’ দিবার টেনশন ছিলো দেখার মতো। ‘ আন্টি জানেন, জায়ান এই একটা বছর খুব কষ্ট করেছে! সকালে পড়া, বিকালে পড়া !

আহা বাচ্চা আমার! ও কলেজিয়েটে চান্স পেলে বেঁচে যাই আমি। জগন্নাথ থেকে কাছে হবে। আমি দেখতে পারবো। দোয়া করবেন আন্টি।’ দোয়া কবুল হয়। দু তিনদিন পরে দিবা কল কল কন্ঠে ফোন দেয়, ‘আন্টি জায়ান চান্স পেয়েছে!’ সন্তানের সাফল্যে মায়ের খুশি বর্ণনা করার ভাষা এখনো আবিস্কৃত হয়নি। বৃথা সে চেষ্টা করলাম না।

‘দিবা এখন আরেকটা বেবি নাও। ছেলে তো বড় হয়ে গেছে, ভালো স্কুলেও চান্স পেয়ে গেছে, আর চিন্তা কী?’ ‘ আন্টি আমি জায়ানের ভাগ কাউকে দিতে পারব না।’ ফোনের ও প্রান্তে দিবার মুখটা না দেখতে পেলেও আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম দিবা জ্বল জ্বল করছে জায়ানের আলোয়। আর কোন আলো তার দরকার নেই। আচ্ছা এখন থাক, দিবার জায়ানের বাকী কথা লেখার শেষাংশে জানব।

ফয়সাল। বছর পঁচিশের ঝকঝকে তরুণ। নবীন ডাক্তার। সদ্য শের-ই- বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে বের হয়েছে। বুক ভরা স্বপ্ন একদিন বড় ডাক্তার হবে। স্বপ্নের সারথি নতুন বউ আরো অনেক নতুনের স্বপ্ন নিয়ে আসে। মাত্র দুমাস আগে বিয়ে করেছ। কুড়ি থেকে পুর্নাঙ্গ বৃক্ষ আর হয়ে ওঠে না ফয়সালের। সর্বনাশা ডেঙ্গু জীবন থেকে জীবন কেড়ে নেয়। আহা কত অপচয়! জীবনের অপচয়। মাত্র পঁচিশ বছর বয়স। পুরোটাই তো গেলো বইয়ে মুখ গুঁজে। যখন জীবনকে যাপন করবে, তখনি জীবন থেকে জীবন খোয়া যায়। তাও সামান্য এক মশার কাছে!

এডিস মশা! সর্বনাশা ডেঙ্গু!

আসুন তো দেখি ডেঙ্গু সম্বন্ধে কিছু জানা যায় কিনা। ডেঙ্গুজ্বর ভাইরাস বাহিত রোগ। স্ত্রী এডিস মশা এর বাহক। আক্রান্ত রোগীর জ্বর ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে। মাথা ব্যাথা, হাড় ব্যাথা, জয়েন্ট ব্যাথা, বমি ভাব, দুর্বলতা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে।

অনেক ধরনের ডেঙ্গু জ্বর হতে পারে। তারমধ্যে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার এবং ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম ভয়াবহ! মারাত্মক জীবন নাশক! ডেঙ্গু হলে রক্তনালি কোলাপ্স করে। প্রেসার ফল করে, শক ডেভেলপ করে। আমরা জানি, শক এবং মৃত্যু হাতে হাত রেখে চলে। এদিকে রক্তের প্লেটেলেট আশংকা জনকভাবে কমে যায়। ফলে কোন সময় দাঁতের গোড়া, মাড়ি, চামড়ার নিচে দিয়ে রক্তপাত হতে পারে। খাদ্য নালীতে রক্তপাত হয়ে পায়খানা আলকাতরা র মতো হতে পারে। এবং সঠিক সঠিক ফ্লুয়িড ম্যানেজমেন্ট না হলে, রোগী মারাও যেতে পারে!

এখন ডেঙ্গুর সিজন চলছে। এপ্রিল থেকে অক্টোবর ডেঙ্গুর সিজন। ২০১৪ সালে পুরো সিজনে সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিলো ১৪জন, সেটাই ছিলো সর্বোচ্চ। এ বছর ভয়বহতা আগের যেকোন বারের চেয়ে বেশি। এখন পর্যন্ত মাত্র তিনমাসেই মারা গেছে এগারো জন!

এখন আসি ডেঙ্গু হলে করনীয় কি হবে সে ব্যাপারে। কথায় বলে মৌসুমের জিনিস মৌসুমে। বৈশাখী ঝড়, আষাঢ়ে বৃষ্টির মতো এখন জ্বর মানেই ডেঙ্গু। কনফার্ম করা যায় ডেঙ্গু এন্টিজেন, ডেঙ্গু এন্টিবডি, সিবিসি ইত্যাদি পরীক্ষা দ্বারা।

ডেঙ্গুকে অবহেলা করা কাজের কথা না। তিন দিনের জ্বরে কেউ মারা যায়? হ্যাঁ মারা যেতে পারে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই। কাজেই জ্বর হলে গড়িমসি না করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন, পর্যাপ্ত তরল খাবার দিন। একটি কথা, প্লাটিলেট নিয়ে যত মাতামাতি করা হয়, ব্যাপারটা তত ভয়াবহ না, এমনকি রক্তপাত শুরু না হলে প্লাটিলেট   দেওয়ার ও  প্রয়োজন নেই।

আর হ্যাঁ, জ্বর কমে গেছে বলে উৎফুল্ল হওয়ার কিছু নেই, জ্বর কমার দুই থেকে তিনদিন অনেক ক্ষেত্রে বিপদ হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, প্রেশার কন্ট্রোল রাখা। সঠিক ফ্লুয়িড ম্যানেজমেন্ট করে প্রেসার ঠিক রাখা গেলে, প্লাটিলেট এমনিতেই ঠিক হয়ে যায়। আর জ্বরের জন্য প্যারাসিটামলই যথেষ্ট। এনএসএআইডি জাতীয় ঔষধ একদমই না।

মেডিকেল সায়েন্সে একটা কথা আমরা প্রায়ই বলি, প্রিভেনশন ইট বেটার দ্যান কিউর

আর এই বেটার কাজটা আমরা করতে পারি খুব সহজে, এর বাহককে ধ্বংস করে। এডিস মশার ঘরবাড়ি হচ্ছে স্বচ্ছ জমানো পানি, যা ফুলের টব, ডাবের খোসা পরিত্যাক্ত টায়ার, নির্মানাধীন বাড়ির বেসমেন্টে জমে থাকা পানি ইত্যাদি। অন্যের ঘরবাড়ি ভাঙ্গা যদিও কাজের কথা না তথাপি বেয়াদব এডিসের ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না।

কুটুস করে কামড় একটা দিল অথচ মরে গেলাম। ব্যাপারটা এত খেলো করে দেখার সুযোগ নেই। কে না জানে, আত্মরক্ষা ফরজ? সো এডিসের বংশ, আমরা করব ধ্বংস। পারলে ঠেকাক। আর হ্যাঁ আরেকটা কথা, সরকারের কাজ সরকার করবে, আমার কি? রাম সাম যদু মধু করে দিবে, খাইয়ে দিবে, গিলায় দিবে এসব বাদ দিয়ে নিজের বাড়ির চারপাশটা একটু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করেই দেখুন না, কেমন প্রশান্তি লাগে! বোনাস হিসাবে সুস্থ থাকলেন!

সুস্থ দেহ, প্রশান্ত মন, বেঁচে থাকতে আর কী লাগে বলেন?

শুরু করেছিলাম জায়ানকে নিয়ে, যে তার মা দিবার চোখে স্বর্গের আলোর দ্যুতি এনে দিয়েছিল। মায়ের সে আলো নিভে গেছে! হ্যাঁ ঠিক শুনছেন। মাত্র তিনদিনের ডেঙ্গু জ্বর আমাদের জায়ানকে নিয়ে গেছে না ফেরার দেশে।

জায়ান তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। খুবই লক্ষী প্রাণবন্ত এক রাজপুত্র। সে তার সবটুকু আলো সাথে করে নিয়ে গেছে। জ্বলজ্বলে তারা হয়ে ফুটে আছে আকাশে, অথচ তার মায়ের ঘরে এখন চির অমাবস্যা। তোমার রেখে যাওয়া বাবা মা বাঁচবে কী নিয়ে? কী করে জায়ান? এমন অবেলায় যেতে হয় বাবা?

লেখকঃ

ডা. ছাবিকুন নাহার

মেডিকেল অফিসার

ঢাকা মেডিকেল কলেজজ, ঢাকা।

#Lady_in_Red

প্ল্যাটফর্ম ফিচার রাইটার : জামিল সিদ্দিকী

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ,গাজীপুর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ক্যান্ডি ফ্লস ( হরর সিরিজ )

Fri Sep 14 , 2018
হরর সিরিজঃ ০১ ডিসক্লেইমারঃ এই গল্পের ঘটনা ৮০% সত্যি।মূল চরিত্র,তিনি নিজেই আমাকে এই গল্প বলেছেন।সঙ্গত কারণেই কোন স্থান কাল উল্লেখ করা হলো না,কিন্তু মূল চরিত্রের নাম রাখা হয়েছে অবিকৃত। ক্যান্ডি ফ্লস ———– অনেক রাত,তিনটা বেজে পনেরো,টেবিল ঘড়ির দিকে আলগোছে একবার তাকিয়ে আবার পড়ায় মনযোগ দেয় তুলি।ঘুম আসছে তার,কিন্তু যার দু’দিন […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo