“Don’t be patient 31” কথাটার মানে বোঝেন?
দক্ষিণ কোরিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর একটি। সেই দেশেও করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে দাবানলের মত। কিভাবে? একটু পিছে তাকিয়ে দেখা যাক।
দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথম করোনাভাইরাস ধরা পড়ে জানুয়ারির ২০ তারিখে, একজন ৩৫ বছর বয়স্ক নারী উহান থেকে সিউল বিমানবন্দরে অবতীর্ণ করলে। তাকে সঙ্গে সঙ্গে সেলফ কোয়ারান্টাইনে রাখা হয়। এর পরের এক মাসে গোটা দেশে মাত্র ৩০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়। সো ফার, সো গুড, তাই না? এক মাসে মাত্র ৩০ জন আক্রান্ত হয়েছে, খারাপ না। কিন্তু এরপর…
ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখে একজন মধ্যবয়স্ক নারী একটি ছোট ট্রাফিক এক্সিডেন্টে পড়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ডায়গু শহরে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই ফেব্রুয়ারির ৯ এবং ১৬ তারিখে তিনি স্থানীয় এক চার্চে দুবার যান উপাসনায় অংশগ্রহণ করতে। এর মাঝে কিন্তু ১৫ তারিখে তাঁর জ্বর ধরা পড়ে, এবং ডাক্তাররা তাঁকে করোনাভাইরাসের জন্য পরীক্ষা করতে পরমার্শ জানান এবং একই সাথে সেলফ আইসোলেশনে থাকার জন্যও। ডাক্তারদের পরামর্শ উপেক্ষা করে তিনি শুধু ১৬ তারিখে চার্চেই যান নাই, এরপর বন্ধুর সাথে এক রেস্তরাঁতেও যান লাঞ্চ বাফেট খেতে।
১৭ তারিখের মধ্যে ভদ্রমহিলার অবস্থার অবনতি হলে তিনি অবশেষে করোনাভাইরাসের জন্য পরীক্ষা করান। ১৮ তারিখে ফলাফল আসেঃ পজিটিভ, এবং তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার করোনাভাইরাস রোগী নম্বর ৩১।
এর কিছুদিনের মধ্যেই দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা রীতিমত জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ সেই চার্চেরই সদস্যা, যেখানে রোগী নম্বর ৩১ একবার নয়, দুবার গিয়েছিলেন।
কোরিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার (কেসিডিসি) -র উপাত্ত অনুযায়ী, ‘রোগী ৩১’ যেই দুবার চার্চে গিয়েছিলেন, সে দুইবার মোট ৯,৩০০ জন মানুষ ছিলেন সেখানে, যাদের মধ্যে ১,২০০ জন পরবর্তীতে ফ্লু এর মত উপসর্গ ধরা পড়ে পরবর্তী দিনগুলোতে। রোগী ৩১ যেই রেস্তরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন, সেখানে কত মানুষ ছিল, সেই হিসাব অবশ্যই পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া, এই একই চার্চের বেশ কিছু সদস্য জানুয়ারি ৩১ – ফেব্রুয়ারির ২ তারিখের মাঝে ডায়গুর কাছেই আরেক শহর চেওংডুর এক হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে।
এই ডায়গু আর চেওংডু, এই দুই শহরেই কিন্তু সমগ্র দক্ষিণ কোরিয়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের ৮০ ভাগ অবস্থিত। যদি কেসিডিসির উপাত্ত সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে বলা যেতে প্রায় এই যে দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাস বিস্ফোরণ, তার পিছনে এই চার্চ, এবং বিশেষ করে রোগী ৩১ এর বিশাল হাত রয়েছে।
এত কথা বলার কারণ একটাই, এই এক রোগী ৩১ এর গাফিলতি থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার মত উন্নত একটা দেশে করোনাভাইরাস কিভাবে ছড়িয়ে পড়লো, সেটা থেকে আমাদের বাংলাদেশের মানুষরা যাতে কিছু শিক্ষা নেয়, সেই আশায়। সোশ্যাল আইসোলেশন, সেলফ কুয়ারান্টাইন, কোন ফাইজলামির বিষয় না। সরকার তাঁদের দায়িত্ব পালন করছে কি করছে না, সেটা একটা বিষয় বটে। কিন্তু একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনাদের নিজেদের উপরেও কিছুটা দায়িত্ব এসে বর্তায়, নিজের জন্য, নিজেদের প্রিয়জনদের জন্য, আশেপাশের অচেনা আগন্তুকদের জন্য।
আপনি বাংলাদেশে বড় হয়েছেন বৃষ্টির কাদামাটিতে ফুটবল খেলে, ড্রেনের পানি দিয়ে বানানো টক দিয়ে চটপটি খেয়ে। সেজন্য আপনার ইম্মিউন সিস্টেম অনেক শক্ত, করোনাভাইরাসে আপনার কিছুটাই করতে পারবে না, এই সুখস্বপ্ন দেখে বড়াই করা ছাড়ুন। আর আপনার ইম্মিউন সিস্টেম নাহয় শক্ত হতেই পারে, কিন্তু করোনাভাইরাসের উপসর্গ প্রকটভাবে দেখা না দিয়েও আপনি যে এই রোগের জীবাণুর বাহক হিসেবে অন্যদের ঝুঁকির দিকে ফেলে দিতে পারেন, সেটা একটু মাথায় রাখবেন। আপনার জন্য যেটা মামুলি ‘সর্দি, কাশি এবং একটু জ্বর’ সেটার আপনার বৃদ্ধ বাবা যার কিছুদিন আগে বাইপাস সার্জারি হয়েছে, বা পাশের বাসার দাদী যিনি শ্বাসকষ্টে ভুগেন, অথবা আপনার বন্ধুদের সাথে কফি হাউজে বসে ‘ক্যান্ট মিস’ আড্ডায় সেলফি তুলার সময় পিছনের টেবিলে বসা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অচেনা আঙ্কেলটির জন্য জীবননাশক হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর এই যে নাকে তেল দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এটা করার সময় আরো কয়জনকে আপনার মতই বাহক বানিয়ে ফেলছেন, নিজের সাথে আরো অনেককে পোটেনশিয়াল নিঃশব্দ আততায়ীতে পরিণত করছেন, সেটা বুঝতে পারছেন?
বাদ থাকে প্রবাস ফেরত বাঙালীদের কথা। ভাই, আপনাদের জন্য এই দেশ কৃতজ্ঞ। আপনাদের খেটে খাওয়া রেমিট্যান্সের টাকাতেই এই দেশ চলে। এইটা অস্বীকার করার উপায় নাই। কিন্তু এই যে হুট করে দেশে ফিরে আসছেন, ফিরে এসে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে অনুরোধ করলেও মানতে চাচ্ছেন না, উল্টো বিরক্তি প্রকাশ করছেন, সরকার কোয়ারাইন্টাইনে রাখতে চাইলেও কোয়ারাইন্টাইন ক্যাম্পের তালা ভেঙ্গে বিক্ষোভ করছেন ‘আই ফাক ইউ’ বলে ইংরেজিতে গাল মেরে নিজের জাত দেখাচ্ছেন, বাসায় যেতে দিলেও নিজেকে আলাদা করে না রেখে দাওয়াত খেয়ে বেড়াচ্ছেন, সাজেকে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করছেন, ভাই আপনাদের বুদ্ধি এবং দায়িত্বজ্ঞান কোথায়, ভাই? সরকার তাদের কাজ ঠিকমত যদি করতে না পারে, তাদের গালি প্রাপ্য, কিন্তু আপনারা এসব করে নিজেদের এবং অন্যদের এমন ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন সেটার দায়ভার কার? পরে আপনি বা আপনার প্রিয়জন আক্রান্ত হলে, খোদা না করুক কেউ মারা গেলে তখন তো সরকারকেই গালি মেরে নিজের দায় দায়িত্ব থেকে হাত ধুয়ে ফেলবেন। সেলফ কোয়ারেন্টাইন, সব স্কুল কলেজ ভার্সিটি বন্ধ করে দেয়া, এসব কি আপনাদের পার্টি/ভ্যাকেশন ট্যুর/মউজমাস্তি আর ফেসবুকে সেলফি/চেক-ইন এর জন্য করা হয়েছে?
বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপূর্ণ একটা দেশে জনসাধারণের গাফিলতি এবং ন্যূনতম দায়দায়িত্ব নিয়ে চলাফেরার করার অনীহার মাশুল যে কি বাজেভাবে দিতে হতে পারে, সেটা দয়া করে অনুধাবন করুন। আমি বাংলাদেশে থাকি না, বলতে পারেন আমার এত ঠ্যাকা পড়েছে কেন আপনাদের লেকচার দিতে? ভাই, দিতাম না, কিন্তু আমার ঠ্যাকা আছে। আমার বৃদ্ধ বাবা-মা, শ্বশুর শাশুড়ি, নানি, এবং অগণিত মুরুব্বি আত্মীয় স্বজন প্রিয়জন দেশেই থাকেন। আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় বন্ধুবান্ধবেরও অভাব নাই। আমি এবং আমার স্ত্রী তাদের প্রত্যেকের জন্য দারুণভাবে শঙ্কিত। তাই হ্যাঁ, আপনারা কি করছেন, না করছেন, কিভাবে চলাফেরা করছেন, সেসব নিয়ে আমার অবশ্যই ঠ্যাকা আছে।
হয়তো ইতিমধ্যেই দেরি হয়ে গেছে অনেক। কিন্তু তারপরেও সবার কাছে মিনতি, আরেকটু সচেতন হন, আরেকটু দায়িত্ববান হন। এটা কোন ফাইজলামি না।
For god’s sake, don’t be Bangladesh’s Patient 31.
From Facebook Status of “Yamen Haque”