সোমবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২০
ভয় করে, বুকের ভেতরে ধুকপুক করে। আম্মা বলে, প্রতিদিন যাস কেন? না গেলে হয় না! আমি বলি, যেতে হয়। কিছু কাজ যে থাকে! রোগী কমে গেছে। পারলে মানুষ ঘর থেকে বের হয় না। তবু যারা আসে, না পেরেই আসে। তাদের জন্যেইতো যেতে হয়।
আমি পেটের ডাক্তার। এর মাঝেই রোগী আসে। বুক জ্বলে, পেটের মধ্যে ব্যথা করে, বাথরুম হয়না ঠিকমত। আজকে যে রোগির এন্ডোস্কপি করলাম তার বমি ভাল হচ্ছেনা। অনেকদিনের বমি। বলেছিলাম এই সময়ে না করি এন্ডোস্কপি, ওষুধ দিয়ে দেই। রাজি হল না। এন্ডোস্কপি এখন হাই রিস্ক পরীক্ষা, ডাক্তারদের জন্যে। যত্ন করেই করে দিলাম। ভেতরে ভাল আছে। বমি হবার মত কিছু নেই। ২২ বছরের একটা মেয়ে, স্বাস্থ্য ভাল, সব রিপোর্টও ভাল। জানতে চাইলাম ডায়েটিং করছিল কিনা। মনে মনে ভাবছিলাম, এনোরেক্সিয়া নারভোসা কিনা? তাওতো মেলেনা। ওর মা জানালো, ডায়েটিং করছিল, কিন্ত এখন তো করছে না। তাও বমি কমছে না। ভয় পেয়েছে? করোনার ভয়? ভয়েও বমি হয়। এই প্রশ্নটা আগেও করেছিলাম, তখন না বলেছিল। এবার বললো, ভয় পেয়েছিল। একদিন সন্ধ্যাবেলা ছাদে অন্ধকারে একটা সাদা কুকুর দেখে ভয় পেয়েছিল। সেই থেকে বমির শুরু। হতে পারে, এটাও কারণ হতে পারে। সাইকিয়াট্রিস্ট আরমান ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে নিলাম। ওষুধ দিয়ে দিলাম। দেখা যাক কি হয়।
গতকালের এন্ডোস্কপিতে ছিল ডিউডেনামে টিউমার, মনে হয় ক্যান্সার। দেখা যাক বায়োপসিতে কি আসে। কোলনস্কপিও করতে হলো। ঢাকা মেডিকেলের রোগী। ওখানে নাকি মেশিন নষ্ট। গেল সপ্তাহের একজনের কথা মনে হয়। বমি আর হেঁচকি থামছেই না। ৮০ বছরের একজন লোক, অনেক কষ্ট করছে। কাশছেও। করোনার দিনে কাশি! ভয়তো লাগেই। তাও এন্ডোস্কপি করতেই হবে। করলাম। পাকস্থলীর পরের অংশটা খাবার দিয়ে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে আছে। আগে থেকেই আলসার দিয়ে সরু ছিল রাস্তা। কমলা খেয়েছিল শখ করে। খোসা ছাড়া বাকি সবটা খেয়ে নিয়েছে। তার না হজম হওয়া অংশগুলো দলা পাকিয়ে বন্ধ করেছে রাস্তা। বের করলাম সেইগুলো আমাদের ডরমিয়া বাস্কেট দিয়ে। বেশ কিছু টাকা চার্জ করা যেত। ধুর! কি হবে টাকায়! দুইদিন পর চলে গেলেন ভদ্রলোক। অনেক ভাল লাগলো। এই ভাল হয়ে চলে যাওয়াতেই ভেতরে একটা সুখ লাগে। এভাবেই একটু একটু করে কাজ চলে। আগের চেয়ে অনেক কম। তাও চলে। চোখে সাহস নিয়ে তারেক আলম স্যার দৃঢ় পদক্ষেপে হেঁটে যান পুরো হাসপাতাল। সিএ রিফাত, রাফা, পূর্বা, মীরা আর ইন্টার্নরা ভয়হীন ঘুরে বেড়ায় এই রোগি থেকে ওই রোগির কাছে।
এর ফাঁকেফাঁকে আমার ভয় লাগে। কে বুঝি গোপন করে করোনা নিয়ে আসে! পুরো প্রটেকশনতো নেয়া হয়না। পুরো পিপিই আমি পরে নিলাম, আমার এসিস্ট্যান্টদের কি হবে? ওদের তো নেই পিপিই। মাসুদ স্যারের কথা মনে হয়। আমাকে নিজ হাতে যিনি এন্ডোস্কপি শিখিয়েছেন। উনি আজ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে। অনেকদিন হয় ভাল হচ্ছেন না। আমাদের মঈন ভাই ভেন্টিলেটরে। ভেন্টিলেটরে গেলে ভাল হবার আশা কমে যায়। ভয়ে আছি। মন দিয়ে দোয়া করছি। আল্লাহ উনাকে ফিরিয়ে দিন।
বউয়ের হাতে একটা পুরো হাসপাতাল। ভয়ে থাকি ওকে নিয়ে। ওর হলে আমার হবে অথবা আমার হলে ওর। আব্বা আম্মার কাছে যাইনা। দরজায় বাজার, ওষুধ, খাবার রেখে আসি। কাছে গেলেই বিপদ। উনাদের এমনিতেই কত অসুখ! বাচ্চাদের বলি দূরে থাকো।
ভয় পাই, অনেক ভয় পাই। বুকের ভেতর ধুকপুক করে।
তাই বলে কি কাজ থেমে আছে?
লেখাঃ সহযোগী অধ্যাপক ডা. রানা মুশতাক আহমেদ
বিভাগীয় প্রধান, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ।