#প্লট_১
প্রায় বছর খানেক আগের কথা।আউটডোরে পেশেন্ট দেখছিলাম।মাঝবয়সী এক পেশেন্ট প্রেসক্রিপশন নিয়ে রুমে ঢুকলেন, কাগজের উপর ডায়াগনোসিস লেখা #COPD (সহজভাবে বললে ব্রঙ্কাইটিস, যদিও ব্যাপারটা এত সহজ নয়)।
চিকিৎসা চলছিলো, এরপরও আবার কেন আসলেন জিজ্ঞেস করাতে বললেন, এতদিন রোগটা কন্ট্রোল এ ছিল, এখন কন্ট্রোল এর বাইরে চলে যাচ্ছে, কাশিটারও পরিবর্তন হয়েছে।শর্টকাট Examination করে হাতের আঙুলে কিছু খারাপ সাইন পেলাম( #Clubbing)।
COPD এর সাথে Clubbing খুব সুবিধার জিনিস না।চিন্তিত হয়ে রক্তের কিছু পরীক্ষা ও বুকের এক্সরে দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব রিপোর্ট নিয়ে আসতে বললাম ।পেশেন্ট যারপরনাই বিরক্ত হলো।
দরজা পেরিয়ে বাইরে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের বললেন, “ওষুধ না দিয়া পরীক্ষা ধরায় দিচ্ছে, সব কমিশন খাওনের ধান্ধা”…..
পেশেন্ট মাস ছয় পরে ঠিকই এসেছিল, হাতে ছিল সদ্য করা এক্সরে প্লেট।ফুসফুসের ক্যান্সার তখন এমন অবস্থায় পৌছেছে, যেখানে আমার তেমন কিছুই করার ছিলো না….
#প্লট_২
চেম্বারে এক ফিমেল পেশেন্ট দেখছিলাম, তার কমপ্লেন-প্রেসার কন্ট্রোল হচ্ছে না, হাত পায়ের চামড়াও নাকি শক্ত শক্ত ঠেকে।
আমার ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস ছিলো #Systemic_Sclerosis(এক ধরণের Connective tissue প্রবলেম), অন্য কয়েকটি রোগও(Differential diagnosis) মাথায় ছিলো। রক্তের কিছু পরীক্ষা সহ #ENA panel( একটি গুরুত্বপূর্ণ লজিক্যাল investigation, Extractable Nuclear Antigens) করতে BSMMU যেতে বললাম, জানালাম ENA panel টা করতে ২৫০০ টাকার মত লাগতে পারে।
রোগী আর আসলো না, আমার সহকারী কাম ফার্মেসী মালিক পঙ্কজ জানালো এত টাকার ইনভেস্টিগেশনের কথা শুনে রোগী পার্শ্ববর্তী এক ডাক্তারকে দেখিয়েছে।রোগী হাতছাড়া হচ্ছে, তাই পঙ্কজও আমার উপর নাখোশ….
কতদিন পর তা Exact মনে নেই, তবে পেশেন্ট এরপর এসেছিলো তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে। অতিরিক্ত বুঝদার এই পেশেন্টকে আবার আমি BSMMU রেফার করেছিলাম। আমি বুঝেছিলাম, Systemic Sclerosis রোগটি এবার তার কালো হাত তার ফুসফুসের দিকে প্রসারিত করেছে।
#প্লট_৩
পেশেন্ট এর পায়ে Sensory disturbance. রক্তের কিছু পরীক্ষা, স্পেসিফিক্যালী OGTT( ডায়াবেটিস এর কনফারমেটরী টেস্ট) দিয়েছিলাম।রোগী পরীক্ষা করাতে অপারগ, কয়েকবার নাকি ফার্মেসীর দোকানে গিয়ে আঙ্গুলে ফুটো করে চেক করিয়ে বুঝেছেন তার ডায়াবেটিস নেই, একটা ইনভেস্টিগেশনের কাগজও বের করলেন, যেখানে ডায়াবেটিসের জন্য RBS (random blood sugar) ও Serum creatinine( এক ধরণের কিডনী পরীক্ষা) করা, দুটোই নরমাল হওয়ায় উনি আর পরীক্ষা করতে নারাজ, আমার ডাক্তারী জ্ঞান নিয়ে কিঞ্চিত সন্দেহ প্রকাশও করলেন, হয়ত মনে মনে “শালা কমিশনখোর” বলে গালিও দিলেন।সাময়িক ওষুধ নিয়ে বিদায় হলেন…..
একটা কথা না বলে পারছি না।উন্নত বিশ্বে এই কমপ্লেন করলে Battery of investigations কাকে বলে তা হাতে কলমে রোগীকে বুঝিয়ে দেয়া হত।মেডিসিনের বিখ্যাত বই #Davidson’s Principles and Practice of Medicine –এ ধরণের কমপ্লেন এ প্রাথমিকভাবে ১০ টি, আই রিপিট, ১০ টি investigations এর কথা বলা হয়েছে, নেগেটিভ হলে আরও ৬ টি investigations এর কথাও উল্লেখ রয়েছে।আমাদের দেশে কেউ কি একথা বিশ্বাস করবেন? একথা কল্পনাও কি করেন তারা?
যাই হোক, ঘটনায় আসি, রোগী আবারও এসেছিলো অনেকদিন পরে।OGTT করে কনফার্মড ডায়াবেটিস ডায়াগনোসড্ হয়ে, ততদিনে যুগপৎ হামদর্দী চিকিৎসা ও ডায়াবেটিস কিডনীর সাড়ে ১২ টা বাজিয়েছে….
#অতি_চালাকের_গলায়_দড়িঃ
এদেশের মানুষের মানসিকতাটা অদ্ভুত।এরা পুলিশের কাছে গিয়ে ত্বরিত গতিতে মানিব্যাগ খুলবে, উকিলকে ৩০,০০০ টাকা দিয়ে মামলা স্টার্ট করতে কুণ্ঠিত হবে না, ভূমি অফিসে যাবার আগে পকেট টাকায় ভর্তি আছে কিনা তা চেক করে নিবে, ঈদের মার্কেটিংয়ে ৫০০০ টাকার পণ্য খুশিমনে ১০০০০ টাকায় কিনে নিয়ে আসবে, রেস্টুরেন্ট এ নির্দ্বিধায়, বিনাবাক্যব্যয়ে ৫০০০ টাকা বিল পে করবে কিন্তু চুলকানী শুরু হবে চিকিৎসকের কাছে আসলে।এদের প্রথম হাঁসফাঁসটা শুরু হবে চিকিৎসকের ভিজিট দিতে গিয়ে, তার উপর যদি চিকিৎসক Logical investigation দেন, তবেই হয়েছে, দরজা পেরিয়ে “শালা কমিশনখোর কসাই” বলতে বিন্দুমাত্র দেরী করবে না। আমার অভিজ্ঞতা বলে–“অতি চালাকের গলায় দড়ি” প্রবাদপ্রবচন গুলো এদের ক্ষেত্রেই বেশী ফলে….
#নপুংসকঃ
কোন চিন্তা ভাবনা না করে, শুধুমাত্র Pre-occupied ধ্যান ধারণার উপর ভিত্তি করে ডাক্তারদের দোষারূপ করার লজিকটা কোথায় তা আমি ঠিক বুঝি না।এটা কি ডাক্তার হতে না পারার গ্লানির বহিঃপ্রকাশ, নাকি কিছু ডাক্তার এদেশে ভালোভাবে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে–সেটা দেখে জ্বলুনি? আমি স্বীকার করি, কিছু চিকিৎসক মানসিকভাবে অসুস্থ, এরা বিপথগামী।এদের নিয়ে আমি পূর্বেও কড়া ভাষায় লিখেছি।কিন্তু এদের সংখ্যাটা বেশী নয়।কয়েকজনের কারণে সমগ্র চিকিৎসক সমাজের উপর আস্থা হারানোটা কি যুক্তিযুক্ত? সাধারণ জনগণ কেন আসল জায়গায় আঘাত করছে না?–কেন তারা আইনপ্রণেতাদের দিয়ে আইন করে কমিশন ব্যাপারটাকে নিষিদ্ধ করতে পারে না? আসল জায়গায় হাত না দিয়ে এই #নপুংসকদের_অমৃতবচন “কমিশনখোর কসাই” বলাটা আর কতদিন চলবে?
#দিন_বদলাইছে_না! ঃ
এখন তো যেদিকে চোখ যায় সেখানেই দেখি আধুনিকতার ছোঁয়া।আগেরকালের জামানায় একটা কথা খুব প্রচলিত ছিলো–‘ অমুক ডাক্তার তো চেহারা দেখেই রোগ ধইরা ফালায়’…
আমরাও ধরতে পারি, কিন্তু এখন তা ইনভেস্টিগেশন এর মাধ্যমে কনফার্ম হতে হয়, আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিলো অপ্রতুল, এখন ইনভেস্টিগেশনগুলো হাতের মুঠোয়।চেহারা দেখে রোগ সাসপেক্ট করে চিকিৎসা শুরু করাটা এখন বোকামী, প্রমাণ হাতে থাকতে হবে, বিপদে পড়লে আপনার হাতের কারিশমার কথা কেউ মনে রাখবে না।চেহারা দেখে ডায়াগনোসিস তো অনেক সময় আবার মিসলিডিং ও।Over weight রোগী দেখে Hypothyroid সাসপেক্ট করে ইনভেস্টিগেশন করে দেখি রেজাল্ট Hyperthyroid এর, সম্পূর্ণ উল্টো। পরে বই খুলে দেখি- Hyperthyroid এ ১০% ক্ষেত্রে এরকম #Paradoxical_weight_gain হতে পারে। কাজেই চেহারা দেখে রোগ ডায়াগনোসিস ও ওষুধ দেয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত তা বিবেচনার ভার আপনাদের উপরই ছেড়ে দিলাম।
#Medicolegal_issueঃ
বাঙালির পাকনামো সম্পর্কে আমি যথেষ্ঠই ওয়াকিবহাল।আমি কোন স্পেসিফিক ডিজিজ সাসপেক্ট করছি, তার জন্য ইনভেস্টিগেশনও দিয়েছি, কিন্তু পেশেন্ট করাবে না–আমি এক্ষেত্রে Prescription এ লিখে রাখি–“I had advised these investigations, but patient denied to do so”….পরে যদি দেরীতে অন্য কোন ডাক্তারের কাছে টার্মিনাল স্টেইজে এসে মারাত্মক রোগ ডায়াগনোসিস হয় তবে কিন্তু এই বাঙাল জাতি আপনাকে ছেড়ে কথা বলবে না, Medicolegal issue টা মাথায় রাখা ভালো।
#আত্মসমালোচনাঃ
এবার নিজেদের দিকে একটু নজর দেই।আমাদেরকে এক স্যার বলেছিলেন,’ যে ইনভেস্টিগেশন দিবে, মনে রাখতে হবে সেই প্রতিটা ইনভেস্টিগেশনের পিছনে #Rational_Logic থাকতে হবে’…মেডিসিনের বাইবেলখ্যাত #Harrison’s Principles of Internal Medicine এর তৃতীয় পৃষ্ঠার একটা লাইন বলি, “A skilled physician must learn to use these powerful diagnostic tools judiciously, always considering whether the results will alter management and benefit the patient…..” আমি বিশ্বাস করি অধিকাংশ চিকিৎসক তাদের মনে এই কথাগুলো লালন করেন…
#একটি_Hypothesis_ও_পরিসমাপ্তিঃ
শেষ করি আমার নিজস্ব একটা Hypothesis দিয়ে–‘এ বসুন্ধরার বুকে যে মানবসন্তানগুলো বিচরণ করে তাদের অধিকাংশই সত্য ও সুন্দরের পিয়াসী’….
আমার এ Hypothesis- প্রতিটা সেক্টরের প্রতিটা পেশায় নিয়োজিত মানব-সন্তানের জন্যও প্রযোজ্য।চিকিৎসকরাও এর ব্যতিক্রম নন।মনে রাখতে হবে, চিকিৎসকরা এই সমাজেরই অংশ। আপনারা সব সাধু আর চিকিৎসকরা সব অমানুষ–এটা অবান্তর।চিকিৎসকদের উপর আস্থা রাখুন, বিশ্বাস রাখুন।এদের বিশ্বাস করে যে সম্মানটুকু আপনারা নিবেদন করবেন-সেটি অগ্রাহ্য করে অমানুষ হবার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা কোন চিকিৎসককে দেননি……