স্যারের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। শুনেছি স্যার অসুস্থ। বাইপাস সার্জারি করার পরে প্রাকটিস করা ছেড়ে দিয়েছেন। রিটায়ার্ড করেছেন আরো আগেই। ছেলে মেয়ে দুইজনই বিদেশে সেটেলড। স্যার আর ম্যাডাম ধানমন্ডিতে থাকেন। মাঝে মাঝেই দেশের বাড়িতে যান। সেখানে একটা এতিমখানা চালান স্যার। বারবার স্মৃতি কাতর হয়ে পড়ছি। স্যার আমাকে চিনতে পারবেন তো? চিনতে পারার কথা না। সে তো আর আজকের কথা নয়!
আমি তখন হাসিখুশি এক ইন্টার্ন। স্যারের ওয়ার্ডে আমার প্লেসমেন্ট ছিল। বন্ধুদের সাথে মজা করি। সিনিয়র, জুনিয়র সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে। সবাই জানে, আমি এক সিনসিয়ার ডাক্তার। সেই আমি, তিনদিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে যেয়ে, পাক্কা বিশ দিন পরে আসলাম। স্যার প্রচুর খেপে গেলেন। আমাকে যতই প্রশ্ন করেন, আমি কোন জবাব দিই না। আসলে পৃথিবীতে তখন আমার চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। সমাজের প্রতি বিরক্ত, পৃথিবীর প্রতি বিরক্ত এই আমি, অপেক্ষা করে আছি স্যারের শাস্তির। কি শাস্তি দেবেন স্যার? আহা! যদি মৃত্যু দিতেন! এই আমি বেঁচে যেতাম। আমার ছোট্ট মাথায় এত টেনশন নিতে পারি না। সারাজীবন আমাকে বাবা মা আগলে রেখেছেন, পৃথিবীর সব কদর্য থেকে। আমাকে অন্ধকার দুনিয়া থেকে আড়াল করে, এতটাই আদরে রেখেছেন যে, এত দুশ্চিন্তা নেওয়ার মত মানসিক ক্ষমতা আমার তৈরী হয় নি। আমি তো শুধু পড়াশুনা করবো, সিনিয়র আপু, ভাইয়াদের কাছ থেকে ট্রিট নিবো, বন্ধুদের সাথে বেড়াবো, খাবো, মজা করবো। হঠাৎ করে অন্ধকার দুনিয়া দেখার মত মানসিক প্রস্তুতি তো আমার ছিল না। আহা! স্যার কি শাস্তি দিবেন আমাকে? মৃত্যু? দিলেতো আমি বেঁচে যাই। আমি তাই নীরব থেকে অপেক্ষা করি শাস্তির।
আমি কিছু বলি না দেখে স্যার রেগে যেয়ে বাবা মা কে ডাকালেন। বাবা মা স্যারের সাথে মিথ্যা বললেন না। বলে দিলেন, আমি বাড়িতে যেয়ে গলায় ফাঁস নিতে গিয়েছিলাম।
আচ্ছা, আমার কি তখন আর কিছু করার ছিল? আমি তো মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। পৃথিবীর এতসব দায় দায়িত্ব এই ছোট্ট কাধে নেওয়া, সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। আমি ভয় পেয়েছিলাম।
আমার মা খুব ধনী পরিবারের মেয়ে ছিল। আমার বাবাদের অবস্থাও খারাপ ছিল না। কিন্তু আমার বাবা ছিলেন খুব সহজ সরল। বিভিন্ন সময়ে নানা রকম ব্যবসা করতে যেয়ে লস খেয়েছেন। সবাই তাকে ঠকিয়ে টাকা মেরে দিয়েছে। জমি জমা এক এক করে বিক্রি করেছেন আর ব্যবসায় লস খেয়েছেন। শেষে ধার দেনা করা আরম্ভ করেছেন। আমি এসব কিছুই জানতাম না। ছোট ছিলাম, কিন্তু আত্মীয় স্বজনদের কোন বিয়ে শাদির অনুষ্ঠানে গেলে দেখতাম, আমাদেরকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। তাই পরবর্তীতে আমি আত্মীয় স্বজনদের কোন প্রোগ্রামে আর যেতাম না। একবার আমার বড় খালার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। রাতে ঘুম ভেঙ্গে শুনি, খালা আমার বাবা মা দুজনকেই খুব কথা শোনাচ্ছেন। ছোট্ট মনে খুব বেশি অভিমান হলো। সকালবেলা কাওকে না বলে বাড়ি চলে এসেছিলাম। পরে আমি আত্মীয় স্বজনদের বাসায় তেমন বেড়াতে যেতাম না।
তিন দিনের ছুটি নিয়ে যেদিন বাসায় গেলাম, সেদিনও জানতাম না, আমার জীবনে এত বড় পরিবর্তন আসবে। আমার বড় ভাই, এইচ এস সি পাশ করার পরে আর পড়ালেখা করে নাই। তার পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না। সংসারের কোন দায় দায়িত্বের ভিতরেও সে নেই। মাঝে মাঝেই বিরক্ত হতাম। সেদিন বিরক্তিটা প্রকাশও করে ফেলেছিলাম। ভাইয়াই সেই সর্বনাশা খবরটা জানালো আমাকে। ভাইয়া বললো, আমাদের নাকি ভিটাবাড়ি ছাড়া আর কিছু এখন আর নেই। বাবা ডুবে আছেন ঋণে। ঋণের পরিমাণ কত সে সঠিক জানে না। তবে সে নাকি অনেক। ধার দেনা করেই আমার পড়ালেখার খরচ পাঠিয়েছেন। আমি আরাম আয়েশ করেছি, মজা করেছি; আমাকে কখনো তারা বুঝতে দেননি। কিন্তু এখন আমার ইন্টার্নী শেষের দিকে। সবাই আশা করে আছে, এখন আমি বাবার এইসব ঋণ শোধ করে ফেলতে পারবো। আমার মাথা ঘুরতে লাগলো । সবাই মনে করে, ডাক্তার হওয়া মানেই গাদা গাদা টাকা পয়সার মালিক। অনেকেই জানে না, একজন ডাক্তার জ্বলজ্বলে তারার মত জ্বলতে থাকে তো, ততক্ষণে অন্তত পাঁচশো ডাক্তার ঝরে পরে হতাশার গহবরে।
আমি বাবা মায়ের সাথে জীবনে প্রথমবারের মত ঝগড়া করলাম। খুবই হতাশ লাগছিল। বারবার মনে হচ্ছিলো, কত স্বপ্ন ছিল – ইন্টার্নী শেষে সারাদিন পিজির লাইব্রেরীতে পড়ে থাকবো; বিসিএস পাশ করবো, এফ সি পি এস অথবা এম ডি করবো মেডিসিনে! সেসব এখন দূর দেশের স্বপ্ন। মাথার ভিতরে শুধু ঘুরছে, ইন্টার্নী শেষে খাবো কি? বাবা, মা, ভাইকে খাওয়াবো কিভাবে? বাবার এত ঋণ আমি কিভাবে শোধ করবো? তাই খুব ঝগড়া করলাম বাবা মায়ের সাথে। বাবা মা কাঁদতে কাঁদতেই বললো, আমাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। আমি যেন আমার পড়ালেখায় মন দিই। আমার জন্য কোনদিন আমার বাবা মায়ের চোখে পানি আসবে, আমি ভুল করেও চিন্তা করি নি। চরম হতাশা আর কষ্টে রাতে ফাঁস নিতে গিয়েছিলাম গলায়। বড় ভাই দেখে ফেলে, তাড়াতাড়ি নামিয়ে ফেলে আমাকে।
আমি অপেক্ষা করে আছি, স্যারের শাস্তির। স্যার তার রুমে ডাকলেন আমাকে। স্যারের কাছে সব বললাম। স্যার আমাকে বললেন, বিসিএস এর জন্য পড়তে থাকো। তোমার ইন্টার্নী শেষ হলে কোন এক প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ঢুকিয়ে দেবো তোমাকে। যতদিন বিসিএস না হয়, ততদিন ওখানে চাকরি করবা আর পড়াশোনা করবা বিসিএস আর এফসিপিএস এর জন্য। বাবার ঋণ একসময় আস্তে আস্তে শোধ হয়ে যাবে।
আমার ইন্টার্নী শেষে স্যার সত্যি সত্যিই ঢুকিয়ে দিলেন একটা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে। আস্তে আস্তে আমার বিসিএস হলো, এফ সি পি এস হলো। এখন আমি মেডিসিনের এসোসিয়েট প্রফেসর। এখানকার টপ প্রাকটিসনারদের ভিতরে একজন। বাবার ঋণ বহু আগেই শোধ করেছি। লোকে বলে, বয়সের তুলনায় আমার প্রোপার্টিও নাকি অনেক বেশি।
স্যারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ নেই। স্যার ফেসবুকও চালান না। তবে স্যারের সব খবর আমি রাখি। বারবার আবেগ আপ্লুত হয়ে যাচ্ছি – স্যার আমাকে চিনবেন তো?
স্যারের বাসায় যখন পৌঁছালাম, তখন বিকাল। স্যার, ম্যাডাম বাসাতেই ছিলেন। আমাকে দেখে স্যার চিনতে পারেননি। তবে যখন নাম বললাম, তখন ঠিকই চিনতে পারলেন। বললেন, “তোমাকে কি ভোলা যায়? যখন জানতে পেরেছিলাম, তুমি সুইসাইড করতে গিয়েছিলে, তখন দুইদিন রাতে ঘুমাতে পারিনি।”
স্যার খুব খুশি হলেন আমাকে দেখে। বললেন, “আজকাল তেমন কেউ আসে না। ছেলেমেয়ে দুইটাও বিদেশে থাকে। আমাদেরকে ওদের সাথে থাকতে বলে। কিন্তু দেশ ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করে না। তাই বেশ একাকীত্বে ভুগি আমরা।” স্যারকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার মায়ের নামের এতিমখানাটা কেমন চলছে স্যার?” স্যার একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “ওটা বন্ধের পথে। আমি এখন প্রাকটিস করি না। এত টাকা কোথায় পাবো বলো?” আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, “স্যার, আপনার এক সন্তানতো এখনও দেশে আছে। আমাকে যদি সে সুযোগটা দিতেন, তাহলে চির কৃতজ্ঞ থাকতাম স্যার।”
স্যারের চোখটা গর্বে জ্বলজ্বল করছে। ম্যাডামকে গর্ব করে বললেন, “দেখো, এ শুধু আমার স্টুডেন্ট নয়, আমার সন্তান। আমার যোগ্য সন্তান।”
স্যার আমাকে দ্বিতীয় জন্ম দিয়েছিলেন। অকারণেই আজ চোখে পানি আসলো। সেই ইন্টার্নীর পরে, আজ এতকাল পরে আবার আমার চোখে পানি! আমি চোখের সে পানি লুকানোর চেষ্টা করলাম না। আজ এতকাল পরে, বাবার সামনে কাঁদতে, আমারও খুব ভালো লাগছে।
ডা. সুমনা তনু শিলা
৩৭ তম ব্যাচ
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ
প্ল্যাটফর্ম ফিচার রাইটার:
সামিউন ফাতীহা
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর