শিকড়
ডাঃ শাহেদ হায়দার চৌধুরী, বিএম-১, রেজিস্ট্রার(চক্ষু বিভাগ),বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সেন্ট্রাল কাউন্সিলর,বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন
বাড়ি নম্বর ৩৩, রোড নম্বর ১৪/এ,‘সবুর ভবন’ এই ঠিকানায় ২৭ বছর আগে একটি চারা গাছ জন্ম নেয়। কালের আবর্তে আজ সেটা রীতিমত বিরাট বটবৃক্ষ। মরহুম খান এ সবুর সাহেবের আবাসিক দ্বিতল ভবনে খুব ছোট্ট পরিসরে ১৯৮৭ সালের ১লা জুলাই বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ‘বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ’এর জন্ম। সর্বমোট ৬২৫ জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে যাচাই বাছাইকৃত মাত্র ৩৪ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে কলেজের যাত্রা শুরু হয়। যাদের নামকরণ করা হয় বিএম-১। দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসক তৈরির কারিগর অধ্যাপক ইউসুফ আলি, অধ্যাপক এম আই চৌধুরী, অধ্যাপক আবু আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক সি এইচ কবির, অধ্যাপক ফিরোজা বেগম, অধ্যাপক কে এ এ কমরুদ্দিন সহ আরো অনেক নিবেদিত মানুষের অক্লান্ত চেষ্টা আর স্বপ্নের ফসল হিসেবে বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হিসেবে বিএমসির আত্মপ্রকাশ হয়।
Anatomy dissectionএর জন্য dead body এর অভাব, Physiology-Biochemistry ডিপার্টমেন্টে রি এজেন্টের অভাব, পরবর্তীতে হাসপাতালে বেডের অভাব এবং শুরু থেকেই সরকারী মেডিকেল কলেজ ও বিএমএএর প্রবল বাধা আর সহযোগিতার অভাব ছিল। কিন্তু অভাব ছিল না আমাদের শেখার আগ্রহের আর আমাদের বাঘা বাঘা শিক্ষকদের শেখানোর আগ্রহ।
Gray’s সাহেবের যোগ্য উত্তরসূরি বারী স্যারের পড়ানো আমাদের অপরিপক্ব brain এর antenna এর অনেক উপর দিয়ে যেত প্রায়শই। কাজেই নীলুফার ম্যাডাম আর সরকার স্যারের বিখ্যাত বেতের সুশাসন আর নির্মম নিয়মের বেড়াজালে শেষ পর্যন্ত ‘টিকটিকির ডিম ভাঙ্গিয়া আমরা নাকাল হইলাম’ । নায়েব আলি স্যারের নায়েবী কায়দায় পড়ানো আর কিস্তি টুপির বাহারি নবাবী ব্যবহারে এবং ‘পড়ায় না পড়ে, নাকি শুধু পটায়’ ইত্যাদি কথার মারপ্যাঁচে Physiology’র fat metabolism আর Biochemistry’র total body water মিলে মিশে জীবন একাকার হয়ে যায়।বন্ধুসুলভ আনোয়ার ইব্রাহিম স্যার আর রায়হানা ম্যাডামের কাছে আইটেম পাশ করা সহজ ছিল। মেজবুন আরা ম্যাডামের non stop lecture এর যন্ত্রণায় (News at 8 am) শেষ মেশ আমাদের easy digestion হয়। 1st prof পরীক্ষায় আমাদের রাজু 1st, নাভেরা 5th, দোলন 7th position নিয়ে কলেজকে প্রতিষ্ঠা করতে অনেকখানি সহায়তা করে।
Pharmacology এর জোহা স্যারের কঠোর নিয়মনীতি আর Forensic Medicine এর সাদেক স্যারের শিশুসুলভ সরলতায় আমরা এগিয়ে যাই সামনের দিকে। মনে পড়ে একটু পড়া পারলেই সাদেক স্যার সরল হাসিতে বলতেন, ‘আমার ছেলেরা বেকটাই পারসে।’ খুব বেশি মনে পড়ে বিশালাকার সাত্তার স্যারের নিজস্ব গম্ভীর ভঙ্গীতে খুব কঠিন জিনিস গুলোকে সহজ করে পড়ানোর পদ্ধতি। Community Medicine এ খবির উদ্দিন স্যারের কাছে পড়া না পারলে Open threat, সেই সাথে এম ডি হোসেন স্যারের বাহারি স্বগক্তি আর আন্তরিক পড়ানোতে আমরা ধেই ধেই করে পাশ করে পঞ্চম বর্ষে উঠি। প্রিয় শারমিন ম্যাডামের কল্যাণে আমাদের আইটেম কার্ড বাকি থাকেনি কখনো।
Pediatric নুরুল হক স্যারের শিশুতোষ লালন পালন শেষ না হতেই মেডিসিনে কাদেরী স্যারের ভয়ংকর শাসনে জীবন যখন যায় যায়, তখন ফজলুল কাদির স্যারের অসাধারণ Methods of teaching এর কল্যাণে, জেনারেল আনিস ওয়াইয স্যারের মিলিটারি কায়দায় লেফট রাইট করতে করতে আমরা এগিয়ে যাই। মনে পড়ে রেজিস্ট্রার বারী স্যারের বগল দাবা করে হাজিরা খাতা নিয়ে দিক-বেদিক দৌড়াদৌড়ি। আবু আহমেদ স্যারের বিখ্যাত Voice এর তর্জন গর্জনে প্রায় সার্জন হয়ে গেছি ভাব নাকি ‘এই ইয়ার বাচ্চা’ হয়ে গেছি।
বাবা এরশাদ আলী স্যারের নেতৃত্বে মনোয়ারা আমেনা ম্যাডামের মাতৃসুলভ safe delivery এর কল্যাণে আমরা ডাক্তার হই। আরো মনে পড়ে হুসনা ম্যাডাম আর সুরাইয়া ম্যাডামের articulated pelvis আর কাপড়ের পুতুল নিয়ে delivery পড়ানোর মহড়া।
হাসান শহীদ স্যার ও আলাউদ্দিন স্যার যুগলদ্বয়ের বন্দনা করা সহজ ব্যাপার নয়। Smart নাফীস স্যারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আর পরীক্ষার সময় মোফাখখর স্যারের দৌড়াঝাঁপ সবই মনে পড়ে। মনে পড়ে আনিসুর রহমান স্যারের smart clean cut lecture আর শামসুল হক স্যারের viscera পড়ানো আর লাইব্রেরিতে বসে case discussionএর দিনগুলো।
STD রোগীদের সিরাজ স্যারের জিজ্ঞাসাবাদ করার কায়দা অনেক মনে পড়ে। তাইতো body র largest organ skin কে মফরে উদ্দিন স্যার ও সিরাজ স্যারের চেষ্টায় ছোট বানিয়ে, মাহমুদ হাসান স্যারের কল্যাণে সুস্থ আর পাগলের পার্থক্য বুঝে এমবিবিএস ডাক্তার হয়ে যাই। সবুর ভাই, শফি ভাই, তৈয়ব ভাই, সেলিম ভাই, ওসমান ভাই, বাসার ভাই, মঞ্জু খালা, পিয়ারা সিস্টার আমরা তোমাদের ভুলি কিভাবে?
অধ্যাপক ইউসুফ আলী, অধ্যাপক এম আই চৌধুরী, অধ্যাপক সি এইচ কবির স্যার আপনারা একটি ইতিহাসের রুপকার। এখনো আমরা আমাদের ব্যাচের ৩৫ জন ছাত্র অভিমানী অধ্যাপক এম আই চৌধুরী স্যারকে খুঁজে ফিরি। এইতো সেদিন ২০০৯ সালে প্রথম পূনর্মিলনীতে ঘোড়ার গাড়িতে অনেক দিন পর আপনারা চারজন এক সাথে উঠে বসলেন। তারপর শুরু হল বিশাল এক র্যালি। আবু আহমেদ স্যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শুধু হেসে বললেন, ‘তুই ভাল করছস’ র্যালি শুধু আবাহনী মাঠই প্রদক্ষিণ করেনি, সেদিন মনে হল পুরো বাংলাদেশকেই প্রদক্ষিণ করে জানিয়ে দিল ‘বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ’ এখন একটি বটবৃক্ষ, যার শিকড় অনেক গভীরে, অনেক মজবুত।
জয় হোক বিএমসির, জয় হোক সবার।