লেখকঃ ডা রজত দাশগুপ্ত
(পূর্বকথাঃ সময়টা ১৯৩৯। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু হয়েছে। সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিল তদানীন্তন বৃটিশ সরকারের কাছে ঢাকায় একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের প্রস্তাব পেশ করে। কিন্তু যুদ্ধের ডামাডোলে প্রস্তাবটি হারিয়ে যায়। পরে আবার আলোর মুখ দেখে ছয় বছর পর ১৯৪৫ সালে যে বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। বৃটিশ সরকার উপমহাদেশের ঢাকা, করাচী ও মাদ্রাজে (বর্তমানে চেন্নাই) তিনটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ উপলক্ষে ঢাকার তৎকালীন সিভিল সার্জন ডাঃ মেজর ডব্লিউ জে ভারজিন এবং অত্র অঞ্চলের প্রথিতযশা নাগরিকদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তাদের প্রস্তাবনার উপর ভিত্তি করেই ১০ জুলাই ১৯৪৬ তারিখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ চালু হয়। তাই প্রতিবছর ১০ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বা ডিএমসি ডে উদযাপিত হয়।)
রয়্যাল কানাডিয়ান মেডিকেল কোরের মেজর উইলিয়াম জন ভার্জিন যিনি ছিলেন তখনকার ঢাকার সিভিল সার্জন মেডিকেল কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান। দেশভাগের পর তিনি নিজের মাতৃভূমি কানাডায় চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব বাংলা সিভিল সার্ভিস চালু হলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ই জি মন্টোগোমারী একই সাথে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ এবং হাসপাতালের প্রধান ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালের ১৯ এপ্রিল কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একসময়ের স্বনামধন্য চক্ষু বিশেষজ্ঞ টি আহমেদ শর্ত সাপেক্ষে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ এবং হাসপাতালের প্রধান ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন। তাঁকে প্র্যাকটিস করার সুযোগও দেওয়া হয়। প্রথম দিকে বিকাল বেলা নিজের অফিসেই তিনি রোগী দেখতেন যেখানে তিনি সেই সময়ের উপযোগী অত্যাধুনিক যন্ত্রসামগ্রী বসান।
টি আহমেদের পর ১৯৫২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সেই সময়ের সার্জন জেনারেল কর্নেল এম কে আফ্রিদি অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৩ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এরপর সেই পদে আসেন অধ্যাপক নওয়াব আলী যিনি ১৯৫৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
মাঝখানে সেই পদে ছিলেন একেএম আব্দুল ওয়াহেদ এরপর ১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে অধ্যাপক নওয়াব আলী আবার স্বপদে ফিরে আসেন। আঁতুড় ঘরে থাকা এই চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক সাথে পাঁচটি ব্যাচ ভর্তি হয়। কে ১ থেকে কে ৫। এর ভিতর কে ৫ এ নতুন ছাত্র ছাত্রী ভর্তি করা হয়। কে ১ থেকে কে ৪ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা আসে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে মাইগ্রেশন করে। মোট ছাত্র ১০২ জন আর ছাত্রী ২ জন।
দেশভাগ এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে আরও শিক্ষার্থী চলে আসে। তারা অনেকে ছিল উঁচু বর্ষের। এই জন্য মেডিকেল কলেজে নানা ক্লিনিক্যাল ডিপার্টমেন্ট খোলার এবং সেখানে শিক্ষকদের পদ তৈরি করার। এইভাবেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের বেড়ে ওঠার গল্পের শুরুঃ পূর্ব বাংলায় চিকিৎসাশিক্ষার বিস্তার এবং সেখানকার মানুষের জন্য উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা শুরু করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল।
একই সাথে প্রয়োজন পরে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের পেশাগত পরীক্ষার জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনার ব্যবস্থা করা। এই জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রণী ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে। সেখানে চিকিৎসা শিক্ষা অনুষদ তৈরি হয়। দেশভাগের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মাহমুদ হাসান এবং পরবর্তীতে ড. মোয়াজ্জেম হোসেন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। অবশ্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ স্থাপনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।
ডাঃ উইলিয়াম জন ভার্জিন ১৯৮৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৪০ বছরপূর্তি অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণের এক পর্যায়ে বলেন যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ স্থাপনের আলোচনা সেরে তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লী থেকে ফেরার পথে ট্রেনে ডাঃ ভারজিন এবং সেই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদারের মধ্যে আলাপচারিতায় রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘মেডিকেল কলেজের জন্য যদি আমার নিজের বাড়ি ছেড়ে দিতে হয় তাও ঢাকায় মেডিকেল কলেজ হবে।’
দেশভাগের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক সংকট দেখা দেয়। বেশির ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের চিকিৎসক ভারতে চলে যান। এনাটমি বিভাগের প্রধান ডা পশুপতি বসু আর ফিজিওলজি বিভাগের প্রধান ডা হীরালাল সেন ভারতে চলে যান। তাদের স্থলাভিষিক্ত হন যথাক্রমে আব্দুর রহমান এবং ডা এম এ করিম। কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা আনোয়ার আলী ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ডা আফতাবুদ্দিন আহমেদ ফার্মাকোলজি বিভাগের হাল ধরেন। পরে প্রফেসর একেএম সামসুদ্দিন আহমেদ লন্ডন থেকে ফিরে ফার্মাকোলজির অধ্যাপকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
মেডিসিনের অধ্যাপক ডা একেএম আব্দুল ওয়াহেদ ও ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক ডা নওয়াব আলীর মত অনেককে ক্লিনিক্যাল বিষয়গুলো পড়ানোর দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়। তারা কলকাতার লেক মেডিকেল কলেজে একই বিষয়ে শিক্ষকতা করতেন। ডা এলিনসন ছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেনারেল সার্জন। তাঁকে সার্জারি বিভাগের প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ডা নোভাক যিনি ছিলেন একজন হাঙ্গেরিয়ান ক্লিনিক্যাল সার্জারির প্রধান হিসাবে যোগ দেন। অধ্যাপক ফোরফুটা রেডিওলজি বিভাগের প্রধান হিসাবে যোগ দেন। ১৯৫০ এর দিকে আরেকজন সার্জন টেরাসানকো সার্জারি বিভাগে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে ইংল্যান্ড থেকে ফিরে ডা আসিরুদ্দিন এবং ডা কে এস আলম সার্জারি বিভাগে যোগদান করেন। রয়্যাল কলেজের ফেলো এবং স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যার অধ্যাপক ডা হাবিব উদ্দিন আহমেদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের প্রধান হিসাবে যোগদান করেন। এরপর মাদ্রাজের হুমাইরা সাইদ, যিনি ছিলেন এমআরসিওজি পাশ; পূর্ব পাকিস্তান সরকার দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে তিনি স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। আরেকজন রয়্যাল কলেজের ফেলো ডা মোহাম্মদ ইব্রাহিম ১৯৫০ সালে ফিরে এসে মেডিসিনের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ডা একেএম আব্দুল ওয়াহেদ ও অধ্যাপক ডা নওয়াব আলী অবসরগ্রহণ করার পর ডা সামসুদ্দিন আহমেদ এবং ডা মোহাম্মদ ইব্রাহিম যথাক্রমে মেডিসিন এবং ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের প্রধান হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল গিয়াসুদ্দিন আহমেদ এবং ডা হাফিজুর রহমান এডিশনাল সার্জনের দায়িত্ব করেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজের স্বনামধন্য চিকিৎসক ডা মোহাম্মদ রেফাতউল্লাহ প্রথম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চক্ষু সার্জারি শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে অবসর নেওয়ার আগে তিনি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ এবং হাসপাতালের প্রধান ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। কে ৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথম ‘বিশুদ্ধ’ ব্যাচের স্টুডেন্ট। ১৯৫১ সালে তারা এমবিবিএস পাশ করেন। কলকাতা আর লেক মেডিকেল কলেজ থেকে আগতরা (কে১-কে৪) তার আগেই চিকিৎসক হয়ে যান। এই চিকিৎসকরা পূর্ব বাংলার স্বাস্থ্যখাতে নতুন জনবল হিসেবে যোগ দেন। তাদের যোগদানের ফলে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় জনবলের ঘাত্তি কিছুটা পূরণ হল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এমন জনবল সংকট ছিল ১৯৪৮-৪৯ এর দিকে তৃতীয় চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা সার্জনকে ফার্স্ট এসিসটেন্ট হিসেবে সহায়তা করত।
শুরু থেকেই শিক্ষকরা সময়ানুবর্তীতার চর্চা করতে থাকেন। সকাল ৭ টায় ক্লাস শুরু হত। রাউন্ড শুরু হত সকাল ৯ টায় (এখনও তা অব্যাহত আছে)। এক ওয়ার্ডে ৫-৬ জনের বেশি শিক্ষার্থী ছিল না। ফলে তাদের পড়াতে অনেক সুবিধা হত। তখন সকাল ৭ টা থেকে বিকাল ৪ টা, কোন কোনদিন ৫ টা পর্যন্ত ক্লাশ হত। ১৯৪৮-৪৯ সালের দিকে একজন সিভিল সার্জন ডা মোহাম্মদ হোসেইন কলেজে মেডিকেল জুরিসপুডেন্স (এখনকার ফরেনসিক মেডিসিন) পড়াতেন। তার পড়ানোর স্টাইল ছিল অনেক সুন্দর। আর্সেনিকের বিষক্রিয়া এবং কলেরার পার্থক্য পড়াতে ভাওয়াল সন্ন্যাসীর কেস নিয়ে আলোচনা করতেন (এখনও ফরেনসিক মেডিসিনের শিক্ষকদের এটি প্রিয় টপিক)। এখন যেখানে বহির্বিভাগ সেখানেই প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রথম ছাত্র হোস্টেল। পাকা মেঝে, সারি সারি ঘর, মাঝে চাটাই এর বেড়া। অনেকটা আর্মি ব্যারাকের মত চেহারা। টিনের ছাউনির এই হোস্টেলের ডাকনাম ছিল ‘ব্যারাক হোস্টেল’। এই ব্যারাক হোস্টেলই ছিল ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার। ব্যারাক নিয়ে একটি কবিতা প্রচলিত ছিলঃ
‘ব্যারাক ভরা ধূলির আকর
রাজধানী এই ঢাকা শহর
তারই ভিতর আছে যে এক
সকল গোয়ালের সেরা
অসুখ দিয়ে ভরা
সে যে ওষুধ দিয়ে ঘেরা।’
প্রথমদিকে শিক্ষার্থীরা থাকতেন নীলক্ষেত ব্যারাকে। এরপর মেডিকেল কলেজের কাছে ব্যারাক চলে আসে। ব্যারাকের সামনে ছালা আর টিনের রেস্টুরেন্ট। এর ভিতর আলি মিয়ার হোটেল ছিল বিখ্যাত। তখনকার দিনে নিরাপত্তা নাকি এতই বেশি ছিল নবাবপুরের মুকুল সিনেমা হল থেকে রাতের শো শেষ হলে নির্বিঘ্নে শিক্ষার্থীরা ব্যারাকে ফিরে আসতেন। পাশ করার পর সেই আমলের ২৫০ টাকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের গ্র্যাজুয়েটরা পূর্ব পাকিস্তানের মেডিকেল সার্ভিসে নিয়োগ পান।
কিন্তু দুঃখজনক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মেডিকেল কাউন্সিল কয়েক বছর পূর্ব বাংলার এই মেডিকেলের এমবিবিএসকে স্বীকৃতি দেয় নাই। ঢাকা মেডিকেলের গ্র্যাজুয়েটদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরেও সুযোগ দেওয়া হত না কয়েক বছর। ১৯৫৭ এবং ১৯৫৮ সালে যথাক্রমে চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হল। এর ফলে সিভিল সার্ভিসে কিছু কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হল। চাকরির সংকট এর আগে ছিল তীব্র। অনেকে পাবলিক হেলথ সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে পাবলিক হেলথ অধিদপ্তরের সাথে সার্জন জেনারেলের অফিস একীভূত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মেডিসিনের অধ্যাপক ডা একেএম আব্দুল ওয়াহেদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে অবসর নেওয়ার পর পেশওয়ারের খাইবার মেডিকেল কলেজে অধ্যক্ষপদে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রথম মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পান। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় তিনি মেদিকেল শিক্ষা ব্যবস্থার উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পান। চিকিৎসাশিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য আস্তে আস্তে এলএমএফ স্কুল গুলো বন্ধ করে সেখানে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হতে থাকে। ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে রাজশাহী, সিলেট এবং ময়মনসিংহে স্বাধীনতার আগে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
(এই লেখার বেশির ভাগ তথ্য হাবিবুজ্জামানের Seventy years in a shaky subcontinent নামক বই থেকে নেওয়া)