প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৪ অক্টোবর ২০২০, বুধবার
বাংলাদেশ থেকে জমা দেয়া ৩২৪ টি করোনাভাইরাস (সার্স-কভ-২) এর জিনোম বিশ্লেষণ করে এর মিউটেশনগুলোর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে গবেষণা প্রকাশ করা হয়েছে। ৩০ মার্চ থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে এই নমুনাগুলো সংগ্রহ করা হয়। গবেষণায় বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের জিনোমের মিউটেশনগুলোর সম্ভাব্য প্রভাব সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গিয়েছে, যা খুলে দিতে পারে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের দ্বার।
গবেষণার মূল ফলাফলগুলো নিম্নরূপঃ
১) ৩২৪টি জিনোম স্যাম্পলে মোট ৪১৬০ টি মিউটেশন ঘটেছে যার মাঝে আ্যমাইনো এসিড পরিবর্তনকারী মিউটেশন ২২৫৩টি, মুছে যাওয়া/ডিলিশন ৩৮টি এবং সংযোজন/ইনসারশন ১০টি।
২) অধিকাংশ মিউটেশনই C>T অর্থাৎ নিউক্লিওটাইড C থেকে পরবর্তিত হয়েছে T তে (৪১%)। এটি সম্ভবত সিলেক্টিভ মিউটেশন প্রেশারের কারনে, যেখানে ভাইরাসটি তার জিনোম থেকে CpG অংশগুলো সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে যেন এই অংশগুলোকে টার্গেট করে যেসব ইমিউন রিএকশন হতো ভাইরাসটিকে মেরে ফেলতে, সেগুলো কম হয়। এর ফলে সম্ভবত ভাইরাসটির বংশবৃদ্ধির হার বেড়ে যায়। তবে রোগ লক্ষণের তীব্রতাও কমে যায়।
৩) সবগুলো স্যাম্পলের মাঝে সবচেয়ে বেশি যে মিউটেশনগুলো হয়েছে সেগুলো হলো 241C>T (৯৬%), 3037C>T (৯৮%), 14408C>T (৯৮%) এবং 23403A>G (৯৭%)। এই মিউটেশনগুলো প্রায় একইসাথেই ঘটেছে এবং শেষের দুটি আ্যমাইনো এসিড চেঞ্জিং মিউটেশন (RdRp জিনে P323L এবং স্পাইক প্রোটিনে D614G)।
৪) দেখা গিয়েছে P323L মিউটেশন হলে ভাইরাসটিতে মিউটেশনের হার আরও বেড়ে যায়৷ D614G মিউটেশনটি সারা বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত। মূলত ইউরোপে ডমিনেন্ট হওয়া এই মিউটেশনটি বর্তমানে সারা বিশ্বেই মূল ধরণ (প্রায় ৭০% ক্ষেত্রেই এই মিউটেশনধারী ভাইরাসটি ছড়াচ্ছে)। বাংলাদেশে ৯৭% নমুনাতেই এই মিউটেশনটি আছে। মিউটেশনটির কারণে ভাইরাসটির বংশবৃদ্ধির সক্ষমতা বেড়ে যায় তবে কিছু গবেষণা অনুসারে জানা যায় বংশবৃদ্ধির সক্ষমতা বাড়লে বিপরীতক্রমে রোগের তীব্রতাও কমে। তবে D614G এর কারণে মৃত্যু হার বাড়ে না কমে এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোন প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
৫) এন্টিবডির মূল টার্গেট স্পাইক প্রোটিনের রিসেপ্টর বাইন্ডিং অংশটি। এ জায়গাটিতে বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত নমুনার কোনটিতেই কোন মিউটেশন ঘটেনি তাই আশা করা যাচ্ছে ভ্যাকসিন যে দেশ থেকেই আসুক তা এদেশে কাজ করবে (যদি আসলেই কার্যকরী ভ্যাকসিন কোন একটি পাওয়া যায়)।
৬) এছাড়াও দেখা গিয়েছে প্রায় ৮৬% নমুনাতে R203K, G204R মিউটেশন দুটি রয়েছে। এরা N প্রোটিনের স্ট্যাবিলিটি কমালেও সম্ভবত কোষ থেকে ভাইরাসের বের হওয়াতে সুবিধা তৈরি করে।
৭) ৫টি নমুনাতে ORF7a এবং ORF8 জিনের বড় অংশ মুছে গেছে। ORF7a প্রোটিন না থাকলে সম্ভবত ভাইরাসটি দ্বারা সৃষ্ট রোগের তীব্রতা কম হয় এবং ORF8 না থাকলে ভাইরাসটির আমাদের ইমিউন সিস্টেম দ্বারা চিহ্নিত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৮) এছাড়াও অনেকগুলো মিউটেশন B-Cell ও T-Cell এপিটোপ রিজিওনে হয়েছে যার ফলে হয়তো ইমিউন রিএকশনে পরিবর্তন হতে পারে। এছাড়াও আমরা RT-PCR টার্গেট এরিয়াগুলোতেও কিছু মিউটেশন পেয়েছি। এগুলোর কারণে RT-PCR ভিত্তিক ডায়াগনোসিসে কোন পরিবর্তন হয় কিনা সেটি গবেষণা সাপেক্ষ।
৯) ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশে সম্ভবত কয়েকবার কয়েকটি ভিন্ন জায়গা থেকে ভাইরাসটি এসেছে। ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসটি মূলত ইউরোপীয়ান ভ্যারিয়েন্টগুলোর সাথে সম্পর্কযুক্ত যা সরাসরি ইউরোপীয়ান দেশ বা মিডল ইস্ট হয়ে ইউরোপীয়ান দেশের স্যাম্পলগুলোর সাথে ক্লাস্টার তৈরি করেছে। নমুনাগুলোর প্রায় ৮৬% ই 20B ক্লেডভুক্ত যা ইউরোপে (ইউকে, বেলজিয়াম, সুইডেন) ডমিনেন্ট ছিলো। আশেপাশের দেশগুলোতে চিত্রটি এমন নয় (ইউরোপীয়ান ভ্যারিয়েন্ট এর আধিক্য এত বেশি না)। 19B ক্লেডটি যেটি মূলত চায়নাতে ডমিনেন্ট ছিলো সেটি শুধু চট্টগ্রামের ৫টি নমুনায় পাওয়া গিয়েছে। সম্ভবত চট্টগ্রামে চায়না থেকে ভাইরাসটি সরাসরি বা অন্য দেশ হয়ে কোনভাবে এসেছিলো।
এই গবেষণাপত্রটি এখনও পিয়ার রিভিউড হয়নি তাই এটিকে চূড়ান্ত বিবেচনা করা উচিত হবেনা। এই ফলাফলগুলোর উপরে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের গঠনমূলক পরামর্শের ভিত্তিতে গবেষণাপত্রটি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধন করা হবে।গবেষণাপত্রটি সবার জ্ঞাতার্থে বায়ো আর্কাইভে প্রকাশ করা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশের জন্য জমা দেয়া হয়েছে।
প্রি-প্রিন্ট লিংকঃ
https://www.biorxiv.org/content/10.1101/2020.10.12.336099v1.full.pdf+html
গবেষণাটি সম্পাদন ও গবেষণাপত্রটি লেখায় সহায়তা করেছেন দু’জন কো-অথর Roma Sharmin এবং Shahriar Rizvi। এছাড়াও মতামত দিয়ে উৎসাহিত করেছেন Dr. Senjuti Saha। গবেষণা কার্যটির পুরো অংশই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখাধীন Center for Medical Biotechnology বায়োইনফরমেটিক্স ল্যাবে সম্পন্ন হয়েছে।
মারুফুর রহমান অপু
ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (মেডিকেল বায়োটেকনোলজি)
এমআইএস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর