প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদন,
রবিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২০
পৃথিবীর সকল চিকিৎসা ব্যবস্থায় যদি একটি মূল সংকট কে চিহ্নিত করা হয়, তা হবে স্বাস্থ্যকে শুধু মাত্র ‘কিউর বা আরোগ্য কেন্দ্রিক” করা এবং আরোগ্যের জন্যে শুধু ওষুধ কে একমাত্র উপায় মনে করা। কিন্তু হাজার বছর ধরে ট্র্যাডিশনালি সব দেশেই রোগ হওয়ার পরে আরোগ্যলাভ কেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্যেই স্বাস্থ্য একটি পণ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সেই পণ্যকে কেন্দ্র করে বানিজ্য হয়েছে সব দেশে। পুঁজিবাদী দেশগুলোতে তা আরও ভয়াবহ। এজন্যে ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি প্রকট আকার ধারণ করেছে কোন কোন দেশে। পৃথিবীর অল্প কিছু দেশ সেই মডেল থেকে বের হ’য়ে এসেছে। “স্বাস্থ্য পণ্য নয়, অধিকার” এটাই হওয়া উচিত আধুনিক সমাজব্যবস্থার স্লোগান। লক্ষ্য করুন, স্বাস্থ্য কে অধিকার হিসাবে দেখলেই তখন রোগের জনম বৃন্তান্ত থেকে হাসপাতালে আরোগ্য লাভ সমস্ত কিছু গুরুত্ব পেয়ে যায়। আমি বিশ্বস্বাস্থ্য ব্যবস্থার তুলনামূলক বিশ্লেষণ পড়িয়ে থাকি; তাই বিস্তারিত লিখতে ইচ্ছা করবে, কিন্তু এখানে তা না করে এই কোভিড-১৯ কে উদাহরণ ধরে একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পালটানোর কথা বলি।
লক্ষ্য করুন, সবাই কোভিড-১৯ এর হিরোদের কথা বলছে; কারা সেই হিরো পত্রিকা এমনকি সাধারণ মানুষের বর্ণনায়? ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী যারা হাসপাতেলে কাজ করছে। নিঃসন্দেহে তাঁরা হিরো। কিন্তু কেউ কি সেই সব মানুষদের কথা বলছে যারা রোগের গতিপ্রকৃতি নিয়ে কাজ করেন, ফিল্ডে গিয়ে ডেটা তৈরি করেন, ল্যাবরেটরিতে দিনের পর দিন গবেষণা করে একেকটা পদ্ধতির জন্ম, বছরের পর বছর স্কুল, কলেজে এইসব নতুন পদ্ধতি শিক্ষা দিয়ে নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গিওয়ালা চিকিৎসক তৈরি করেন, যারা রাতদিন গবেষণা করে এভিডেন্স তৈরি করেন যা হাসপাতালে ডাক্তারেরা চোখ বন্ধ করে ব্যবহার করতে পারেন? তাঁদের কথা মাত্র শুনতে পারছেন, যখন সারাহ গিলবার্ট ল্যাবরেটরিতে বসে ইবোলার মতো বা কোভিড ১৯ এর মতো ভ্যাকসিন তৈরি করছেন। কিন্তু যে লোকটি প্রথমে এপিডেমিওলজিস্ট-চিকিৎসক সায়েন্টিক আফ্রিকায় গিয়ে প্রথম ভাইরাসটি আবিষ্কার করলেন যার জন্যে লক্ষ লক্ষ বিজ্ঞানী গবেষণাগারে বসে জিনেটিক বা অন্যান্য বিষয় আবিষ্কার করছে, তাঁর কথা কতজন জানি আমরা?
আমার সঙ্গের এই ভদ্রলোকের নাম ডক্টর জোল ব্রিম্যান । তিনি হলেন বিজ্ঞানের জগতের জেমস বন্ডের মতো। সেই ১৯৭৬ সালে প্রথম যখন আফ্রিকার জায়ার (কঙ্গো) নামের দেশটায় অজানা এক রোগে মানুষ মারা যাচ্ছিল, সেখানে একটি চিকিৎসা দলের নেতা হয়ে যান এবং আবিষ্কার করেন ‘একটি ভাইরাস’ যার নাম দেয়া হয়েছিল কঙ্গোর একটি নদীর নামে, ইবোলা ভাইরাস! তিনি হলেন না-বলা বা অচেনা বা আন-সাং (Unsung) হিরো।
আমরা একটু রোগের স্পেকট্রাম বা শুরু থেকে শেষের প্রক্রিয়াটা দেখি(উপরের দ্বিতীয় ছবি)। একটি রোগ হওয়ার পর হাসপাতালে যাওয়ার আগে কতগুলো স্টেপ। প্রথমত কার কী রোগ হতে পারে বা সম্ভাবনা তা বুঝতে পারা (রিস্ক) এক্সপোজার (যেমন আপনি যদি অনেক স্ট্রেসের মধ্যে থাকেন, তাহলে সেই স্ট্রেস এক্সপোজার উচ্চ রক্তচাপ তৈরি করবে), তারপর সেই এক্সপোজারের পর শরীরের মধ্যে প্যাথোলজিক্যাল পরিবর্তন হওয়া, তারপর সেই রোগ সাবক্লিনিক্যাল স্টেজে থাকে। এরপর শুরু হয় রোগের লক্ষণ। এই লক্ষণ ধরতে পারলে আপনি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন, বা হাসপাতালে যাচ্ছেন। যেহেতু এটা সর্বশেষ স্তরের মতো, জীবন-মরণের প্রশ্ন আসে এখানে, তাই মানুষ সব ব্যয় করে মুক্ত হতে চায় সেই রোগ থেকে। এই সুযোগটিই নিয়ে থাকে বড় বড় ওষুধ কোম্পানি, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, এমনকি হাসপাতালসহ সকল চিকিৎসা ব্যবস্থার লোকজন। অথচ রোগটি ঠেকানো যেতো অনেক আগে, কিন্তু আপনি সেখানে টাকা ব্যয় করতে চান না, কারণ রোগের ভয়াবহতা দেখতে পাচ্ছেন না। যারা দেখতে পাচ্ছেন তাঁদের গুরুত্ব থাকছে না চিকিৎসা ব্যবস্থায়। অথচ মুখে সবাই বলছি, “প্রিভেনশন ইজ বেটার দেন কিউর”।
এই মানসিকতা, এই সিস্টেম বদলাতে না পারলে আসল হিরোরা থেকে যাবে আড়ালে, আপনার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে যাবে মুনাফালোভীদের হাতে। কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে মাত্র ৫%-১০% মানুষ হাসপাতালে যেতে বাধ্য হচ্ছে, উন্নত চিকিৎসার দরকার পড়ছে। লক্ষ্য করুন মূল ৯০%- ৯৫% লোকের জন্যে যারা কাজ করছে তাঁদের কেউ হিরো বানাচ্ছে না। যে লোকগুলো ল্যাবরেটরিতে বসে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, ভাইরাসটির ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করছে, রিএজেন্ট বানাচ্ছে যা দিয়ে রোগ না ধরলে কিছুই পাবো না আমরা। কিম্বা যিনি আফ্রিকার বা এশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে স্যাম্পল নিয়ে না এলে কোন গবেষণাই হতো না, তাঁরা কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম-পসয়া-পাওয়া, খুব রেয়ারলি সম্মান-পাওয়া অকথিত বা আন-সাং হিরো।
যে ডাক্তারটি টিপিক্যাল ডাক্তারের চোখ দিয়ে নয়, বরং একজন এপিডেমিউলজিস্টের বা গবেষকের চোখ দিয়ে প্রথম রোগ দেখে বুঝতে পারলেন- ঘটনা অন্য কোথাও তাঁকে যারা সেই দেখার চোখটি তৈরি করে দিচ্ছেন, সেই শিক্ষকেরা, তাঁরাও কিন্তু আন-সাং হিরো।
তাহলে সাধারণ মানুষের দেখার চোখ যেমন বদলাতে হবে, তেমনি রাষ্ট্র, চিকিৎসা ব্যবস্থায়ও নিয়ে আসতে সেই পরিবর্তন। দেখুন যে সব দেশ এই পরিবর্তন সফলভাবে এনেছে তাঁরাই কিন্তু সফলভাবে মোকাবেলা করছে বা করেছে কোভিড-১৯ এর মতো মহামারী। আমরা জানি কোভিডের মতো আরও রোগ সামনে অপেক্ষা করছে; এখনই সময় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শুধু হাসপাতাল কেন্দ্রিক না করে, সামাজিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবন বা কমিউনিটিতে নিয়ে আসা। প্রতিরোধ, প্রতিষেধককে শুধু কথার কথায় না, সত্যিকার গুরুত্ব দেয়া জরুরী। সেটা দিতে হলে যে সব চিকিৎসক বা গবেষক সেই প্রতিরোধের দিক বেছে নিচ্ছেন তাদেরকে অর্থনৈতিক সম্মানও দিতে হবে, যেমন দিচ্ছে উন্নত দেশগুলো।
সব পরিবর্তন শুরু হয় মানসিকতার পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে, আমরা একবার অন্তত সেইসব না-বলা বা আন-সাং হিরোদের স্মরণ করি এবং মানসিকতা বদলাই ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্যে!
লেখক পরিচিতি: ডা. সেজান মাহমুদ একাধারে একজন কথাশিল্পী, গীতিকার, চলচ্চিত্রকার এবং পেশায় চিকিৎসা বিজ্ঞানী। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব সেন্টার ফ্লোরিডা কলেজ অব মেডিসিনে সহকারী ডিন ও প্রফেসর হিসাবে কর্মরত।