বালিকার জন্ম পোল্যান্ড এ, ১৮৬৭ সালে। জ্ঞান হওয়া থেকে বাবার বিজ্ঞান চর্চা তাকে মুগ্ধ করে। দাদার শিক্ষকতা, বাবার বিজ্ঞান চর্চা আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, বাবা-মায়ের সবচাইতে ছোট্ট মেয়েটিকে জ্ঞানের জগতে হারানোর আনন্দ কি তা বোঝাতে কালক্ষেপণ করেনা। ১৬ বছরেই গ্রাজুয়েশন শেষ করা, গোল্ড মেডাল প্রাপ্তি -তাই প্রমাণ করে। দেশের অনেক চড়াই উৎরাইয়ের সাথে সাথে বালিকার জীবনেও ঘটতে থাকে বিচিত্র সব প্রতিবন্ধকতা। পরিবারের আর্থিক অবনতি, গভার্নেস এর চাকুরী, কারও প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে পরিবারের সিদ্ধান্তকেই মাথা পেতে নেওয়া এরকম আরও প্রতিবন্ধকতাও তাকে বিজ্ঞান চর্চাকে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। এই বিজ্ঞানমনস্কতাই তাকে টেনে নিয়ে যায় ইউনিভার্সিটি অব প্যারিস, Sorbonne এ ১৮৯১ সালে। প্যারিস এর রংগীন, মুক্ত জীবন নয়, বরংচ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি এবং ল্যাবরেটরি ই ছিল তার আকর্ষণের কেন্দ্র। ঘন্টার পর ঘন্টা তার পার হয়ে যেত এসব যান্ত্রিক মুগ্ধতায়! বালকের জন্ম তারও পূর্বে, ১৮৫৯ সালে প্যারিস এ। তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, বাবার হাতেই তার হাতেখড়ি। অংকের প্রতি তীব্র আকর্ষণ ১৬ তেই এনে দেয় ডিগ্রি, এবং ১৮ তে উচ্চতর ডিগ্রি। অর্থাভাবে আর ডক্টরাল করা হয়নি। ইন্সট্রাক্টর হিসেবে যোগদান করেন ইউনিভার্সিটি অব প্যারিস এর ল্যাবরেটরি তে। বিজ্ঞানই তার ভালবাসা, বিজ্ঞানই তার মুগ্ধতা। কিন্তু যতদোষ ঐ ল্যাবরেটরির! সেদিন চৈত্র মাস ছিল কনা জানিনা। বালক ঐ বালিকার চোখে সর্বনাশ দেখেছিলেন কি না জানি না; তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় তিনি বালিকার চোখে বিজ্ঞান দেখেছিলেন! বালিকাও দেখেছিল নিশ্চয়, তারপরও কোথাও কোন কিন্তু থেকে যায়। বালকের একের পর এক আবাহনে সাড়া নাই কোন! জানা যায়, দেশের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বালিকার। পোল্যান্ড এ ফিরে যেতে চান তিনি। বালক বড়ই নাছোড়বান্দা! তিনি পোল্যান্ড এ যেতেও প্রস্তুত জানান। কিন্তু সব কিছু ফেলে বালিকা আবার স্বদেশে পাড়ি জমান, পেছনে থেকে যায় এক বিজ্ঞানমনস্কের ভালবাসা। হতে পারত এটা কোন উপন্যাস অথবা ছোট গল্পের কিম্বা চলচিত্রের অংশবিশেষ। হতে পারত কোন ট্র্যাজিক সমাপ্তি কিংবা বালকের পোল্যান্ড এ গিয়ে – fairy tales এর happy forever ধরনের কোন জীবনের শুরু! কিন্তু গল্পটা যে কেবল গল্পই নয়। বালক যখন পিয়েরে কুরি আর বালিকা যখন মেরি কুরি তখন বাস্তবতা গল্পকে হার মানাবে বইকি! মেরি পোল্যান্ড এ গিয়ে বুঝলেন তার স্বদেশ তার জন্য এখনও অপ্রস্তুত। পোল্যান্ড তখনও পিএইচডি তে মেয়েদের অংশগ্রহণ সমর্থন করেনা। ওদিকে পিয়েরের আবাহনে সাড়া না দিতেও হয়তো তার মন সায় দিচ্ছিল না। অত:পর ১৮৯৫ সালে ইতিহাসের সর্বসেরা ২ বিজ্ঞানীর পরণয়ের পরিণতি ঘটল। এরপর গল্পগাঁথা কেবল সাফল্যের। ১৮৯৮ এ পোলনিয়াম এবং রেডিয়াম এর আবিস্কার।১৯০৩ এ ফিজিক্স এ বেকরেল এর সাথে এই দম্পতির নোবেল প্রাপ্তি, Davy Medal, Elliott Cresson Medal আরও কত কি! ১৯০৬ সালে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করেন পিয়েরে কুরি। কিন্তু মেরি স্বামির এই বিজ্ঞান ভালবাসাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন বহুদূর পরবর্তিতে। টিউমার চিকিৎসায় রেডিও আইসোটোপ এর ব্যবহার তারই পরিচালনায় হয়। ১৯১১ সালে আবার নোবেল পুরস্কার পান মেরি, তবে এবার কেমিস্ট্রি তে। তিনি ১ম নারী যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, একমাত্র নারী যিনি ২ বার নোবেল পেয়েছেন, একমাত্র ব্যক্তি যিনি ২ টা বিষয়ে নোবেল পেয়েছেন। অসমভব মেধাবী এই বিজ্ঞানী মৃত্যু বরণ করেন মাত্রাতিরিক্ত রেডিয়েশন এরই জটিলতায় – Aplastic anaemia মতান্তরে লিউকেমিয়ায় ১৯৩৪ সালে! এই কুরি দম্পতির কন্যা ও তার জামাতা ও পরবর্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এই পরিবারের কথা চিন্তা করলে মনে হতে পারে যে, নোবেল পুরস্কার চালুই হয়েছিল বোধ হয় এই পরিবারের জন্য! যাইহোক, কুরি দম্পতির অবদান লেখার জন্য এ লেখা নয়। সে কথা এই ২/৪ কথায় শেষ হবার নয়। এই লেখা ২ বিজ্ঞানীর ভালবাসার পরিণতির গল্প। যে ভালবাসা কি না পরিণতি দান করেছে বিজ্ঞান কে। এ গল্প হয়তো চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোন গল্প নয়, তবে এ গল্প তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য যে সকল দম্পতি চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে যুক্ত আছেন, যারা স্বপ্ন দেখেন আরেক মেরি ও পিয়েরে কুরি হওয়ার!
You May Like
-
6 years ago
সিউডো সাইকিয়াট্রি : বিস্তারিত জানুন
-
5 years ago
করোনায় স্বাস্থ্যব্যবস্থার সক্ষমতা ও দায়