গত কয়েকদিন আগে ‘গ্লোবাল হেলথ কেয়ার একসেস এন্ড কোয়ালিটি ইনডেক্স’ নামে একটা জরিপের ফলাফল বেরিয়েছে। বিল এন্ড মেইন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এর অর্থায়নে এবং বিখ্যাত হেলথ জার্নাল দ্য লান্সেট এর পরিচালনায় এই জরিপে পৃথিবীর প্রায় ১৮৮টি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র উঠে এসেছে। ১৯৯০ সাল থেকে শুরু হওয়া এই গবেষনায় একই সাথে এই দেশগুলোর স্বাস্থ্য সেবায় কতটুকু উন্নতি হয়েছে তার চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে।
এবার আসা যাক এই জরিপে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়। বাংলাদেশ এর সর্বমোট অর্জিত পয়েন্ট ৫১.৭ সাউথ এশিয়ায় শুধুমাত্র ভূটান(৫২.৭) ছাড়া সকল দেশের চেয়ে বেশি। আমাদের পাশববর্তি দেশ ভারত(৪৪.৮) এবং পাকিস্থান(৪১.৮) পয়েন্ট নিয়ে আমাদের চেয়ে অনেক অনেক পিছিয়ে আছে। এখানে হয়তো মনে হতে পারে এই কয়েক পয়েন্টের ব্যাবধান আর এমন কি! কিন্তু ১৮৮ টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পয়েন্ট হলো ৯৫, সূতরাং এই কয়েক পয়েন্ট ব্যাবধানেই দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আমরা ভারত থেকে যোজন যোজন এগিয়ে, পাকিস্থান থেকে তো অবশ্যই।
মজার ব্যাপার হলো ভারতের গনমাধ্যম ব্যাপারটাকে বেশ গুরুত্বের সাথে প্রচার করছে। তারা এটা মেনে নিতেই পারছে না যে ভারত বাংলাদেশ থেকে এতো গুরুতবপূর্ণ একটা খাতে এতো পিছিয়ে আছে। কিন্তু আমাদের মিডিয়ায় এটা নিয়ে খুব একটা লেখালেখি হয় নি। দুই একটা অনলাইন পত্রিকায় ছোট করে লিখেছে, তাও আবার টাইমস অব ইন্ডিয়ার রিপোর্ট পুরো কপি করে! তারা এটা খেয়ালই করেন নি যে টাইমস অব ইন্ডিয়া ভারত কেন এতো পিছিয়ে আছে সেটার উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করছে। ১৯৯০ সাল থেকে বাংলাদেশ যে সবাস্থ্যখাতে ক্রমাগত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা প্রচারের কোন দরকার আছে বলে মনে করে না বাংলাদেশের বেশিরভাগ গনমাধ্যম। কিন্তু ক্রিকেটে বাংলাদেশ ভারতের সাথে এক রানে জিতলেও প্রায় সব পত্রিকার শিরোনাম থাকে সেটা,টিভিতে আলাদা প্রতিবেদন থাকে। তারা মোটামুটি এটা প্রমান করে ফেলতে চান যে ভারত আমাদের জাত শত্রু। কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে পরিষ্কার ব্যাবধানে হারানোর পরও সেটা শিরোনাম তো দূরের ব্যাপার,শেষপাতায়ও আসে না!
এর পেছনে কারন কি? ক্রিকেটের বা শোবিজের নিউজের মত এসব নিউজ পাঠক ‘’খায় না’’ সমস্যা না সমস্যা আরো গভীরে? নাকি ভারতের স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক খারাপ তা প্রচার করলে ভারতের ব্যাবসায় সমস্যা হবে যা বাংলাদেশে তাদের ব্যাবসায়িক প্রচারনাকারি কতিপয় মিডিয়ার জন্যেও অর্থনৈতিক ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়াবে? সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে চিকিৎসক-রোগীর মধ্যে যে অনাস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে কতিপয় মিডিয়ার ভুমিকা অনেক বড়। আপাত দৃষ্টিতে শুধুমাত্র কথিত ‘ভূল চিকিৎসায় মৃত্যুর’ নিউজ ছাপালেও জনগনের মনে সেটার সূদুরপ্রসারী একটা নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে ফেলে দিয়েছে যার ফলশ্রুতিতে অনেক মানুষ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। অথচ, দ্য ল্যান্সেট এর মতো বিশ্বখ্যাত একটি জার্নাল ২৬ বছরেও বেশি সময় ধরে গবেষণা চালিয়ে এটা দেখিয়ে দিয়েছে যে আসলে কোন দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো। কিন্তু আমাদের বেশিরভাগ গণমাধ্যম এব্যাপারে মুখ বন্ধ করে রাখা বা দেখেও না দেখার ভান করে চলছেন, যা এ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় জড়িতদের জন্যে এবং সাধারণ মানুষের জন্যে অন্ত্যন্ত হতাশাজনক। দুটো তথ্য জেনে রাখলে ভালো হয়। ভারতে মেডিক্যাল ট্যুরিজম থেকে বর্তমান আয়ের পরিমান ৩ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২৪০ বিলিয়ন টাকা! তাদের ২০২০ সালের এই খাত থেকে আয়ের টার্গেট হলো ৮ বিলিয়ন ডলার। ভারতে কোন দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রোগী মেডিক্যাল ট্যুরিজমে যায় জানেন? জি, বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশ আর আফগানিস্থান তাদের সবচেয়ে বড় গ্রাহক। তারা তাদের দেশের জনগনের সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে না পারলেও শুধুমাত্র মার্কেটিং আর অন্য দেশের কিছু মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে স্বাস্থ্য খাতেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছে।
শুরু করেছিলাম দ্য ল্যান্সেট এর রিপোর্ট দিয়ে। গত ২৬ বছরে দেশের স্বাস্থ্য সেবার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। শুধু ল্যন্সেটের এই রিপোর্ট না, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ সরকার যতোগুলো বড় আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পেয়েছে তার বেশিরভাগই স্বাস্থ্য সেবায় সাফল্যের জন্যে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা(WHO) প্রায়ই বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যে স্বাস্থ্য খাতে মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করে। এই ব্যাপারটা আমাদের মাথায় রাখা উচিত যে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো সীমিত সম্পদের মধ্যেই সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা। ভারতে ধনীরা ঠিকই চিকিৎসা পাচ্ছে কিন্তু তাদের দেশের একটা বিরাট জনগোষ্টির জন্যে যে প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসাও ধরাছোয়ার বাইরে সেটা এই রিপোর্ট দেখলেই বোঝা যায়।
আমরা মনে করি আমাদের বেশিরভাগ গণমাধ্যমই এদেশের মানুষের উপকারের জন্যে কাজ করে যাছে। আমরা বিশ্বাস করি, কতিপয় দৃশ্যমান মুনাফাভোগী গনমাধ্যম যেভাবে দেশের ক্রমাগত উন্নতির দিকে ধাবমান একটি জনগুরুতবপূর্ণ খাতকে পিছন ধরে টেনে রাখার চেষ্টা করছে তা অন্যান্য দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমী গনমাধ্যম হতে দিবে না বরং তারা সত্য তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতেন স্বাস্থ্যখাতকে কিভাবে আরো গনমুখী করা যায়, দেশের সাধারন মানুষকে কিভাবে আরো বেশি সেবা দেয়া যায় সেসব বিষয়ে আলোকপাত করে বাংলাদেশের সাধারন মানুষের উপকারে কাজ করে যাবেন।
লেখক ঃ ডাঃ কামরুল ইসলাম শিপু
Photo by Paul Joseph Brown