(১)
রাত পোহালেই বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। সকালে মন ভরে গেল শ্রদ্ধেয় টিপু স্যারের দুর্দান্ত প্রেজেন্টেশান দেখে। সাতই এপ্রিল শুক্রবার বলে বৃহস্পতিবারেই ওয়ার্ল্ড হেলথ ডে এর প্রোগ্রামটা আয়োজন করা হয়েছিলো।
স্যার এর মাইন্ড ব্লোয়িং প্রেজেন্টেশান আর বৃহস্পতিবার আমাকে বারবার বৃহস্পতিবারের চিঠির কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিলো। আমি নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছিলাম, আমার চিন্তাগুলো যেন ডানা মেলছিলো! মুখে অনেক কথাই আমি বলতে পারি না, লিখতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের এবারের স্লোগান, যেন আমার মনের কথা!
Depression : Let’s Talk.
কাকতালীয় ভাবেই, কাল রাতে এক জুনিয়র আমাকে টেক্সট করে মেডিকেল লাইফ নিয়ে তার হতাশার কথা জানালো। কেউ যখন তাদের মনের কথা গুলো বলে, আমি চেস্টা করি মন দিয়ে শুনতে আর সেটা থেকে উত্তোরনের উপায় বের করতে।নিজের ফেলে আসা হতাশার দিনগুলোর কথা মনে করি আর ভাবি, কিছু না পারি, সান্ত্বনা তো দিতে পারি!
WHO-এর এবারের স্লোগান সবার জন্যই। সবাই মিলে কথা বলেই ডিপ্রেশান থেকে মুক্তি পেতে হবে, ডাক্তার এখানে একটা অংশ মাত্র। সবার সহযোগীতা ছাড়া এটা অসম্ভব। আমরা কেউ যদি একজনকেও সাহায্য করতে পারি তাহলেও ডিপ্রেশান এর রোগীর সংখ্যা অনেক অনেক কমে যাবে! বর্তমান বিশ্বে ডিপ্রেশান ও সুইসাইডের ইনসিডেন্স মারাত্মক ভাবে বেড়ে চলেছে, যারা বেশীর ভাগই যুবক যুবতী, শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত! কেন এই দুর্যোগ?
(২)
Sadness Vs Depression –
গত খেলায় বাংলাদেশ হারায় মনখারাপ ছিলো আজ জিতে যাওয়ায় সেটা ভুলে গেছি। সাময়িক কষ্টটাকে বলা হয় স্যাডনেস, মনের উপর যার সুদূর প্রসারী কোন ইফেক্ট নেই!
বারবার পরাজিত হলে, স্যাডনেস বাড়ে আর তা যখন পারিপার্শ্বিকতার চাপে আমাদের মনের দখল নিয়ে নেয় তখনই ডিপ্রেশান আসে। ডিপ্রেশান ধীরে ধীরে মনের কর্তৃত্ব নেয় আর জীবনকে ধ্বংস করে দিতে প্ররোচিত করে!
কাজেই, ছোট ছোট স্যাডনেস যেন দীর্ঘস্থায়ী হতে না পারে সেটাই আমাদের চেস্টা থাকবে। আমাদের আশে পাশে কেউ যেন নিজেকে একা না ভাবে। কারো সামান্য একটু সাপোর্টও অনেক কিছু! চারপাশটাকে একটু আনন্দঘন রাখার চেস্টা করতে দোষ কোথায়?
(৩)
বলা হচ্ছে সুইসাইডের ঘটনা আশংকা জনক ভাবে বাড়ছে। কিন্তু কেন?
উত্তর একটাই প্রতিযোগীতা।
যে কৃষিকাজ করে, দিনে আনে দিনে খায় তার তো এত হতাশা নাই। অথচ যত হতাশা বিত্তবানদের, তারা ঘুমের ঔষধ ছাড়া ঘুমাতেই পারেন না।
আমাদের প্রত্যাশার মাত্রাটাকে একটু কমানো দরকার, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসেব মেলাতেই আমাদের দিন শেষ হয়। জীবনটা শুধু রেইসের ঘোড়ার মত দৌড়ানোর জন্য নয় কিম্বা অভিযোগ করার জন্যও নয়। শরীর যখন ভালো থাকে না আমরা বিশ্রাম নেই কিন্তু মনের যত্ন কয়জন করি? মন খারাপ, মন ভালো নেই, এই ছোট ছোট কষ্ট গুলোকে ঝেড়ে ফেলে আনন্দ করলেই হতাশা কাটবে, হতাশা কাটলে, সুস্থ্য মনে সাফল্য আসবেই।
রাতারাতি কিছু হয় না, কষ্ট করতেই হয়! কষ্টটা হাসিমুখেই করতে হবে, নইলে হতাশা বাড়বেই!
(৪)
কি পেলাম, কি পেতে পারতাম, কেন এমন করলাম, ওটা করলেই ভালো হতো!
আমার বন্ধুরা অনেক পারে, আমি কেন পারি না! সবাই মেধাবী আমি কেন তাদের দলে নাই।
এই যে তুলনা, এই যে আফসোস, এগুলোই ডিপ্রেশান ডেকে আনে। প্লিজ, আজ এই মুহূর্ত থেকে এমন অনুযোগ বন্ধ করুন। মনটাকে সাদা কাগজের মতো ভাবুন। আগের যত অপ্রাপ্তি ছুঁড়ে ফেলুন। মনের মধ্যে যে সাদা কাগজটা নিয়েছেন তা দিয়ে আজ থেকেই আপনার যাত্রা শুরু করুন। সেখানে লিখুন, আগামী দিনে আপনার সামর্থ্যানুযায়ী কিভাবে আগাবেন। নিজের সাথে নিজে কথা বলুন, ফিরে যাবার জন্য জীবন নয়, জীবন এগিয়ে যাবার জন্য। আজ যে মুহূর্তে আপনি আই কুইট বলে সব ছেড়ে দেবেন কিম্বা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিবেন, দেখবেন হয়তো আর একটা বার চেষ্টা করলেই আপনি সফল হতেন!
আমাদের মেডিকেলের স্টুডেন্ডদের ৩০% এর মাঝেই নাকি ডিপ্রেশান কাজ করে। তাই মেডিকেল স্টুডেন্ট কিম্বা ডাক্তারদের মাঝে ডিপ্রেশান এর মূল কারনই হল ক্যারিয়ার এর চাপ। পড়াটা এখানে আর জানার জন্য বা আনন্দের জন্য হয় না, পরীক্ষাভীতি, শিক্ষক ভীতি, ক্যারিয়ার আর পরিবারের চাপ আমাদের অনেক বেশী হতাশায় ডুবিয়ে দেয়!
নিজের উপর বিশ্বাস থাকাটাই আসল। পাখি যখন কোন ডালের উপর বসে সে ডালের ভরসা করে না, তার বিশ্বাস তার নিজের ডানার উপর!
(৫)
Let’s Talk!
আপনার মন খারাপ? কি হয়েছে?
যত সুন্দর আর আন্তরিক ভাবে আমরা আমাদের আসেপাশের প্রিয়জনদের এই প্রশ্নটা করতে পারবো, সে তত বেশী আমাদেরকে তার মনের কথা শেয়ার করবে।
এই শেয়ারিং আর তারপর কেয়ারিংই পারবে একজনকে ডিপ্রেশান থেকে বাঁচাতে। এইটুকু করতে কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হতে হয় না, একজন ভালো শ্রোতা হতে হয়, সেই সাথে একটু কেয়ারিং মেন্টালিটি। এটা মনে রাখা জরুরী যে, আজ যার কথা আমি মন দিয়ে শুনছি না, এমন দিন আমার আসলে আমার কথাও কেউ শুনবে না। আর আজ অবহেলায় যাকে আমি ডিপ্রেশানের দিকে ঠেলে দিচ্ছি, সে আরো তিনজনের তিনজনের ডিপ্রেশানের প্রেরণা হবে, এমন না হয়ে যায় সেই তিনজনের কেউ আমারই পরিবারের কেউ।
কিভাবে বুঝবেন আপনি ডিপ্রেসড?
কাকে বলবেন মনের কথা?
সবার আগে নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে, আমি কি আসলেই ডিপ্রেসড? নাকি এটা সাময়িক স্যাডনেস!
যদি দুঃখবিলাস হয়ে থাকে, প্লিজ চিয়ার আপ! আর যদি নিজের কাছেই নিজেকে বোঝা লাগে, অনেক বেশী চাপ অনুভূত হয়, বেঁচে থাকাটা অর্থহীন মনে হয় অবশ্যই কারো সাথে সমস্যা শেয়ার করা উচিত।
মনের কথা বলতে সঠিক মানুষ সিলেক্ট করতে পারলে আপনি অনেকটাই রিলিফ পাবেন। দেখবেন, সেই মানুষটা যেন আরো ডিপ্রেসড না হন। যার সাথে নিজের সব শেয়ার করবেন, প্লিজ তাকে বিশ্বাস করুন, তার পরামর্শ মেনে চলুন তারও আগে তাকে ভালো ভাবে যাচাই করুন।
মনে রাখবেন তিনিই আপনার লাইফ লাইন!
সবার এমন একজন লাইফ লাইন থাকুক!
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস।
০৭-০৪-২০১৭
Depression : Let’ Talk!
লিখেছেন:
ডা. মৃনাল সাহা, প্ল্যাটফর্ম কাউন্সিলিং উইং চিফ
{ লেখাটি আপনারা ওয়েবের মাধ্যমে শেয়ার করবেন। প্ল্যাটফর্ম কতৃপক্ষ এর অনুমতি ছাড়া লেখাটা কপি করা যাবে না।}
প্ল্যাটফর্ম কাউন্সিলিং উইং এর ব্যপারে আপনাদের কোন প্রশ্ন থাকলে কিংবা কোন রকম কাউন্সিলিং সাহায্য এর প্রয়োজন হলে, [email protected] এই মেইল এড্রেস এ মেইল করুন। যদি চান আপনার নাম পরিচয় অপ্রকাশিত থাকবে।