আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগের কথা। ভারতের পূর্বের একটি রাজ্য ত্রিপুরার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ শহর কুমিল্লা।তখন বৃটিশ রাজত্ব আর সেই অপশাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হয় এই বাংলা থেকেই। কুমিল্লা সে সময়ের বিপ্লবীদের অন্যতম ঘাটি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যুগান্তর আর অনুশীলন পার্টির ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠে অনেক আখড়া। সে সব আখড়ায় তরুণ যুবকদের অংশগ্রহন দিন দিন বারতেই থাকে।
১৯২৬ সালে বিপ্লবী অখিল নন্দী কুমিল্লায় যুগান্তর পার্টির দায়িত্ব গ্রহন করে। গোপন সভা সমিতির মধ্যে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকলেও তার এবং তার দলের ছিল মহাপরিকল্পনা। সেই সুত্রেই তার দলে যুক্ত হয় প্রথম মহিলা সদস্য প্রফুল্ল নলিনী। প্রফুল্লের মাধ্যমে বিপ্লবী দলের মহিলা বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়, যুক্ত হয় শান্তি, সুনিতী, জাহানারা সহ আরো অনেকে।
এই মেয়েদের দলটির সবাই সপ্তম অষ্টম শ্রেনির ছাত্রী। কুমিল্লা ফয়জুন্নেসা স্কুলের এই দলটিকে নিয়ে গঠন করা হয় ত্রিপুরা ছাত্রী সংঘ, প্রফুল্ল এর সভাপতি, শান্তি ঘোষ এর সাধারণ সম্পাদক। ১৯৩১ সালের মে মাসে নেতাজি সুভাষ বসু কুমিল্লায় আসেন। তাকে গার্ড অফ অনার দেয় নারীদের বিপ্লবী দল যার মেজর (দলনেতা) ছিল সুনিতী। সেদিনের সভায় সুভাষ বসু নারীদের বিপ্লবে অংশগ্রহন কে স্বাগত জানায়। সেদিন থেকেই নারীদের বিপ্লবে অংশগ্রহন আরো জোড়ালো হয়।
চট্রগ্রামের মহাবিপ্লবের পর দিকে দিকে সবার মাঝে নতুন স্বপ্ন তৈরি হয়, এবার কিছু করতেই হবে মাস্টারদা সূর্য সেনের মত। সেই কিছুকরার তাগিদে জুন মাসে এক গোপন সভা হয় । সভায় প্রফুল্লের প্রস্তাব, হামলা হবে থানায়, ম্যাজিস্ট্রট অফিসে। সবার আগ্রহ বেরে যায়, এটা সম্ভব হবে তো? চট্রগ্রাম বিপ্লবের পর বৃটিশ প্রশাসন সব দিকেই আরো শক্ত হয়ে যায়। তাই ছেলে সদস্যদের ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি, অন্যদিকে মহিলা সদস্যরা তখনো যে গোপনেই যুক্ত।
তাই এই সুযোগ কাজে লাগানোর কথা ভেকেই সিদ্ধান্ত হয় কুমিল্লার বিপ্লবী কাজে অংশ নিবে মহিলারাই। যেমন কথা তেমন কাজ, শুরুহয় সশস্র বিপ্লবী ট্রেনিং।
ময়নামতি পাহাড়ে সে ট্রেনিং এ বন্দুক চালনা, ছুড়ি লাঠি চালনার সব প্রস্তুতি চলতে থাকে। বিরেন ভট্টাচার্য ছিল তাদের প্রশিক্ষক , তিনি ঢাকা মেডিকেল স্কুলের ছাত্র। প্রশিক্ষণ শেষে সিদ্ধান্ত হয় ডিসেম্বরেই হবে মুল কাজ । ঠিক করা হয় দলের সদস্য, মুল কাজ করবে শান্তি সুনিতী।
১৯৩১ এর ১৪ ডিসেম্বর সকাল বেলা, সতীশ রায় ঘোড়াগাড়ি চালিয়ে নিয়ে আসে শান্তি সুনিতী কে। ধর্মসাগর পাড়ে চাদর পেচিয়ে দাড়িয়ে ছিল অখল নন্দী। দুই বিপ্লবী গাড়ি থেকে নেমে প্রণাম করে নেয় তাদের গুরু অখিলদা কে। কেমন যেন টিব টিব করছে বুক, কি হতে যাচ্ছে এখন। তারা যাবার পর অখিল বুঝতে পারলো, তার চোখে পানি এসে গেছে – আনন্দের, গর্বের, বিপ্লবের।
সেদিন সকালে জেলা ম্যাজিস্ট্রট তার বাসায় ছিল। বাসার লনে বসে সংবাদ পত্র পড়ছেন এমন সময় শুনতে পেলেন দুজন মেয়ে এসেছে। ফয়জুন্নেসা স্কুলে মেয়েদের সাতার শিখানোর জন্য অনুমতি চায়। তাদের সাথে দেখা করে ম্যাজিস্ট্রট স্টিভেন্স বসলো, হাতে তাদের আবেদন পত্র। বলল, অনুমতি দিয়েছি…. কথা শেষ করার আগেই সুনিতী তার কোমড়ে লুকানো পিস্তল বের করে দুটি গুলি করে, সাথে সাথেই গুলি চালায় শান্তি। সবার সামনে, প্রকাশ্য দিবালোকে স্কুল পড়ুয়া দুই ছাত্রীর হাতে মৃত্যু হয় কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর।
সাথে সাথে গ্রেফতার হয় তারা। শুরু হয় অমানবিক অত্যাচার। রাতে থানায় নিয়ে তাদের বেধেঁ রাখা হয়। দুদিন পরে চালান হয় কোর্টে। বলা হয় তাদের মারতে মারতে নাকি গায়ের কোন অংশ বাদ রাখা হয়নি। এমনকি এই কিশোরীদের গায়ের কাপড় খুলতেও দ্বিধা করেনি বর্বর বৃটিশরা।
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে প্রফুল্ল, অখিল, বিরেন গ্রেপ্তার হয়। ১৯৩২ সালে আদালতের রায় আসে, বয়স মাত্র ১৬ হওয়ায় শান্তি সুনিতীর যাবৎজীবন কারাদন্ড হয়। অন্য কারো অভিযোগ প্রমানিত হয়নি তবুও তাদের গ্রেপ্তার করে রাখা হয়।
১৯৩৬ সালে প্রফুল্ল, অখিল মুক্তি পায়। ১৯৩৮ এ গান্ধীজীর বিশেষ অনুরোধে মুক্তি পায় শান্তি সুনিতী। এর পর জীবন যে একে বারে পাল্টে যায় সুনিতীর। ইতিমধ্যে তার বাবার পেনশন আটকে দেয় সরকার। তার দুই ভাই যক্ষা রোগে মারা যায়। তার প্রিয় প্রফুল্লদি এপেন্ডিসাইটিস এর চিকিৎসা না পেয়ে মারাযায়। এসব আমূল পরিবর্তন আনে সুনিতীর মনস চিত্তে।
সে থেমে থাকেনি, জেল থেকে বের হয়ে পড়ালেখা শুরু করে আবার। ১৯৪১ এ কোলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয় সুনিতী। দারিদ্রের তুমুল কষ্টের মাঝে সে তার পড়ালেখা চালিয়ে যায়। ১৯৪৬ সালে ডাক্তারী পাশ করে সে, সে বছরই তার বিয়ে হয় প্রদ্দুত চন্দ্র ঘোষ এর সাথে। এর পর সর্ব সাধারণের জন্য নিজেকে নিবেদিত করেন সুনিতী। গ্রামে গ্রামে ঘুরে মেয়েদের চিকিৎসা দিতে থাকেন। গরিবের চিকিৎসা দিতেন বিনামূল্যে। ধীরে ধীরে সেই কিশোরী বিপ্লবী একজন বড় চিকিৎসক হয়ে উঠেন।
এই মহিয়সী নারী ১৯৯৪ সালে কোলকাতায় মৃত্যুবরন করেন।
খুব আশ্চর্য কথা হচ্ছে, এই মহান নারী এবং তার কীর্তি ইতিহাসের অবহেলায় হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। তার এবং সেই সময়ের মহান বিপ্লবীদের নিয়ে অল্প কিছু গবেষণাদি হয়েছে। আমার এ লেখাটাও এমনি একটি গবেষণার অংশ। এ বিষয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন।
তথ্যসুত্র ঃ
১। বিপ্লবীদের সৃতিচারণ, অখিল চন্দ্র নন্দী।
২। অবিভক্ত বাংলার অসমাপ্ত বিপ্লব, যয়দুল হোসেন।
৩।শহীদ ধীরেন্দ্রনাথের আত্মকথা।
লেখকঃ ডাঃ নিসর্গ মেরাজ
এক্স বিজিটিএমসিয়ান
FETP’B (US CDC) Fellow at Institute of Epidemiology,
Disease Control and Research (IEDCR)