বুধবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২০
আজ মোবাইল কোর্টে গিয়েছিলাম। টার্গেট ছিলো স্পেন ফেরত প্রবাসীকে মোটা অংকের জরিমানা করা। আগে থেকেই খবর ছিলো যে তিনি হোম কোয়ারেন্টাইন মানছেন না। যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন।শ্বশুর বাড়ী বেড়াচ্ছেন।আমাদের কর্মীদেরকে বলা ছিলো আগে থেকেই। তারা সঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে আমাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা স্পেন প্রবাসীর শ্বশুর বাড়ী নিয়ে গেলো। সেই প্রবাসী তখন ঘুমাচ্ছিলেন। ডাক শুনে রুম থেকে বের হয়ে এলেন। সদ্য মধ্যবয়স পেরুনো মানুষটির চোখেমুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট। প্রচন্ড শারীরিক পরিশ্রমের পরে শিক্ষিত মানুষেরা যেভাবে নেতিয়ে পড়ে তাঁকে দেখে তেমনটিই মনে হলো। ইউরোপ ফেরত যুবকদের মুখে যেরকম উজ্জ্বলতা লেগে থাকে তার ক্ষেত্রে সেটি অনুপস্থিত।
মুখে মাস্ক নাই, তার স্ত্রী যেভাবে ডাকতে যাচ্ছিলেন তা দেখে মনে হয় তিনি এই রুমে আসা যাওয়া করে অভ্যস্ত। সর্ব সামনের একটি রুমেই তিনি অবস্থান নিয়েছেন। তাকে চার্জ করার পরে তিনি বললেন তিনি কোন নিয়ম ভাঙ্গেন নি। সবই মেনে চলেছেন।শুধু গতকাল শেভ করতে বাজারে গিয়েছিলেন।তিনি হোম কোয়ারেন্টাইন সম্পর্ক সব জানেন।
হায়রে জানার বহর! তিনি যদি করোনা বাহক হোন তবে নিশ্চয়ই কয়েকশোজনকে ইতিমধ্যে সংক্রমিত করেছেন। পরিবারকে তো দিচ্ছেনই। বৃদ্ধ শ্বশুর শ্বাশুড়ী আক্রান্ত হয়ে পরপারে গেলে তার যুবতী স্ত্রী নিশ্চয়ই তাকে ক্ষমা করবেন। ইউএনও মহোদয় জরিমানার চিন্তা করলেও নিশ্চয়ই এই হতাশাভরা চেহারা দেখে শুধুই সতর্ক করে ছেড়ে দিয়েছেন।আল্লাহমালুম তিনি কাকে রক্ষা করবেন কাকে নিজের কাছে ডাকবেন। তার চেহারা দেখে আমরা অন্তত আবেগী হয়েছি।
এর পরের জন ছিলেন দুবাইফেরত। তার বাড়ীতে গিয়ে তার দেখা পাইনি। তিনি ঢাকা গেছেন বন্ধুত্বের ঋন শোধ করতে। বন্ধুদের দেওয়া জিনিসপত্র পরিবারকে বুঝিয়ে দিতে গিয়েছেন। আলাদা ঘরে থাকছেন বটে তবে সেটিও স্ত্রীর শারীরিক সমস্যার কারনে। সম্ভবত এক বা একাধিক সন্তান তার সঙ্গী হচ্ছেন। আর যিনি ঢাকা যেতে পারেন তিনি সবই পারেন। করোনাকে করুনা করতে পারেন। হাজার জনকে করোনা উপহার দিতে ও পারেন। কে জানে এটিই তাদের জীবনের শেষ উপহার কি না! আমরা সবাইকে ডেকে সচেতন করে কার্য শেষ করলাম।আর কিইবা করতে পারি।
আমাদের তৃতীয় টার্গেট ও ছিলো স্পেন প্রবাসী।আমরা গিয়ে একেবারে হাতেনাতে হোম কেয়ারেন্টাইন অবস্থায়ই পেলাম। বসতঘরের মূল ঘরে তিনি কাজ করছেন। বাচ্চাকাচ্চা ঘরেই আছে, মা, স্ত্রী, শ্যালিকা সবাই আছেন। ছোট্ট দুধের শিশু তার। শালিকা, বধু সবাই একসাথে মিলেই কাজ কিংবা গল্প করছিলেন মনে হয়।
আমরা যখন ডাক দেই তখন খালি গায়ে খুব সহজেই বাইরে চলে আসছিলেন। আমরা তাকে ইশারায় থামালাম ঘরের বারান্দায়। এটা আসলে রিফ্লেক্স। যে লোক যেভাবে অভ্যস্ত তার প্রকাশ সে করবেই। তিনি ঘরবাড়ি, রাস্তা, বাজার সব জায়গায়ই যান কাজেই এখন বেরুবেন এটাই স্বাভাবিক। বাই চান্স তিনি বাড়ীতে আছেন। তিনি ও দাবী করলেন যে হোম কোয়ারেন্টাইন সম্পর্কে তিনি ডিটেইলস জানেন। ওগুলো এয়ারপোর্ট এ শিখিয়ে দিয়েছে এবং তিনি পুরোপুরিভাবে মেনে চলছেন।তার স্ত্রী, মা তার সাথে তাল মিলালো। কি নির্জলা মিথ্যাচার? তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। অনেক আগে থেকেই তারা ধনী এবং উচ্চ বংশীয় ও। পুরনো দামী ঘরগুলো তারই প্রমাণ দিচ্ছে। তার সচেতনতার লেভেল নিজ চোখেই দেখলাম।
আমাদের শেষ টার্গেট ছিলো আরেক স্পেন ফেরত প্রবাসী। তিনি নামাজ পড়ার জন্য অযু করে আসলেন মাত্র। তার সাথে ফোনে কথা বলেছিলাম দুইদিন আগে। তার লক্ষন ছিলো টিপিক্যাল করোনার। আমাদের স্যাকমো একজন তাকে দেখেছে। সে যখন আমার সাথে ফোনে কথা বলে তখন গাড়ীর হর্নের শব্দ হচ্ছিলো। প্রশ্ন করলে সে সত্যিটাই বলে যে সে বাইরে মাকে নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে।
তারপর একই বাড়ীতে আরেকজন দুবাইফেরত যুবককে চার্জ করি। তিনি একটি ঘর থেকে দরজা খুলে উকি দিলেন। ঘরের শ্রী বলে এখানে কেউ থাকেন না। সব মেনে চলছে জানালেন। আমার স্বাস্থ্য কর্মী জানালো তারা কোন কথা শুনেনা এবং বাজারে নিয়মিত যায়। আমাদেরকে দেখে সে বাইরে থেকে ঘরে এসে ঢুকে। বাইরে সে ঘোরাফেরা করছিলো। আমরা চিনিনি তাই রক্ষা।
আজকের শেষজন সিঙ্গাপুর ফেরত। তিনি আলাদা ঘরে একদম গোছানোভাবেই থাকছেন। বিছানাটা একদম পরিপাটি। বাইরে থেকেই সব দেখা যায়। আসলেই এই ঘরে মানুষ থাকে। অবশ্য বিছানা দেখে মনে হয় দুইজন থাকেন। নতুন বাল্যবধু আর কোথায় থাকবেন! বৃদ্ধ মা-বাবা ভিটিপাকা ঘরের বারান্দায় বসে আছেন। তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবছি সোনার ছেলেটা যদি করোনার বাহক হয় তবে নিশ্চয়ই উনাদের পাশে আজরাইল ঘোরাফেরা করবেন। উনারা হোম কেয়ারেন্টাইন না বুঝলে ও এটি বুঝেন যে ডাক্তারতো কতো কথাই বলবে!! সব কি শুনতে হয়?
কারোরই কোন গা নেই, যে যার মতো চলছে। এদেশের কোন নিয়ম তাদের স্পর্শ করে না। সম্ভবত ওরা মনে করে এদেশে চলে ডাইরেক্ট কেন্দ্রীয় শাসনে মানে আল্লাহর দ্বারা আর অন্য দেশের জন্য ওই জাতির প্রতিনিধি থাকে। বিদেশে নিয়ম মানতে মানতে বিরক্ত হয়ে এখানে এসে নিয়ম না মানার প্রতিযোগীতা শুরু হয়। সম্ভবত সুযোগ থাকলে তারা নিয়ম না মানার প্রতিযোগীতা আয়োজন করতো এবং পুরষ্কার দিতো। এতে হয়তোবা ক্রীড়া মন্ত্রী প্রধান অতিথি ও হতে পারতেন। গনতন্ত্র বলে কথা। এক লক্ষ চোর একজোট হয়ে চুরির দাবী জানালে নেতারা এটি বিবেচনার আশ্বাস দিবেন। লাঠিপেটা করতে পারবেন না। কারন ভোটের রাজনীতিতে তাদের ও সাধুর সমান ভোট।
কারোরই এটাচড বাথ নেই। সবাই যে কোনভাবেই হোক বাইরে বের হতেই হয়। আর যার এটাচড বাথ আছে সে শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে বাইরে বের হয়। বিদেশের গল্প করতে বের হয়। তার গল্পের শ্রোতার অভাব হয় না। গল্প শেষে ফ্রীতে চা ও মিলে। ফ্রি জিনিসের কি যে কদর এখানে! চারটা ওরস্যালাইন ধরার জন্য একবার পাচজন পানিতে লাফ দিয়ে পরেছিলো শুকনো কাপড়চোপড়সহ। মোট দশটাকা দাম ছিলো এগুলোর। আমি শুধু বলেছিলাম পাঁচটা ওরস্যালাইন আছে, আমি ঢিল দেই আপনি ধরেন।অনুমানটা বুঝতে পারিনি তাই নদীর পাড়ে না পড়ে পানিতে পড়েছিলো। বাকিটাতো জ্বলন্ত ইতিহাস ।
যাদের বাড়ীতেই আমরা গেলাম তারা সবাই মোটামুটি শিক্ষিত। অশিক্ষিত হলে মনে কোন কষ্ট হয়তো থাকতো না। আমাদের আসল সমস্যা আমাদের শিক্ষায়। আমরা কষ্ট করে যে সার্টিফিকেট গুলো নেই তাতে শিক্ষিত তৈরী হয়না, একগাদা শয়তান তৈরী হয়। এই শিক্ষা আমাদের ভয়ংকর করে তুলে। কারন যে শিক্ষাক্রম শিখানো হয় এটি শুধুই সার্টিফিকেট সর্বস্ব। এটিকে বলবো অল্পশিক্ষা।আর কথায় আছে অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী। তাই এখন আমরা এসব দেখছি। মানুষের আচার আচরণ, কর্ম, বর্ম, দায়িত্ববোধ, দেশপ্রেম কিছুই থাকে না এতে।আমরা ও শিক্ষার নামে আমাদের সন্তানদের নবাবজাদা বানাতে যাই যারা কোন কাজ করবে না। যদি ও নবাবজাদারা খুবই পরিশ্রমী এবং শানিত যোদ্ধা থাকতেন। কিছুমানুষ কষ্ট করে স্বশিক্ষিত হয়।তারাই এদেশটাকে টিকিয়ে রাখে। যে শিক্ষা দেশের মানুষের প্রতি, আত্মীয় স্বজনের প্রতি দায়বদ্ধতা শিখায় না তার দরকার কি? এজন্যই এদেশে পিএইচডি ডিগ্রী নেই আমরা অন্যের থিসিস চুরি করে। স্বশিক্ষিতরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও সচেতন হয়।
আজ যাদের কাছে আমরা গেলাম তাদের প্রত্যেকের যদি করোনা থাকে আর কারো দরকার আছে কি সারাদেশে ছড়ানোর জন্য? এখনতো মাঝেমাঝেই মনে হয় উত্তর কোরিয়ার সাইকো লোকটাই পারফেক্ট ছিলোনা আমাদের এই আজব প্রবাসীগুলোর জন্য! কারফিউ বা লকডাউন বা অন্য যে কোন নামে ও যদি আমরা নামি সফলতা কি পাওয়া যাবে? আমি কোন পথ পাচ্ছি না।ছয়জনই যদি এটুকু পারে এ উপজেলার আরো ৯০০ জন কি করবে এই মাসেই যারা দেশে নেমেছে!যারা আরো আগে করোনা নিয়ে এসেছে তারা কি করেছে আল্লাহ জানে!!!
একটি যুদ্ধে জয়ী হতে গেলে কঠোর মনোবল এবং সাহসী সৈনিক প্রয়োজন হয়। আমরা সবাই এই রনাঙ্গনের যোদ্ধা। আমরা কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য পরিবার পরিজন সব ছেড়ে বসে আছি আর আমাদের সৈনিকরা পরিবার পরিজন নিয়ে বিরোধী শক্তির সাথে কোলাকুলি করছে।আমাদের জেনারেলগণ গত আড়াই মাস চিন্তা করেছেন কিভাবে অতিসহজে শত্রু সেনাদের দেশের ভিতরে প্রবেশ করার সুযোগ দেয়া যায়। শেষসময়ে যখন আমরা মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু করলাম তখন জানলাম আমাদের ঢাল তলোয়ার ও সীমিত। তাই এখন সেনাবাহিনী এনে প্রবেশ গেইট সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন। আর ফলাফল তো বুঝতেই পারছেন। সব কমান্ডার এবং মিডলেভেলের অফিসারগন আহত নিহত হবেন। আচ্ছা আমাদের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা যারা এমনটি করেছেন তাদেরকে পরবর্তী জেনারেশন কি নামে ডাকবেন?
লেখাঃ ডা. মোহাম্মদ আল-মামুন
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বাঞ্ছারামপুর