ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ‘৩৫ বি’ বলে একটা ওয়ার্ড ছিল। সেখানেই পাঁচটা বেড বার্ন রোগীদের জন্য আলাদা করে চিকিৎসা শুরু করেছিলাম। একটা আলমিরা আর একটা চেয়ার-টেবিল ছিল। সেই আলমিরা এখনও আমার কাছে রয়েছে। আর এখন আমরা যাচ্ছি ৫০০ শয্যার ইনস্টিটিউটে। এই পাঁচ থেকে ৫০০ বেডে যাওয়ার পথচলা একটা যুদ্ধ, একটা গল্প।’
কথাগুলো বলছিলেন ডা. সামন্ত লাল সেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধীনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের দায়িত্বে রয়েছেন তিনিই। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আগামীকাল বুধবার (২৪ অক্টোবর) ‘শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট’ নামের এই বার্ন ইউনিট উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই বার্ন ইনস্টিটিউটে থাকছে চিকিৎসা, সেবা, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও গবেষণার সব সুযোগ।
ডা. সামন্ত লাল সেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি সবসময় বলি, ৫ থেকে ৫০০। ৫ বেড দিয়ে শুরু করে ৫০, ১০০, ৩০০ পেরিয়ে এখন আমরা ৫০০ বেডে যাচ্ছি ২৪ অক্টোবর। এটা একটা গল্প।’
ড. সামন্ত লাল সেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে বার্ন ইউনিটের যাত্রার শুরুটা মসৃণ ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের শুরুর দিকে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন ড. রোনাল্ড জোসেফ কাস্ট আসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। তখন একজন প্লাস্টিক সার্জন জরুরি বলে সেখানে লুধিয়ানা থেকে আসেন পারভেজ বেজলিন। এটাই ছিল বাংলাদেশে প্লাস্টিক সার্জারির প্রথম কনসেপ্ট।
সামন্ত লাল সেন বলেন, তখন আমি তরুণ চিকিৎসক। চোখ ভরা স্বপ্ন— বিখ্যাত প্লাস্টিক সার্জন হবো, অনেক টাকা হবে, দামি গাড়ি-বাড়ি হবে। কিন্তু চিকিৎসা করতে এসে, রোগীদের সংস্পর্শে এসে বদলে গেল আমার সেই অনেক টাকা আর বাড়ি-গাড়ির মালিক হওয়ার স্বপ্ন।
তিনি বলেন, ১৯৮০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগ দেই। দেখি, দগ্ধ রোগীরা জায়গা পাচ্ছে হাসপাতালের বারান্দায়, মেঝেতে, বাথরুমের পেছনে মশারি টানিয়ে। অথচ এসব রোগীরা খুবই সংবেদনশীল, একটু সংক্রমণেই তাদের আরও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। প্লাস্টিক সার্জন ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ স্যার যোগ দিলেন ১৯৮২ সালের দিকে। তখন আমাদের শিক্ষক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. কবীরউদ্দিন স্যার বলতেন, সামন্ত, বার্ন রোগীদের জন্য কিছু করো। এসব রোগীরা হাসপাতালের এখানে-সেখানে পরে থাকে। ১৯৮৬ সালের দিকে সরকারের কাছে আবেদন করি পৃথক একটা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের জন্য। সেই কাগজটা এখনও আমার কাছে আছে। বার্ন ইউনিটের জন্য সেই শুরু হলো যুদ্ধ।
সেই উদ্যোগ ২০০১ সালে সফল হয় জানিয়ে বাংলাদেশে বার্ন ইউনিটের অন্যতম শীর্ষ এই চিকিৎসক বলেন, সে বছরে ঢামেকে এই ইউনিট পৃথক হয়ে একটি ভবন হয়। কিন্তু এখানে তখন একটা বস্তি ছিল। সেই বস্তি সরাতে গেলে আমার বিরুদ্ধে মিছিল হয়, হুমকি দেওয়া হয়। তৎকালীন সরকারের সহায়তায় বস্তি সরিয়ে এই ভবন তৈরি হয় এবং ২০০১ সালে ৫০ শয্যা নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। আর এটি এখন ৩০০ শয্যার হাসপাতাল। সৃষ্টিকর্তাকে সবসময় বলেছি, আমাকে আরেকটু বাঁচিয়ে রাখো, যেন হাসপাতালটা বানিয়ে মরতে পারি।
‘আমার সেই স্বপ্নের হাসপাতাল তৈরি হয়েছে, উদ্বোধন হবে- আমার জন্য এটা কী, সেটা আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারব না, বোঝানোর মতো ভাষা নেই আমার। আমি কেবল বুঝি- আমার বুকের ভেতরে কেমন লাগে,’- শূন্য চোখে বলেন ডা. সামন্ত লাল সেন।
বাংলাদেশে কেন ৫০০ শয্যার মতো বার্ন ইন্সটিটিউট দরকার হলো- জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিবছর বাংলাদেশে যত মানুষ পোড়ে, সে পরিমাণ মানুষ আর কোনো দেশে পোড়ে না। আর এখানে কেবল পুড়ে যাওয়া রোগীর চিকিৎসা হবে না, এ জাতীয় সব ধরনের রোগীর চিকিৎসা ছাড়াও চলবে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম শুরুর মধ্য দিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে আরেকটি ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
জানা গেছে, এই ইনস্টিটিউটের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে। প্রকল্প মেয়াদ অনুযায়ী, কাজ শেষ হওয়ার কথা এই বছরের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় দুই মাস আগেই উদ্বোধন করা হচ্ছে। ছোটখাটো কিছু কাজ বাকি থাকলেও তা শেষ হতে ডিসেম্বর পার হবে না।
অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ এই ইনস্টিটিউটে থাকছে একশটি কেবিন। হাইডেফিসিয়েন্সি ইউনিটে থাকছে ৬০ বেড, ১২টি অস্ত্রোপচার থিয়েটার এবং অত্যানুধিক পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ড। বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির অত্যাধুনিকচিকিৎসা এখানে দেওয়া হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পুরাতন ভবনের সঙ্গে একটি ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে সংযোগ স্থাপন করা হবে নতুন এই ভবনের।
এই বার্ন ইনস্টিটিউট ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায়। পরের মাসের ২৯ তারিখ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীশেখ হাসিনা চানখাঁরপুলে ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২৭ এপ্রিল বাংলদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর নির্মাণ কাজ শুরু করে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বার্ন ইনস্টিটিউট। এই বিষয়ে এত বড় বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট পৃথিবীর আর কোথাও নেই। কারণ, বাংলাদেশে যত মানুষ দগ্ধ হয়, বিশ্বে আর কোনো দেশে এত মানুষ দগ্ধ হয় না।
ডা. সামন্ত লাল সেন সারাবাংলাকে বলেন, প্রায় দুই একর জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে ১৮ তলা ভবনের এই ইনস্টিটিউট। মাটির নিচে তিন তলা বেজমেন্ট রাখা হয়েছে। কেবল গাড়ি পার্কিং নয়, রেডিওলজিসহ আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিভাগ থাকবে সেখানে। বহুতল এই ভবনটি তিনটি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে- একদিকে থাকবে বার্ন, অন্যদিকে প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট আর অন্য ব্লকটিতে করা হবে একাডেমিক ভবন। দেশে প্রথমবারের মতো কোনো সরকারি হাসপাতালে হেলিপ্যাড সুবিধা রাখা হচ্ছে।
বাংলাদেশের চিকিৎসকদের মেধা-দক্ষতা সব আছে, প্রয়োজন শুধু সুযোগের- এমন মন্তব্য করে সামন্ত লাল সেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। তার কাছে আমরা ঋণী, তিনি আমাদের এত বড় ভবন দিয়েছেন, বিশ্বের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে আসা হচ্ছে, একটি ইনস্টিটিউটে প্রায় ২ হাজার দুইশ পদ সৃজন করা হয়েছে।
‘একজন প্রধানমন্ত্রী যদি এ ধরনের সাপোর্টে দেন, তাহলে আমরা সবাই অনেক বল পাই, আমাদের সাহস অনেক বেড়ে যায়,’- বলেন ডা. সামন্ত। একইসঙ্গে দ্রুততম সময়ে এই নির্মাণকাজ শেষ করায় তিনি ধন্যবাদ জানান সেনাবাহিনীকেও।
বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকৎসক অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ খোন্দকার সারাবাংলাকে বলেন, জন্মগত ঠোঁটকাটা-তালুকাটা, আঙুল জোড়া লাগানো, পায়ের ত্রুটি, ক্যান্সার, দুর্ঘটনা, ট্রমা, হাত-পা সার্জারিসহ একটা বড় অংশ বার্ন ইউনিটে আসে। এই সবকিছু ডিল করতে গেলে প্লাস্টিক সার্জন দরকার ন্যূনতম চারশ জনের মতো। কিন্তু বাংলাদেশে এখন প্লাস্টিক সার্জন রয়েছেন ৬৫ জন। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে বের হবেন ৮০ জনের মতো। এখন আমাদের লক্ষ্য, আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে এই ইনস্টিটিউট এবং ঢামেক হাসপাতালের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ প্লাস্টিক সার্জন তৈরি এবং নিয়োগ দেওয়া।
ডা. সাজ্জাদ খোন্দকার বলেন, এখন যে ভবন রয়েছে তাতে রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। এতে সংক্রমণের (ইনফেকশন) আশঙ্কাও বেড়ে যায়। নতুন ইনস্টিটিউটে বেড অনুযায়ী রোগী ভর্তি করা হবে। মান নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে ফ্লোরে কোনো রোগী ভর্তি নেওয়া হবে না।
বার্ন অ্যন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হোসাইন ইমাম সারাবাংলাকে বলেন, সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের একটি চুক্তি রয়েছে। তারা অংশীদার হিসেবে থাকতে চায়। বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের কাছে রোগী যায়। যে কারণে তাদের চাওয়া, বাংলাদেশে এই ফ্যাসিলিটি থাকুক। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট হোক রেফারেন্স রিজিওনাল সেন্টার।
যুদ্ধের মধ্যে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত থাকে; সেসব বাধা অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেলেই সাফল্য আসবে বলে মনে করেন ডা. সামন্ত। তিনি বলেন, আমাকে মুখের ওপর ফাইল ছুঁড়ে মারা হয়েছিল। কিন্তু ধৈর্য হারাইনি, মুখ বুজে সব সয়েছি। তার ফল এখন দৃশ্যমান। তাই যে যে সেক্টরে রয়েছেন, তাকে ধৈর্য ধরতে হবে। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক এগিয়েছে। কেউ কি কখনও ভেবেছিল- জোড়া শিশু তোফা-তহুরার মতো জটিল চিকিৎসা এই দেশের চিকিৎসকরা করতে পারবেন?
‘অথচ সেটাই হচ্ছে। আজকে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে যারা রয়েছেন তারা আমাদের চেয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি পাচ্ছে, সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ, আরও আগাবে বলেই আমি বিশ্বাস করি। দেশের চিকিৎসকদের কেবল সুযোগ দরকার,’- বলেন ডা. সামন্ত লাল সেন।
কৃতজ্ঞতাঃ জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, সারাবাংলা