ব্যথা নিয়ে আমার নিজের মাথাব্যথা কম। আমার নিজের পেইন থ্রেসল্ড খুবই বেশী। অন্য অনেক মেয়েই যে ব্যথায় বিছানায় গড়াগড়ি খায়, আমি দিব্যি সে ব্যথা নিয়ে চেম্বারে বসে রোগী দেখি। মাঝে মধ্যে রোগী না থাকলে সামান্য উহ্ আহ্ করি এই যা। রোগীদের সামনে তো আর সেটা করা যায় না। করলে রোগীরা ভাববে, যে ডাক্তার নিজেই ব্যথায় অস্থির সে আমার ব্যথা আর কিভাবে সারাবে? আসলে নিজের ব্যপারে অবহেলা বলেন আর ড্যাম কেয়ার বলেন,এটা আমার বরাবরের স্বভাব। দুটো উদাহরণ দিই, আমার নরমাল ডেলিভেরীর তাৎক্ষণিক পরেই আমি কারো সাহায্য ছাড়া দেয়াল ধরে হেঁটে হেঁটে বাথরুমে গেছি,পরদিন চার তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আবার বাসায় এসে দোতলায় উঠেছি। ঐসময় এপিসিওটোমি দেয়া থাকলেও এন্টিবায়োটিক ছাড়া আর কোন পেইন কিলার আমি খাইনি। এমনকি আমার ল্যাপারোস্কপির পরেও আমি মাত্র একটা ডাইক্লোফেন ইঞ্জেকশন নিয়েছিলাম। পেইন কিলারে আমার কিঞ্চিৎ এলার্জি আছে, পারতো পক্ষে আমি সেটা এড়িয়েই চলি। এটাকে খানিকটা ব্যথাবিলাসও বলতে পারেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যথাটা আসলে ঠিক কতক্ষণ পর্যন্ত বিলাস থাকে? প্রতিটা মানুষের ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা ভিন্ন। ধরুন, যে ব্যথায় আমি হাসতে হাসতে কাজ করি,সে ব্যথাই আপনার চক্ষে পানি এনে দিতে পারে মুহুর্মুহু। কিংবা ধরুন, যে ব্যথায় আমি বিছানায় গড়াগড়ি দিচ্ছি,সে ব্যথায় আপনি দিব্যি শপিং করে বেড়াচ্ছেন হাসিমুখে। এই যে মানুষভেদে ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা ভিন্ন, এটাই হল থ্রেসল্ড। কারো পেইন থ্রেসল্ড বেশী, অর্থাৎ ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা বেশী। আবার কারো পেইন থ্রেসল্ড কম অর্থাৎ ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা কম। এ নিয়ে অহমিকা করা বা হীনমন্যতায় ভোগার কোন সুযোগ নাই। মানুষে মানুষে অন্য সব ক্ষমতায় যেমন ভিন্নতা আছে, এখানেও তেমনি ভেদ আছে। ব্যথাবিলাস বলতে আমি বুঝি, থ্রেসল্ড পর্যন্ত ব্যথা সহ্য করা। নিজের থ্রেসল্ডের বাইরে কেউই কিন্তু ব্যথা সহ্য করতে পারেনা,করা উচিতও না।
এখন আসি ভয় প্রসঙ্গে। ব্যথানাশক ওষুধ বিষয়ক ভয়। এই ভয় আমাদের ডাক্তারদের ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক। আমরা সেই যুগে ডাক্তারী পড়েছি, যখন মানুষ অহরহ মুড়ি-মুড়কির মত লাল রঙয়ের ব্যথার বড়ি খেয়ে পেট ফুঁটা করে চলে আসতো, আর আমরা রোগীর পেটের গু পরিষ্কার করে পারফোরেশন রিপেয়ার শিখতাম। এই আমরা ডাক্তাররাই কিন্তু রোগীদের ভেতরে এই ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছি যে, যখনতখন কারণেঅকারণে লাল বড়ি খাওয়া যাবেনা। খেলেই পেট ফুঁটো হয়ে যাবে। আমাদের কাজে আমরা যথেষ্টই সফলতা পেয়েছি। কমে গেছে পারফোরেশনের রোগী। কিন্তু বেড়েছে লাল বড়ি ভীতি। এই যে,আজকাল সবাই দাঁতে দাঁত চিপে ব্যথা সহ্য করে থেকে যায়, এর মূলে আছে কিন্তু সেই লাল বড়ি ভীতি। অন্যদের কথা কি বলব! আমি নিজেই এখনো লাল বড়ি দেখলে ভয় পাই। চোখের সামনে ভেসে উঠে পারফোরেশনের রোগীর এক্সরে ফিল্ম।
আসলে হয়েছে কি জানেন! দিন বদলেছে, নতুন নতুন প্রযুক্তি এসেছে, কিন্তু আমরা আমাদের ব্যাসিক কিছু ভীতি মন থেকে সরাতে পারিনি। অন্যান্য অনেক পুরনো প্রযুক্তির মতই সেই কবেই চলে গেছে লাল বড়ির যুগ। এখন আর ব্যথানাশক ওষুধ মানেই লাল বড়ি নয়, আছে হরেক রঙয়ের,হরেক ঢঙয়ের ব্যথানাশক ওষুধ। সুতরাং, আপনার পুরনো চিন্তা ঝেড়ে ফেলার সময় হয়েছে। আর কিডনি কিংবা লিভার নিয়ে যারা চিন্তিত তাদের বলি, পাঁচ-সাতদিনের ব্যথানাশক ওষুধ কোন সুস্থ অঙ্গের উপরেই কোন প্রভাব ফেলার কথা না, কেবল অসুস্থ অঙ্গের ব্যথা কমানো ছাড়া। তবে ব্যাথার ওষুধের ক্ষেত্রে দুটো কথা অবশ্যই মনে রাখবেন। এক, কখনো এটি খালিপেটে খাবেন না। দুই,এর সাথে অবশ্যই একটি গ্যাসের ওষুধ খাবেন।
যাই হোক, ইদানীং আমার প্যাঁচাল পাড়ার স্বভাব হয়েছে। লিখতে চেয়েছিলাম, পিরিয়ডের ব্যথা নিয়ে, লিখে ফেললাম রামকাহিনী। পিরিয়ডের পেইনের অভিজ্ঞতা আমার মাত্র একবার হয়েছে, সেটাও আবার প্যাথলজিক্যাল। কাজেই আমি বুঝেছি,এটা কত ভয়ংকর হতে পারে। তবে সামান্য ব্যথা বা অস্বস্তি কিন্তু সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমাদের মা-খালারা বলেছেন, এই ব্যথা স্বাভাবিক, সুতরাং যেকোনভাবে এটাকে সহ্য করাটাই স্বাভাবিক জীবনের অংশ। আমাদের মস্তিষ্কে সেটা গেঁথে গেছে। তার উপরে ব্যথানাশক বড়ির ভীতি তো আছেই।কাজেই এ নিয়ে আমরা মেয়েরা তেমন উচ্চবাচ্য করিনি এতোকাল। এখন যখন পিরিয়ড বিষয়ক ট্যাবু ভেঙে গেছে, তখন অনেকেই পিরিয়ড চলাকালীন ব্যথা নিয়ে কথা বলছেন। কেউ পক্ষে,কেউ বিপক্ষে। আমি নিরপেক্ষ মানুষ। আমার বক্তব্য সহজ। সেটা পেশ করার আগে, পিরিয়ডকালীন ব্যথা(ডিজমেনোরিয়া) নিয়ে দুটো কথা বলি।
মেয়েদের একটা মাসিক চক্রে দুই ধরনের ব্যথা স্বাভাবিক। এক, প্রাইমারী ডিজমেনোরিয়া, যেটাতে পিরিয়ড শুরুর দিন থেকে এক বা দুই দিন তীব্র ব্যথা থাকবে, তারপর সেরে যাবে। এইটা প্রোষ্টাগ্ল্যান্ডিন নামক একধরনের হরমোনের প্রভাবে হয়। এই দুইদিন আপনি অনায়াসে পেইন কিলার খেতে পারেন। ডাইক্লোফেনাক খেতেই হবে এমন কোন কথা নেই, ন্যাপ্রোক্সেন, আইবুপ্রোফেন, এসপিরিন, মেফেনামিক এসিড ইত্যাদি যেকোন ব্যথার ওষুধ খেতে পারেন নিয়ম করে দিনে দু’বার। সেই সাথে একটা এন্টিস্পাজমোটিকও খেতে পারেন, যেমন- বিউটাপেন, টাইমোনিয়াম ইত্যাদি। এন্টিস্পাজমোটিকের সুবিধা হল এগুলো আপনি যেকোন সময় খেতে পারেন, এর সাথে খাবারের কোন সম্পর্ক নেই,এমনকি এর সাথে গ্যাসের ওষুধেরও প্রয়োজন হয়না। নিয়ম করে প্রতিমাসে দু’বেলা দু’তিনদিন উপরিউক্ত ওষুধগুলো খেলে আপনার কিচ্ছু হবেনা, বিশ্বাস করেন। বরং মাঝখান থেকে আপনি নির্দ্বিধায় কাটিয়ে দিতে পারবেন আপনার পিরিয়ডের দিনগুলি, আপনার বন্ধু বা কলিগরা জানতেও পারবেনা। এছাড়া নিয়মিত খাবার পিলও আপনার এই ব্যথা কমাতে সক্ষম। পিল ফোবিয়া যাদের আছে,তাদের বলি, পিলের ক্ষেত্রেও প্রযুক্তি অনেকদূর এগিয়েছে। মায়াবড়ির যুগ পেরিয়ে এখন ফোর্থ জেনারেশন পিলের যুগ এসেছে। কাজেই কমে এসেছে মুটিয়ে যাবার ভয়। অতএব,ট্রায়াল দিয়ে আপনার শরীরে স্যুট করবে এমন একটা পিল আপনি অনায়াসেই খুঁজে নিতে পারেন আপনার গাইনোকোলজিষ্টের সহায়তায়।
মাসিক চক্রের দ্বিতীয় আরেকটি সময়ে ব্যথা স্বাভাবিক, সেটা হল ওভুলেশন পেইন অর্থাৎ যে সময় ডিম ফুটে বের হচ্ছে আপনার ডিম্বাশয় থেকে,সে সময় একটা তীব্র ব্যথা অনুভব করেন কেউ কেউ। এটা সাধারণত মাসিক চক্রের মাঝামাঝি হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে এক’দুই ফোঁটা ব্লিডিংও হতে পারে সাথে। এটা খুবই ক্ষণস্থায়ী ব্যথা। এক ডোজ ব্যথার ওষুধেই কাজ হওয়ার কথা।
উল্লেখিত দুই ধরনের ব্যথা ছাড়া বাকী সব ধরনের ব্যথাই প্যাথলজিকাল অর্থাৎ জননতন্ত্রের কোন সমস্যার কারণে ব্যথা। সেরকম হলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে সমস্যা খুঁজে বের করুন এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা করুন।
পরিশেষ কথা, যে ব্যথা সহ্য করতে পারেন,যে ব্যথা আপনার স্বাভাবিক জীবনে প্রভাব ফেলে না সেটাই ব্যথাবিলাসের অন্তর্ভূক্ত,সেটা নিয়ে কথা বলার অবকাশ নেই। আর যে ব্যাথা আপনার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে,তাকে আপনি প্রশ্রয় দিবেন কেন? পিরিয়ডের মতই ভেঙে ফেলুন ব্যথাসহনের এই ট্যাবু। ব্যথাকে না বলুন, স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে নয়।
হ্যাপী ফেমিনিজম, হ্যাপী পিরিয়ড।
ডাঃ ফাহমিদা_নীলা
FCPS( Gynae & Obs)
অনুলিখন: জামিল সিদ্দিকী
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ,গাজীপুর