প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩০ নভেম্বর ২০২০, সোমবার
আজ ৩০ নভেম্বর ২০২০ “চিকিৎসকদের নিরাপদ কর্মস্থল দিবস”। ২০১৯ সাল থেকে এই দিনটিকে “নিরাপদ চিকিৎসা কর্মস্থল দিবস” হিসেবে পালন করা হয়। এই দিবসটি পালন করার পিছনে রয়েছে অনেক মর্মান্তিক ইতিহাস।
৩০ নভেম্বর ২০১২ সালের কথা, ডা. সাজিয়া আফরিন ইভা হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে নির্মম ভাবে নিহত হন। গত ১৭ জুন ২০২০ খুলনায় খুনের শিকার হন ‘গরিবের ডাক্তার’ হিসেবে পরিচিত রাইসা ক্লিনিকের পরিচালক ডা. মো. আব্দুর রকিব খান। কিংবা গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের ডেন্টাল সার্জন ডা. চিন্ময় দত্ত ও তার স্ত্রী সঞ্চিতা দত্তের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার মত প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে অমানবিক কর্মকান্ড। প্রতিদিনের পত্র-পত্রিকা, গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরকম হাজারো ঘটনা ইঙ্গিত করে কর্মস্থলে চিকিৎসকের নিরাপত্তাহীনতার কথা। চিকিৎসাসেবার ধরণ ও কাজের চাপ, মানসিক অবস্থার দরুন চিকিৎসক ও রোগীর মাঝে তৈরি হওয়া যোজন যোজন দূরত্ব আর অনিরাপদ পরিবেশে থেকে একজন ভীত সন্ত্রস্ত কাজের ভারে নুয়ে যাওয়া নির্ঘুম চিকিৎসক সঠিকভাবে রোগীর চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হন অনেক সময়। তাই নিরাপদ চিকিৎসা কর্মস্থল শুধু চিকিৎসা পেশাজীবী না, রোগীর জন্যেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আজকের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হবে নিরাপদ চিকিৎসা কর্মস্থল নিয়ে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত কিছু অভিমত।
নিরাপদ কর্মস্থল সৃষ্টি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিএসআরএম ফাউন্ডেশন মেডিকেল সেন্টার এর মেডিকেল অফিসার ইনচার্জ ডা. মো. মুরাদ হোসেন মোল্লা
বলেন,
“আইন প্রণেতা, আইনজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ মিলে সমসাময়িক চাহিদার প্রেক্ষিতে যেকোনো একটা বিষয় ভিত্তিক আইন প্রণয়ন করেন। সরকারের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার প্রয়োগ করেন। যার যা কাজ তা নির্বিঘ্নে করতে দিতে হবে। তা না হলে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে। কাঙ্ক্ষিত সার্ভিস পাওয়া যাবে না। যারা চিকিৎসার সাথে সংশ্লিষ্ট, তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে তাঁদের কাছে স্বাভাবিক সার্ভিস পাওয়া যাবে না। এটি বাস্তবতা। তাঁদের নিরাপত্তা তাঁদেরকেই নিশ্চিত করতে দেয়া হলে স্বাভাবিক ভাবেই মূল ফোকাস যে সার্ভিস, তা থেকে দূরে সরে যাবে। কাজেই চিকিৎসায় সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা বাকি সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে। সদিচ্ছা প্রয়োজন।
চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য করণীয় সম্পর্কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারী বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. মো. ইসমে আজম জিকো বলেন,
১) সবচেয়ে বড় সুরক্ষা হবে যদি নিজেই নিজের জন্য নিম্নোক্ত কাজ গুলো করিঃ
i. যথাযথ কাউন্সেলিং
ii. এরকম পরিস্থিতি তৈরি যেন না হয় সেজন্য সদা সতর্ক থাকা
iii. পরিস্থিতি বিবেচনায় কথা হিসেব করে বলা
iv. সবার সাথে লিয়াজু রক্ষা করে চলা
২) প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সুরক্ষা পাওয়া যাবে নিম্নোক্ত ভাবেঃ
i. সুরক্ষা আইন করেই শেষ নয় দরকার সেই
আইনের শাসন নিশ্চিত করা
ii. চিকিৎসকদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া
iii. মিডিয়ার সাথে বসে চিকিৎসকদের নিয়ে পজিটিভ নিউজ করার ব্যাপারে সমঝোতা করা
iv. মিডিয়া যেন কোন ভাবেই জনগণ ও চিকিৎসকদের মাঝে দেয়াল তৈরি করতে না পারে সে ব্যাপারে সজাগ থাকা
v. চিকিৎসকদের নিজস্ব মিডিয়া উইং নিশ্চিত করা
vi. জনগণের মাঝে চিকিৎসকদের নিয়ে একটা পজিটিভ মনোভাব তৈরির জন্য সচেষ্ট থাকা
“নিরাপদ কর্মস্থল সৃষ্টি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ” সম্পর্কে রংপুর প্রাইম মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ডা. হোসাইন আল-আমিন বলেন,
“চিকিৎসক ও সুরক্ষা! বিষয়টা দেখেই মনটা খারাপ হয়ে গেল, একজন মানুষ চিকিৎসক হবেন অথচ তাঁর সুরক্ষা তাঁকেই করতে হবে! সুরক্ষার জন্য লড়াই করতে হবে, প্রবন্ধ লিখতে হবে, উপায় বলার জন্য সবাইকে রচনা লিখতে হবে! এই ধারণাটাই দুঃখজনক। একজন চিকিৎসকের সুরক্ষা যে সমাজ কিংবা গণতান্ত্রিক সরকার করতে পারে না, সেদেশে চিকিৎসকদের নাম মাত্র থাকার মূল্য আসলেই কতটুকু তা আমার জানা নেই”!আমি চিকিৎসক হয়ে রোগীর সেবা করব আর টেবিলের নিচে তসবি জপব আল্লাহ মালুম আজ যেন মার না খাই! এরকম ভীত হয়ে, চুপ থেকে মার খাওয়ার নাম কি মানবসেবা? আসলেই কি এজন্য সবাই চিকিৎসক হয়েছিলাম? নিরাপদ কাজের পরিবেশ আমার কোন শখ নয় আবদারও নয় যে, আমি সরকারের কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে, দাঁত কেলিয়ে, কাঁচুমাচু করে চাইব। তেলের হাড়ির উপর বসে মাথায় তেল লাগিয়ে, উপরমহলের পায়ে তেল লাগিয়ে বলব প্লিজ, আমাকে একটু পরিবেশ দিন। আমি এত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না।
“চিকিৎসকদের সুরক্ষা ও নিরাপদ পরিবেশ” সেটি অধিকার। সেটি কখনই শখ নয়, “আমার পেশা, আমার সুরক্ষা”।
কে দিবে? সরকার ও সমাজ আমাকে দিবে, দিতে বাধ্য। আমি আবারও বলছি, তারা দিতে বাধ্য। আমাকে পরিবেশ নিরাপদ না হলে, রোগীর সমস্যাও আমি সরকারের মত দেখব, সমাজের মত দেখব তারা এখন আমাকে যেভাবে দেখে। আমাকে ৫ টাকার চকলেট খাইয়ে, ৫০০ টাকার সেবা নিতে আসলে আমি ৫ টাকার সেবাই দিব। আমি মনে করি সাদা এপ্রোনের ভিতর ভালো মানুষী রুপটা ছাড়ার সময় এসেছে। তেলবাজি, ধান্দাবাজি, গলাবাজী, দালালগিরি যেদিন আমাদের চিকিৎসক সমাজে বন্ধ হবে, সেদিন সমাজ, সরকার, জনগন ঠিক আমাদের মর্যাদা দিবে। সেদিনই আমাদের অধিকার আর শখ কে মানুষ আলাদা করা শিখবে। তখন আর সুরক্ষার জন্য সপ্তাহের দরকার নাই, সারাজীবনটাই সুরক্ষিত থাকবে! চিকিৎসকদের পরিবেশ নিয়ে ১০৯ টা পয়েন্ট লিখে রচনায় প্রথম হওয়ায় কোন আনন্দ নাই, নিজেদের মূল্য নিজেরা দেওয়া আর প্রতিহিংসার বদলে সিনিয়র জুনিয়র চিকিৎসকদের একতাই এই সমস্যার একমাত্র পরিত্রাণের পথ।
উল্লেখ্য, এবারের “নিরাপদ কর্মস্থল সৃষ্টি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের অন্যতম শর্ত” প্রতিপাদ্য কে সামনে রেখে বেশ কিছু এজেন্ডার উপর নজর দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে,
১. জনসংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসাকর্মী নিয়োগ এবং প্রয়োজনীয় লজিস্টিকস নিশ্চিতের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবাই আদর্শ মান আনয়ন।
২. স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইনের পাশ ও বাস্তবায়নে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ।
৩. ন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটি, স্বাস্থ্য পুলিশ, ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম গঠন সহ ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে মোবাইল কোর্ট নিশ্চিতকরণ।