আজকে আমরা কথা বলব ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে। এ রোগের সচেতনতার জন্য একটি দিবস পালন করা হয়, ‘নো ব্রা ডে’। অনেকে আবার পিংক ব্যাজ ধারণ করেন, বলেন, ‘থিংক পিংক’। আসল কথা হচ্ছে, সচেতনতা তৈরী। সেটা যেভাবেই হোক না কেন।
মূল গল্পে চলুন:
দয়িতা। পঁচিশ/ ছাব্বিশ বছরের তরুণী। শরতের আকাশের মতো ঝকঝকে। কিন্তু চোখ দুটো ভয়ার্ত, বিষন্ন! যেন মহাবিপর্যের কার্নিশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা শুধু ধ্বসে পড়ার।
– বসো। কি করো?
– অনার্স শেষ, মাস্টার্স করছি।
– বিয়ে করেছো?
– হুম একটা বাচ্চা আছে, তিন বছর।
– সাথে কে এসেছে?
– আম্মু।
মায়ের চোখে মুখে উৎকন্ঠা দ্বিগুণ।
– আচ্ছা মা, কি হয়েছে বলেন তো শুনি?
– আপা, আমার মেয়ের বুকে চাকা না কি যেন।
কথা শেষ করতে পারে না, চোখ ভরে যায় জলে।
মা, মেয়েকে আশ্বস্ত করলাম। যা শুনলাম, মূল কথা হচ্ছে ওর ব্রেস্টে চাকা অনুভব করছে কিছুদিন যাবৎ। সাথে স্কিন চেঞ্জ। মাঝে মাঝে রেড কালার নিপল ডিসচার্জ! আগে খেয়াল করে নি।
সবগুলো লক্ষণই ব্রেস্ট ক্যান্সারের দিকে যায়। ক্লিনিক্যাল আর ল্যাব পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলাম। অনেকটা ছড়িয়েছে। অথচ একটু সচেতন হলেই এই মরণব্যাধি দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হতো।
– আগে আসনি কেন?
– ম্যাম, ভেবেছিলাম তেমন কিছু না। তাছাড়া ব্যথাও তেমন নাই। তাই ভাবলাম সিরিয়াস কিছু না।
আহারে মেয়ে! তুমি যদি জানতে পৃথিবীর সমস্ত ঘাতকরা এমন নীরবেই হানা দেয়! ঢোল পিটিয়ে আসলেতো তাদের মিশন সফল হবে না।
আসলে ব্যথা বেদনা না থাকলে আমরা রোগীরা সাধারণত ডাক্তারখানা যেতে চাই না। আর ক্যান্সারগুলি এমন! চারদিকে না ছড়ানো পর্যন্ত এক ফোঁটা ব্যথা দিবে না। যেন মনিবের প্রতি তার দয়া অসীম!
দয়িতার পরের প্রশ্ন,
‘ম্যাম, আমি বাঁচবো তো? আমার এক খালার এমন হয়েছিলো, তার ব্রেস্ট কেটে ফেলতে হয়েছে। আমারও কি তাই হবে?’
দয়িতার টলটলে চোখের দিকে তাকিয়ে কী বলেছিলাম? আসুন আরেকটু জানি এ মরণব্যাধি সম্বন্ধে। আসলে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই চাইলে এর ভয়াবহতা কিছুটা হলেও কমবে।
* কত জনের হয়?
প্রতি আটজন মহিলার মধ্যে একজনের হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সারা বিশ্বে যতগুলো ক্যান্সারজনিত কারণে মহিলাদের মৃত্যু হয় তার মধ্যে এটা দ্বিতীয়, প্রথম কারণ ফুসফুস ক্যান্সার। তবে এখন এটা প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছে।
* কেন হয়?
অনেকগুলো রিস্ক ফ্যাকটর আছে। তার মধ্যে রয়েছে – জিনগত, পারিবারিক, এইচআরটি(হরমোন), আগে মাসিক হওয়া, পরে মাসিক বন্ধ হওয়া, দেরীতে বাচ্চা নেওয়া এবং বাচ্চাকে বুকের দুধ না খাওয়ানো।
* কিভাবে বুঝবো?
ব্রেস্টে চাকা, বগলের নিচে চাকা, চামড়া কমলার খোসার মতো হয়ে যাওয়া, নিপল দিয়ে লালচে রক্ত বা পু্ঁজ পড়া, নিপল দেবে যাওয়া ইত্যাদি।
* শনাক্ত করবো কিভাবে?
সেল্ফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন- অর্থাৎ প্রতিটা মেয়ে বা মহিলা প্রতি মাসে মাসিক শেষ হওয়ার পর নিজে নিজের ব্রেস্ট পরীক্ষা করে দেখবে কোন চাকা বা অস্বাভাবিকতা আছে কিনা। থাকলে সাথে সাথে ডাক্তার দেখাবে।
ক্লিনিক্যাল ব্রেষ্ট এক্সামিনেশন- প্রতি তিন বছর পরপর ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করাবে।
* কখন থেকে?
বিশ বছর বয়স থেকে পয়ষট্টি বছর পর্যন্ত।
* শনাক্তকরণ:
ক্লিনিক্যাল, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, ম্যামোগ্রাফি ও বায়োপসি।
* রোগ প্রতিরোধ:
যথেচ্ছা হরমোন না নেওয়া, বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো, রেগুলার সেল্ফ ব্রেষ্ট এক্সামিনেশন করা এবং ডাক্তার দিয়ে ক্লিনিক্যাল ব্রেষ্ট এক্সামিন করানো।
* চিকিৎসা- আর্লি স্টেজ:
সার্জারি হচ্ছে প্রধান চিকিৎসা। মাস্টেকটমি অর্থাৎ এফেক্টেড ব্রেস্ট কেটে ফেলা, এছাড়া আরো অনেক পদ্ধতি আছে।
* চিকিৎসা- এডভান্সড স্টেজ:
রেডিওথেরাপি অর্থাৎ সেঁক বা রেডিয়েশন দিয়ে ক্যান্সার কোষকে নষ্ট করা। অনেক ক্ষেত্রে সার্জারির পরেও রেডিয়েশন এবং কেমোথেরাপি দিতে হয়।
* চিকিৎসার ফলাফল:
খুব একটা ভালো না। যতগুলো রোগী শনাক্ত হয়, তার প্রায় অর্ধেকই মারা যান। দ্রুত শনাক্তকরণ, সঠিক চিকিৎসা, নিয়মিত ফলো আপ এবং প্রবল জীবনীশক্তি এ রোগ থেকে জীবন ছিনিয়ে আনে।
* কোথায় চিকিৎসা হয়?
জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল, বড় বড় মেডিকেল কলেজ এবং কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।
নারীরা সাধারণত স্বামী, সন্তান, সংসারের দায়িত্ব নিতে নিতে নিজের কথা ভুলে যান। নিজেকে আলাদা সময় দেন না। নিজের অসুস্থতাকে গুরুত্ব দিতে চান না। ফলে যে রোগ সহজেই নিরাময়যোগ্য, তা অনিরাময়যোগ্য হয়ে পড়ে।
মা, নিজের যত্ন নিন। নিজেকে ভালোবাসুন। আপনি না থাকলে আপনার প্রিয় মানুষদের কী হবে? আপনার ভালোবাসার সংসারেরই বা কি হবে? আর পুরুষদের বলছি, প্রতিটি মেয়েই বাবার রাজকন্যা, আবার কারো না কারো মা। নারীদের অনেকগুলো পরিচয়ের মধ্যে এ দুটো পরিচয় অনন্য, অন্তত আমার তাই মনে হয়। আসুন বাবার রাজকন্যার জন্য আর সন্তানের মায়ের জন্য কিছু করি।
সাবিকুন নাহার
শেবাচিম
ব্যাচ ৩০
প্ল্যাটফর্ম ফিচার রাইটার:
সামিউন ফাতীহা
সেশন ২০১৬-১৭
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর