এরকম একটা তাজা প্রাণ তুলে নিলেন, আল্লাহ আপনার বিচার কইরবো ।
আমার ছেলের বন্ধুরা আপনার বিচার কইরবো,
আমি কিছুই কইরবো না আপনারে,
আল্লাহর গজব পড়বো আপনার উপরে ।
আপনে না জাইন্না ছোট্ট একটা পোলারে ইঞ্জেশন করাইলেন,
আইজ তাজা একটা প্রাণ শেষ কইরা দিলেন,
ছেলেডা সকালে বিশটা টেহা আইনছে আমার কাছ থেইকা,
(বাবার কান্না জড়ানো শব্দগুলো বোঝা যাচ্ছিলো না, ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসারের পাশে এবং সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলো কেউ উৎকন্ঠিত কেউ, উত্তেজিত, সাইডে যাও-পাশ থেকে কেউ একজন বলছে…দু তিনটে শব্দ মিস হয়ে গেছে)
পাঁচশডা টাহা আমারে দিবো, আমি কাইলকা মেডিকেল যাব(তিনি সম্ভবত নিজেই অসুস্থ)
এই স্যারে মানুষ করছে আমার ছেলেডারে, সম্পূর্ণ সহযোগিতা করছে,
মানুউউষ আপনারা কসাই কসাই…(আই আই চিৎকার , ধাতব-জান্তব শব্দ আসছে ইমারজেন্সি রুমের বাইরে থেকে, রুমের ভেতরের মানুষেরা কেঁপে কেঁপে উঠছে, ভয়ার্ত চোখে দরজার বাইরে তাকাচ্ছে)
আপনারা কসাই, তাজা প্রাণ নষ্ট কইরা দিছেন আপনারা-
(বাবা যা হবার তাই হয়েছে-কাঁধে হাত রেখে একজন উনাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে)
(এইডাই এইডাই একই কথা আল্লাহর…এই লোকদের হাতেই মানুষ ভালোও হয়…শব্দগুলো বোঝা যাচ্ছেনা, নীরব দর্শকদেরা মাঝে একটু চাঞ্চল্য, বাইরে আওয়াজ বাড়ছেই… আল্লাহ এইডার বিচার করবো)
রুমে মাঝে উত্তেজনা বাড়ছে, একজন সম্ভবত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের লোককে বাইরে গিয়ে থামাতে/সামলাতে বলছে, একজন রোগীর সাথে আসা অন্যদের বোঝানোর চেষ্টা করছে পলকহীন চোখে-হাত নেড়ে নেড়ে, নিহত ছাত্রের বাবা ফোনে কান্না জড়িত কন্ঠে হ্যালো হ্যালো করছেন, তাঁর পাশে একজন ফোনে বলছেন-না না লাশ বাহিরে…এবার নিয়ে আসো)
ভাই আমার ছেলেডা __কলেজে পড়ে, আমার ছেলেডা মারা গেছে ।
ভাই এখানে…(বোঝা যাচ্ছে না) এখানে ভুল চিকিৎসা কইরা মাইরা ফেলছে…
এবার ফাইনাল ইয়ারে, হাজার হাজার পোলাপান…(তখনই হাজার কন্ঠের আই আই চিৎকারে বাবার কথা চাপা পড়ে, আরেকটা ভীত কন্ঠ একজনকে বলছে-ভাই ওইদিকে যাইয়েন না, আল্লাহরস্তে আপনারা… চিৎকার বাড়ছে, গণরোষ একটু পরে ভাংচুর আর আক্রোশে ফেটে পড়বে হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীর উপর) ।
ভাইয়া প্লিজ প্লিজ প্লিজ…রোগীর সাথে আসা একজন কি যেন বলছে । (ভাই সেটেল করেন এটা সেটেল করেন…বাইরে চিৎকার এবার আত্মা হিম করে দেবার মতই)
হ ভাইয়া পিডাইছে, গেট-টেট ভাইঙ্গা লাইতাছে ভাই ( বাবার ফোনে কথা চলছে)
আমার সেন্টিমেন্টে লাগছে কি আমার ছেলেও ছিল, আমার ছেলে কে সেডিল আনতে দিছে, সে সেডিল আনছে…(রোগীর সাথে আসা একজন বলছেন, পাশ থেকে একজন বলছে তিন চারশ লোক বাইরে, ক্যামেরা রুম থেকে বের হয়ে আসছে)
কলাপসিবল গেটের বাইরে বিক্ষুব্ধ জনতার গর্জন, গেট ভাঙ্গার শব্দ, ইমার্জেন্সি রুমের নীরব দর্শকেরা সে গেটের দিকে ছুটে যাচ্ছে । পুলিশের ইউনিফর্ম পরা একজন হাত উঁচিয়ে এপাশ থেকে ক্রোধে উন্মত্ত মানুষদের নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করছে, তার পাশে সাদা শশ্রুমণ্ডিত সাদা পাঞ্জাবী পরিহিত একজন ওপাশের মানুষদের উত্তেজিত করছে না থামাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না । ১৩ এপ্রিল ২০১৪ তারিখে এমনই এক পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের সাদা এপ্রন দুর্বৃত্তের আঘাতে আঘাতে রক্তে লাল হয়েছিল বারডেমে । আর কয়েক মুহুর্ত পর একই ঘটনা ঘটবে অনুমান করা যাচ্ছে, গেটটা ভেঙ্গে পড়লেই মুহূর্তে মধ্যেই তাণ্ডবলীলা শুরু হবে । ইমারজেন্সি রুমের লোকেরা এবার দৌড়ে পাশের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে , রোগীর লোককে উপস্থিত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য উত্তেজিত জনতা কে শান্ত করতে সামনে নিয়ে যাচ্ছে…ভিডিও ফুটেজ এখানেই থামল ।
ভিডিও ফুটেজ দেখে আমি প্রত্যেকটা মুহূর্তের সত্য বর্ণণা লেখার চেষ্টা করেছি, উপস্থিতদের উচ্চারিত প্রত্যেকটি শব্দ লিখেছি । কিন্তু যেটা লিখতে পারিনি, একজন মধ্য বয়স্ক বাবার সন্তান হারানোর তীব্র কষ্টের কথা, অকালে সহপাঠী হারানোর যন্ত্রণার কথা, প্রত্যেকজন রোগীকে ইমার্জেন্সিতে একজন চিকিৎসক কতটা উৎকণ্ঠা নিয়ে দেখেন, চিকিৎসক ছাড়া হাসপাতালের অন্যান্য স্টাফ, কর্তৃপক্ষ কতটা অবদান রাখেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শুধু ঐ হাসপাতালেই নয় স্বাস্থ্য সেবার সাথে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তি কতটা অনিরাপদ থাকেন, কী ইউনিয়ন সাব সেন্টার-উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-বারডেম অথবা সর্বোচ্চ চিকিৎসা হাসপাতাল সব খানেই অহরহ ভুল চিকিৎসার অজুহাতে হামলা, সংবাদমাধ্যম কর্মীদের আরেকটা কাটতির নিউজ, বিদেশের একটি মহল যারা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে অস্থিতিশীল করতে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে তাঁদের দুকান বিস্তৃত হাসির কথা ।
ছোট বেলায় চিকিৎসকদের জাদুকর ভাবতাম । শৈশবের দুরন্তপনায় দিন শেষে পা ব্যথা, মজার আইসক্রিম সাবাড় করে গলার দু টনসিল ফুলিয়ে জ্বর-মা বলতেন ডাক্তারের কাছে গেলেই সব অসুখ সেরে যাবে । শুক্রবারে বিকেল সাড়ে তিনটার বাংলা সিনেমার পাঁড় ভক্ত ছোট্ট আমি জানতাম নায়কগুলি মাথায় গুলি খাক আর ট্রেনে চাপা পড়ুক কোন মতে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারলেই জাদু-অপারেশন সাকসেসফুল । আর না বাঁচলে রোগী ধরবে ডাক্তারের কলার-ডাক্তার তুই আমার মাকে মেরে ফেলেছিস শয়তান । আরেকটু বড় হয়ে জানলাম, না ডাক্তাররাও মানুষ-আমার নানা চেইন স্মোকার নানা ফুসফুসের ক্যান্সারে মারা যায় । কিভাবে কিভাবে যেন ক্লাসের সামনের সারির আমরা বন্ধুরা সব ডাক্তারী পড়তেই ভর্তি হলাম । এবার জানলাম কত কী পড়তে হয়, রাত দিন ২৪ ঘন্টা করে পাঁচ-ছয় বছর, বড় ডাক্তার হতে হলে আরো দশ-কুড়ি বছর । কত পরীক্ষা, কত নির্ঘুম রাত, কত যন্ত্রণা-মানসিক অত্যাচার । তবেই আমি একটা রোগীর চিকিৎসা ভুল কী শুদ্ধ হয়েছে আন্দাজ করতে পারি, মেডিকেলের পাঁচ বছর, এক বছর ইন্টার্নি, দেড় বছর লেকচারার, ছয় মাস বিএসএমএমইউ দেশের সেরা হাসপাতালে রেসিডেন্সি এরপর সাড়ে পাঁচ মাস সরকারি ডাক্তার হিসেবে গ্রামে কাজ করেও আমি শুধু মাত্র ভুল চিকিৎসা হয়েছে কী হয়নি শুধু মাত্র ধারণা করতে পারি, অথরিটি নই-অথরিটি হতে হলে নূন্যতম বিশেষজ্ঞ হতে হয় । আর সেখানে বাংলার আপামর জনতা ভুল চিকিৎসা এক সেকেণ্ডেই ধরে ফেলে এবং ভুল চিকিৎসার শাস্তিই দিতে দেরি করে না । যশোরের মনিরামপুরে একজন সরকারি চিকিৎসকের মাথা হাতুড়ি দিয়ে গুড়ো করে দেয় । খুলনার এক বেসরকারী মেডিকেলের কর্তব্যরত চিকিৎসক কে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় । গতকালকের ভিডিওটা আমি ডাউনলোডের অনুমতি এখনো পাইনি, যদি চিকিৎসক বা মেডিকেল স্টুডেন্ট হন তবে প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করা আছে দেখে নিন ।
সাধারণ মানুষ যতক্ষণ না বুঝবে চিকিৎসক একজন রক্ত মাংসের মানুষ, আপনার রোগীটাও একজন মরণশীল মানুষ । আমাদের আয়ত্বের বাইরেও আপনার আত্মীয়টা অসুস্থ হতে পারে, আমাদের সকল প্রচেষ্টার পরও তাঁর মৃত্যু হতে পারে । আমাদের উপর আস্থা হারানোর জন্য সকল আয়োজন গণমাধ্যম, বিদেশী হাসপাতালের দালালেরা, জনগণের বন্ধু হাতুড়ে কোয়াক অথবা স্বাস্থ্য সেবারই কিছু মানুষেরা করে রেখেছে । একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি শুধু আমার জ্ঞান থেকে চিকিৎসাটাই দিতে পারি-আমার সহকারী যে চিকিৎসা সহায়তা দেবে সে কেমন ব্যবহার করবে, বকশিশ চাইবে কিনা, হাসপাতালে বিনামূল্যের ওষুধ থাকবে কিনা, ওষুধই বা ভালো মানসম্মত হবে না বিষ হবে, ইসিজি মেশিন-এক্সরে মেশিন থাকবে কিনা, থাকলেও চলবে কিনা, ওয়ার্ডে বিছানা পাবেন কিনা, বিছানায় চাদর, ওয়াশরুমে পানি থাকবে কিনা সেটা আমাদের ক্ষমতার মাঝে কুলায় না ।
এ লেখায় আমি ঐ হাসপাতালের কোন আত্মপক্ষ সমর্থন করিনি, উত্তেজিত জনতার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ ও করছিনা, যেহেতু মৃত ছেলেটির মৃত্যুর কারণ, কে দোষী বা নির্দোষ আইনের বিবেচিত বিষয়, কিছু বিচ্ছিন্ন তথ্য আমি যোগাড় করতে পারলেও এখানে বলছি না । শুধু একটা অনুরোধ করছি ডাক্তারদের হাতে এমন কোন ওষুধ (এ ঘটনায় তথাকথিত ইঞ্জেকশন) নেই যেটা দেয়া মাত্র একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ যে কিনা অল্প আহত হয়ে হাসপাতালে এসেছে সে মারা যেতে পারে, বা বাংলাদেশের কোন ডাক্তার তার নিজ সামর্থ্যের ভেতরে কোন রোগীকে ইচ্ছায় বা অবহেলায় মরতে দিতে পারে ।
(উপজেলায় সপ্তাহে একদিন ২৪ ঘন্টা ইমার্জেন্সি ডিউটি করি, আমি জানি এরকম ঘটনা যে কোন মুহূর্তে আমার সাথেও ঘটতে পারে, বাংলাদেশের যে কোন ক্লিনিকে-হাসপাতালে ঘটতে পারে) ।
এ লেখায় কোন সমাধান দেয়া সম্ভব নয়, শুধু বলি আস্থা রাখুন, আপনাকে অসহায় রাখলে উত্তেজিত রাখলে ব্যক্তিগতভাবে একজন চিকিৎসক ছাড়া অন্য অনেকের অনেক লাভ আছে । সরকার দেশের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করণে অসম্ভব ভালো কাজ করছে, সুফল পেতে ধৈর্য আর বিশ্বাস রাখেন-ঠিক এই জিনিসটাই নষ্ট করতে চাইছে একটা মহল । আর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন সম্ভব হলে একটা হট নাম্বার সার্বক্ষণিক চালু রাখার যেখানে স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কিত কোন ঘটনা দুর্ঘটনা যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আনা যায় যে কোন ইমার্জেন্সিতে ।
মোহিব নীরব