১৪ মে, ২০২০, বৃহস্পতিবার
ডা.শরমিন আক্তার সুমি
সহকারী অধ্যাপক, প্লাস্টিক সার্জারি,
শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি
চোখটা খুলতে পারছেন না যেন। খুলতে গেলেই ক্লান্তি ছেয়ে যাচ্ছে। শ্বাসটা নিতে গেলেও কেমন যেন মনে হচ্ছে, না নিলেই ভালো লাগতো। চারিদিকে এতো শব্দ, তাও খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না উনার। মনে হচ্ছে কাঁচের নকশা করা গ্লাসের একটা দেয়ালের নিচে শুয়ে আছে সে। কেউ জোরে ডাকলে সেই কাঁচ টুকরো টুকরো করে ভেঙে পানিতে ভেসে ওঠার মতো করে ভেসে উঠছেন উনি।
নাফিসা(ছদ্মনাম), কেমন লাগছে আপনার?
ভা…লো।
বাচ্চার নাড়াচাড়া টের পান?
উম..ম..।
আবার কাচের দেয়াল এর ওপারে চলে গেলেন।
ইউরিন কালার হাই। মাস্ক অক্সিজেন সহকারে স্যাচুরেশন ৯০-৯৪% এর মধ্যে ওঠানামা করছে। কনসাশনেস তো বোঝাই যাচ্ছে। ফুসফুস ক্লিয়ার না বাড়তি একটা ঘষটানো শব্দ পাওয়া যায়। শ্বাস নেয়ার ধরনটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, কোন সময় নিতে নিতে আর নিতে ইচ্ছে করবে না তার। পুরু ব্যন্ডেজের ওপর দিয়ে কয়েক মিনিট ধরে আরেকটা স্পন্দন শোনার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ।
পাশ থেকে সিস্টার বললেন, “রোগীর লোক বাচ্চার খোঁজ জানতে চায়।”
আমি বললাম, “কেন বাচ্চার মার খোঁজ জানতে চায় না?”
বলেন, “হুম, দুটোই চায়।”
–“উনারা জানেন না রোগীর অবস্থা খারাপ?”
–“জানেন। তবুও আবার জিজ্ঞেস করে।”
–“ডাকেন, কথা বলি।”
(কাউন্সেলিং রুমে)
–“রোগী কি হয় আপনার?”
–“আমার বোন।”
–“উনার অবস্থা জানেন? কি জানেন বলেন তো?”
–“জ্বি জানি, খারাপ।”
–“হুম, বেশ খারাপ। খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে আজকেও।”
–“ম্যডাম, বাচ্চাটার কি অবস্থা?”
–“মা যদি না বাঁচেন, বাচ্চা আর কিভাবে বাঁচবে তাই না?”
–“হুম, তাও তো।”
–“উনি পুড়লেন কিভাবে?”
–“রান্নাঘরে। ম্যাক্সি পরা ছিল। ম্যাক্সির উপরে ওড়না পড়ছিলো। চুলার ওপর দিয়ে, ওইপাশ দারচিনির বয়াম নিতে গিয়েছিল। ওড়নার নিচে আগুন লেগেছিল চুলা থেকে। আমার বোনটা সহজ সরল। বুঝছেন। পানি না দিয়া উল্টো বাতাস করছে। আগুন ধাই ধাই কইরা বেড়ে উপরের দিকে উঠছে। প্রথমে কাউকে ডাকেও নাই। পরে যখন পুরো গায়ের থেকে নিভাতে পারে নাই, তারপর চিৎকার দিয়েছে। তারপর আমরা গিয়ে পানি দিয়ে নিভিয়েছি। কিন্তু তার থেকে এমন অবস্থা হয়ে যাবে বুঝতে পারিনাই। আসলেই কি বাঁচবে না ও?”
–“দেখুন সম্ভাবনা খুবই কম। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এখন যে অবস্থা হয়ে গেছে, তাতে সম্ভাবনা নাই বললেই চলে।”
–“আমরা কি করতে পারি?”
–“যখন যা করার কথা, আপনারা তো করছেন ই।আমরাও তো করেছিই। আসলে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় শরীর এতো নাজুক থাকে যে, তার মধ্যে বার্নের এই ধাক্কাটা (Response to trauma) শরীরের যে সমস্ত ক্রিয়া-বিক্রিয়া চলে শরীর খুব কম সময়েই সামাল দিতে পারে। এখন আপনাদের দোয়া করা ছাড়া আর কিছু তো নেই।”
–“করছিই তো ম্যাডাম। বিয়ের নয় বছর পর এইটাই প্রথম বাচ্চা। জামাই সৌদি থাকে। কত টাকা-পয়সা খরচ যে করছে এই বচ্চার জন্য। লকডাউন এর আগে আমাদের বাড়ি এসেছিলো। আমরা উনাদের আর কি জবাব দিবো।”
আমরা আর উনাদের কি ই স্বান্ত্বনা দেবো?
এসব আমাদের নিত্য দিনের ঘটনা। একটা ঘটনা থেকে আরেকটা ঘটনা আরো বেশি মর্মান্তিক। মন যখনি আদ্র হতে নেয়, তখনই তাকে কঠিন হাতে সামলাতে হয়। সবচাইতে দুঃখ দেয় সেই ভাবনাটা- পাঁচদিন আগেও সে ছিলো সম্পূ্র্ণ সুস্থ ছিল, দুটো প্রাণের স্পন্দন। শুধু ছোট্ট একটা আগুনের ছোঁয়া…প্রথম যখন ইমারজেন্সি তে আসে, এরা গাড়ি থেকে হেঁটেই আসে, অনেক সময় ড্রেসিং রুম পর্যন্ত…যারা ডিল করে নি তারা সহজে মানতেও পারবে না। আমরা তার পেছন পেছন হাঁটা যমদূতকে প্রায়শই ঐ দিনই দেখে ফেলি। যুদ্ধে হারতেই থাকি…হারতেই থাকি।
১. ঢিলেঢালা কাপড় পড়ে রান্নাঘরে আগুনের কাছে যাবেন না। শাড়ির আঁচল/ওড়না গুটিয়ে নিন। পারলে কিচেন এপ্রোন পড়ুন।
২. গায়ে আগুন লেগে গেলে, প্রথমেই শুয়ে পড়ূন, গড়াগড়ি দিয়ে আগুন নেভান।
৩. আগুন নেভানোর সাথে সাথে আক্রান্ত স্থানে পানি দিন। ভুলেও ডিম, লবণ, বরফ, পেস্ট বা অন্য কিছু দিবেন না।
জানি, অনেক সতর্কতাও হয়তো কমাতে পারবেনা।তবু্ও চেষ্টা করি…
বাসায় থাকুন। বাসায় ও নিরাপদে থাকুন প্লিজ।