এবার যিনি আমার অধীনে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, তিনি শুধু ভি আই পি নন, (দুইটা ভি সহ) ভি ভি আই পি। অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে হাসপাতালের ফাইভ স্টার সুইট এ ভর্তি হয়েছেন। প্রথম সাক্ষাতেই আমার সঙ্গে পরিচিত হলেন, নিজের ডাক নাম দিয়ে । এটা অবশ্য আমেরিকাতে খুবই স্বাভাবিক। যে টা আমাকে মুগ্ধ করল, রোগের জটিলতার কারণে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ছিলেন, সেই ডাক নাম-এ ই সীমাবদ্ধ রইলেন। নামের বেশি নিজের সম্পর্কে কখনো বলেননি। পদ, পদবি ও ক্ষমতার কোন বাহুল্য দেখান নি। অতিরিক্ত আবদার করেননি। Round-এ যেয়ে সুইটে দেখা হয়েছে, হেলথ সিস্টেম এর CEO, ডিরেক্টর ও কর্তা ব্যক্তি দের সাথে। বুঝতে পেরেছি, তিনি ক্ষমতাধর ব্যক্তি। পরে ইন্টার নেটে দেখেছি, কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারা কখনো, এটা কর, ওটা কর, সে টা বলেন নি। ফলে,আমি ও আমার টিম চাপমুক্ত হয়ে চিকিৎসা দিতে পেরেছি। ফেরার সময় আমার টিম এর সবচেয়ে জুনিয়র ইন্টার্নী ডাক্তার ও মেডিকেল ছাত্র কে ও ধন্যবাদ দিতে ভুলেন নি। বাড়ি ফিরে আমাকে ও আমার অধীনে সব ডাক্তারদের ও ইউনিটের নার্সদের ধন্যবাদ কার্ড পাঠিয়েছেন। এই ঘটনা লিখছি বলে, মনে হতে পারে, এটা ব্যতিক্রম। ইউনিভার্সিটি কেন্দ্রিক বড় একটা হেলথ সিস্টেম এ কাজ করার সুবাদে প্রায়শই দেখা হয় তারকা বা ভি আই পি রুগীর সাথে। আমেরিকাতে ডাক্তার জীবন এ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় এটাই জেনেছি স্বাভাবিক। জবাবদিহিতা এই সম্মানের একটা বড় কারণ। এখানে ডাক্তারদের প্রাপ্য সম্মান দিতে কারো আপত্তি নেই, তিনি যতটা ক্ষমতাধরই হউন না কেন। ডাক্তারদের অবশ্য তাই বলে, ফ্রি পাস নেই, এদেশে। ইচ্ছাকৃত, বা ক্ষেত্র ভেদে অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্যও বড় দণ্ড দিতে হয়।
মনে পড়ে, ঢাকা মেডিকেল কলেজে এ ইন্টার্নশিপ কালীন সময়ের কথা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেউ একজন ভর্তি হয়েছিলেন কেবিনে। জুনিয়র ডাক্তারদের তো বটেই, অধ্যাপক সাহেব-এর ও জুতার সোল ক্ষয়ে গিয়েছিল কয়েক দিনেই। আমার একবছর ইন্টার্নশিপ কালীন সময়ে ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সি ভাংচুর হয়েছে, কয়েকবার। অশিক্ষিত স্বাধারন রুগী নয়, পার্শ্ববর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর উচ্চ শিক্ষিত ছাত্রদের হাতে। সিলেটে যখন কাজ করি, মেডিকেলের এক ছাত্রনেতা-কে অফিসের গাড়ি দেই নি বলে, আমার ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। সে অবশ্য অনেক আগের কথা। পত্র-পত্রিকা-য় সদ্য পাস করা ডাক্তার দের লেখা দেখে বুঝতে পারি, সেই ট্র্যাডিশন বহাল তবিয়তে বজায় আছে। আমলা, রাজনীতিবিদ, মাস্তান আর অর্থবানদের দাপটে চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থার ত্রাহি অবস্থা। এটা বুঝা কঠিন নয়, একটা ভেঙ্গে পড়া সিস্টেমের সংস্কার করতে চাইলে, সবার আগে প্রয়োজন, মানসিকতা (attitude) এর পরিবর্তন। আরেকজন কে যথাযথ সম্মান দিতে পারার সংস্কৃতি (culture) প্রয়োজন। সেটা যতদিন না হবে, যে কোন সংস্কার-ই হবে ক্ষণস্থায়ী। আমরা অনেকটা পালিয়ে বেঁচে স্বস্তি পাই,বাইরে থেকে কাড়ি কাড়ি উপদেশ বিলাই। কিন্তু কাজটা যে কত কঠিন, সেটা নিয়ে বিন্দু মাত্র সন্দেহে ভুগি না। তবু ও আশা করব আমাদের নতুন প্রজন্মের ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দেবেন না।
লেখাটি লিখেছেনঃ ডাক্তার অসিত পাল
তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে ৪১ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন।
বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত।
বাস্তবের আলোকে লেখা।