“সকালে শেষবার যখন কথা হয় তখনো বাড়ির সবাই ভালো ছিলেন, জানিনা এখন কেমন আছেন। তবে পরিচিত অনেকেই আর বেঁচে নেই”-নেপালি বন্ধুটার চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেই চট করে। ২০-২৫জন নেপালি চিকিৎসকের জটলার পাশে দাঁড়িয়ে তখন আমি। কারো চোখের দিকেই তাকানো যাচ্ছে না। কেউ উত্তেজিত, কেউ হতাশ, কারো কারো শক, শোক বা ঘোর কাটেনি তখনো। কেউ মুঠোফোন হাতে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে আপন জনের ফোনের অপেক্ষায়। বিএসএমএমইউর ভিসি স্যারের রুমের বাইরে নেপালি রেসিডেন্টরা জড়ো হয়েছে নিজ দেশেই ইমার্জেন্সি মেডিকেল টিমের অংশ হয়ে যাবার জন্য। একদল এমব্যাসিতে যোগাযোগ করছে, আরেকদল ওষুধ-ফান্ড যোগাড়ের চেষ্টা করছে, ভিড় ঠেলে হঠাৎ হঠাৎ এক দুজন ব্যস্ত পায়ে মুঠোফোন হাতে একটু পাশে সরে আসছে-বিধ্বস্ত জনপদের কোন খবর এলো বুঝি। উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের একটিরও অর্থ জানিনা কিন্তু চোখমুখ থেকে ঠিকরে বের হওয়া দুশ্চিন্তা, শরীরী ভাষা বুঝতে পারছিলাম।“Nirob, we need medicine”-আংশু কুমার ঠাকুরের আর্তি আমাদের(প্ল্যাটফর্ম) কিছু করার সুযোগ করে দিল।
ঢাকা থেকে নিয়মিত ফ্লাইট বন্ধ, সড়ক পথে যাত্রা অনিশ্চিত, তবে যেভাবেই হোক তাঁরা নিজ দেশে যাবে। কারো পরিবার পরিজন নিখোঁজ, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে প্রতিবেশী, কেউ বা কাঠমান্ডু থেকে দূরে যেখানে বিদেশী মেডিকেল/উদ্ধারদল কখনোই পৌঁছতে পারবে না এমন দূর্গম জায়গায় যাবার পরিকল্পনা করছে। কিভাবে যাবে তাঁরা কেউ জানে না, শুধু জানে বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসক হয়ে খালি হাতে যাওয়া যাবে না, যতটা সম্ভব জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ নিয়ে যেতে হবে। “গতকাল থেকেই মা-বাবা খোলা আকাশের নিচে, বড় বোনের আড়াই বছর বয়সী ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নেপালের আবহাওয়া এখানে ঢাকার চেয়ে অনেক ঠাণ্ডা, ঢাকার মতোই পূর্বাভাস বলে বৃষ্টি শুরু হবে কয়েকদিনের মাঝেই”-আংশু হঠাৎ হঠাৎ একটানা কথা বলে যাচ্ছে। “মিডিয়ায় বলছে মৃত ২২০০র মত(২৬ এপ্রিল দুপুর) কিন্তু আসল সংখ্যা ১০,০০০ ছাড়িয়ে যাবে। আমাদের দেশে এমন কিছু এলাকা আছে স্বাভাবিক অবস্থাতেই যেখানে পৌঁছানো কঠিন-আর এখন ভেঙ্গে পড়া যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রায় অসম্ভব সে সব এলাকার ক্ষয়ক্ষতি অনুমান করা। যারা আহত তাঁদের চিকিৎসা করার মানুষ দরকার, আবার যারা সুস্থ খোলা আকাশের নিচে থাকছে তাঁদেরও যেন রোগ ব্যাধি না হয় খেয়াল রাখতে হবে। পানি, বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধ, এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিনের মাঝে অসুখ ছড়াবে। ইতিমধ্যে রেডক্রস, চীন, ভারত, পাকিস্তান উদ্ধার দল পাঠিয়েছে কিন্তু তাঁদের মাঝে কতজন ডাক্তার কে জানে।
“হিমালয়ের বেস ক্যাম্পে ভূমিকম্প, তুষার ধ্বস নেমে আসছে, আমি তাঁবু থেকে জীবন বাজি রেখে দৌড়াচ্ছি”
“প্রথমে ভেবেছিলাম আমার সহ-অভিযাত্রী দুষ্টামি করে তাঁবু নাড়াচ্ছে, কিছুক্ষণ পর দেখি মাটি কাঁপা দেখে বুঝতে পারি ভূমিকম্প হচ্ছে, তাঁবুর বাইরে এসে দেখি তিন দিক থেকে তুষার ধ্বস নেমে আসছে”
“ক্যাম্পগুলো ভূমিকম্পে এবং তুষার ধ্বসে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, আমরা সকল চিকিৎসকেরা আমাদের সেরাটা দেয়ার চেষ্টা করছি আহতদের চিকিৎসা দিয়ে জীবন বাঁচাতে”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভূমিকম্পের আগে পরে হিমালয় পর্বতারোহীরা এভাবেই নিজেদের অবস্থান জানাচ্ছিলেন(এখন পর্যন্ত ২২ জন পর্বতারোহী নিহত, নিখোঁজ অনেক)। ঠিক সে মুহূর্তেই নেপালের প্রাচীনতম এক মন্দিরে বৃদ্ধ পুরোহিত নিজের অজান্তেই জীবনে শেষ বারের মত “ওম” উচ্চারণ করছিলেন। শেষ নিঃশ্বাসের পর মানুষের অস্তিত্ব যেমন এক নিমিষেই শূন্যে বিলীন হয় তেমনি ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে নেপালের হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যগুলো ধুলোয় মিশে গেল কয়েক মিনিটেই। ১ মাস, ১ বছর, ১ যুগ পর নেপাল হয়ত ঘুরে দাঁড়াবে কিন্তু বিশ্ব সভ্যতার এই ক্ষতি পূরণ হবে না কখনো। যাদের ধারাবাহিক টুইট, শেষ স্ট্যাটাস বা ভিডিওপোস্ট নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় তোলপাড় তাঁদের বাইরে আরেকদল মানুষের জন্য আংশু কুমার ঠাকুরের কপালে চিন্তার ভাঁজ। বাংলাদেশের চৌদ্দগ্রাম বা নোয়াখালীর মত নেপালের বেশ কিছু অঞ্চল আছে যেখানে সকল পুরুষ প্রবাসী, এমনকি কর্মক্ষম নারীরাও মধ্য প্রাচ্য অথবা আমিরাতের শেখদের বাসায় গৃহকর্মী, নির্মাণশ্রমিক। সে এলাকায় শুধু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং তাঁদের শিশু নাতি-নাতনি। চিন্তা করে দেখেন আপনি যখন ভূমিকম্পের সেলফি তুলছেন তখন ঐ অঞ্চলের মানুষেরা কেমন ছিল? যে কোন দূর্যোগে সবচেয়ে দূর্বল জনগোষ্ঠী এই বৃদ্ধ-শিশুরা এখন কেমন আছে? কি অবস্থায় আছে?
টিভির সামনে উদ্বিগ্ন জোড়া জোড়া চোখ। শিলা কি জাওয়ানি বা আইপিএল না বিবিসি এবং সিএনএন, এনডিটিভি(ইন্ডিয়ান নিউজ চ্যানেল) অদলবদল করে দেখছে সবাই। নতুন কোন ফুটেজ, নতুন কোন অঞ্চলের সংবাদ পাওয়া যায় কিনা। কাঠমান্ডু এখন তাঁবুর শহর। ঘুরে ফিরে একই কাঠমান্ডুর ছবি, একই ধ্বংসাবশেষে মানুষের হাড় হাড্ডি খোঁজার দৃশ্য, একই ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের কার্গো বিমানে ঠাসা সাহায্য উপকরণ, নেপালের সাহায্যে ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ মিটিং এর অপ্রস্তুত লাইভ টেলিকাস্ট। নেপালি ডাক্তারদের চূড়ান্ত মিটিং যাবার ব্যাপারে। আংশু কুমার ঠাকুর রীতিমত ঠাণ্ডা ঝগড়া করছে সহকর্মীদের সাথে-“কাঠমান্ডুর বাইরে এমনও এলাকা আছে যেখানে ৯০% ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, আমরা এই ওষুধগুলো ব্যাকপ্যাকে করে যতটা পারি দুর্গম এলাকায় যাবো। এমন জায়গা আমি চিনি যেখানে শুধুমাত্র পায়ে হেঁটেই পৌঁছানো সম্ভব আমরা সেখানে চিকিৎসা দিতে যাবো। তিন থেকে পাঁচ দিন হাঁটতে হবে, বাই রোটেশন বিশ্রাম নিতে হবে”। আলোচনা বিতর্ক, এমব্যাসিতে যোগাযোগ, ব্যক্তিগত ও দলগত প্রয়োজনীয় গ্যাজেটের তালিকা তৈরি চলতে থাকে। বাইরের মানুষ হয়েও বুঝতে পারি ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি, পড়াশোনা(ব্লক ফাইনাল আসন্ন), সুবিধা, অসুবিধা, টানাপোড়েন সামনে চলে আসে। একপাশে মোবাইলে গেমস খেলতে থাকে একজন, কেউ কোন একটা অজুহাতে সান্ধ্যকালীন শক্ত পানীয় খেতে উঠে যায়, তাঁদের আচরণে কেউ ক্ষোভে ক্রোধে আত্মঘাতী ধোঁয়া কারখানা চালু করে। আংশু কুমার ঠাকুর বলতে থাকে-“THIS IS AN EMERGENCY SITUATION, THINK LIKE ARMY,ACT LIKE ARMY”। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে এক সন্ধ্যায় ফ্ল্যাশব্যাকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রাজাকারদের মুখোশ দেখতে পাই অচেনা কয়েক বিদেশীর মুখে। আজ বুঝলাম, মানুষ কখন নিজ দেশকে বেচতে পারে। স্বার্থে টান পড়লে একটু আগে যে মানুষগুলো আবার ভূমিকম্প হবে এই ভয়ে হাসপাতালের রোগীদের রাস্তার উপর চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বলে দুঃখিত হচ্ছিল তাদেরই তীব্র “চিকিৎসক এবং চিকিৎসা উপকরণের সংকট”-ব্রেকিং নিউজ স্পর্শ করে না।
২০১৪ সালে বাংলাদেশে ম্যালেরিয়ার একটা মিনি মহামারী হয়েছিল স্বাস্থ্যখাতের খোঁজ খবর যারা রাখেন জানার কথা। ২০১৩ সালে ম্যালেরিয়া রোগী যেখানে ২৬ হাজার ছিল সেখানে ২০১৪ সালে রোগী হঠাৎ করে ৪৬হাজার হয়ে যায়, রোগী মৃত্যুও তিন গুণ হয়। অনাকাঙ্ক্ষিত এই বাড়তি রোগীর চিকিৎসার জন্য বাড়তি ওষুধ আমাদের সরকারের কাছে ছিলো না। বেসরকারি খাত NGO, Pharmaceuticals, WHO কারো কাছেই ম্যালেরিয়ার ওষুধ মজুদ ছিলো না। বিশ্ব জুড়েই সেবার ম্যালেরিয়া বেড়ে গিয়েছিল। সে সময় পৃথিবীর একটি মাত্র দেশ নিজের রিজার্ভ ওষুধ বাংলাদেশকে দিয়েছিল। দেশটির নাম নেপাল। এই উপকার ফেরত দেয়ার সুযোগ আজ পেয়েছিলাম, হ্যাঁ আমরা আজ নেপালের জন্য ওষুধ যোগাড় করতে পেরেছিলাম। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি(এরিস্টোফার্মাকে ধন্যবাদ) থেকে আমরা(প্ল্যাটফর্ম) লাখ টাকার ওষুধ প্যাকেট করে নিয়ে এসেছি অনায়াসে। আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে একেকটা কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করছিলাম নেপাল দূতাবাসের রেফারেন্সে। পরবর্তিতে আমাদের কাজে কোম্পানীগুলোর সাড়া দেখে দূতাবাস নিজেই উদ্যোগী হয়ে প্রয়োজনীয় সকল ওষুধ বাংলাদেশের বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি থেকে যোগাড় করার ব্যবস্থা করে। ওষুধ হয়ত ম্যানেজ হবে কিন্তু চিকিৎসকের স্বল্পতা থেকে যাবে। যতদূর শুনেছি আমাদের সরকারি উদ্যোগে চিকিৎসক পাঠানো এখন প্রক্রিয়াধীন।
কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে রিলিফের বিমান অবতরণ করতে পারছিলো না ভূমিকম্পের আফটার ওয়েভের কারণে। আমরা বাংলাদেশে বসে যেখানে ২৫ তারিখ দু’বার ২৬ তারিখ একবার তিনবার ভূমিকম্প টের পেয়েছি সেখানে নেওয়াকে ২৫ তারিখ মোট ৭২ বার ভূমিকম্প হয়েছে। আয়তনে বাংলাদেশের প্রায় সমান নেপালের জনসংখ্যা তিন কোটি, যেখানে বাংলাদেশের জনসঙ্খ্যা ১৬কোটি(বয়স চুরির মত জনসংখ্যা কমিয়ে বলে)। এক ঢাকা শহরেই দু’কোটি লোকের বসবাস। বাংলাদেশে এমন এক দেশ যেখানে একই ফ্লাই ওভারের গার্ডার দু বার মানুষের মাথায় পড়ে মানুষ খুন করে, পুরান ঢাকার নিমতলির আগুনে ১১১ জন মানুষ জীবন্ত কয়লা হয়, রানা প্লাজায় ১১৩৪ মানুষ চাপা পড়ে থাকে, সেখানে ৭.৯ বা ৬.৭ মাত্রার একটা ভূমিকম্প ঢাকা শহরে হলে কি হবে? আমার নেপালী বন্ধুটি বা নেপালী ছাত্রীদের মত সৌভাগ্যবান (এখনো কারো পরিবারের কেউ নিহত হয়নি) কি আমরা হতে পারব?
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী বাংলাদেশী ৩৪ জন চিকিৎসক সরকারি উদ্যোগে নেপালে কাজ করছেন। নেপালের ২০ জন চিকিৎসক এবং মেডিকেল স্টুডেন্ট (আমাদের সংগৃহীত ওষুধসহ) নেপাল পৌঁছে গেছে ২৭/৪/২০১৫ তে , পরের দলটি রওনা হবে আগামী বৃহস্পতিবার।
https://www.facebook.com/reportedly/videos/1662050767347819/?fref=nf
ডাঃ মোহিব নীরব
:’-C
:'(