লিখেছেনঃ ডাঃ সুরেশ তুলসান
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ।
অর্শ,গেজ,ভগন্দর চিকিৎসালয়।
———————
রোগী (১) – আজ একটা রোগী এলো অনেক দূর থেকে। মলদ্বারে কবিরাজি ঔষুধ লাগানোর পর সম্পুর্ন মলদ্বার পুড়ে দগদগে ঘা হয়ে গেছে। কার কাছে যেন শুনেছে অন্য একজন রোগীর মলদ্বার কবিরাজি ঔষধ লাগিয়ে পুড়ে যাওয়ার পর আমার চিকিৎসায় ভালো হয়েছে।
ইস বেচারা কবিরাজি ঔষধ দিয়ে মলদ্বার পুড়ে যেতে পারে এটা যদি আগে কারও কাছে শুনতে পেত তাহলে হয়তো ওর জীবনে এতো বড় অঘটন ঘটতো না।
রোগী (২)- হুঁ রোগীটি ঠিকই শুনেছে। এরকম অনেক রোগীর চিকিৎসাই আমাকে করতে হয়েছে। মনে পড়ে গেল আর এক অল্প বয়সী মেয়ের কথা। সবে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ছুটাছুটি করছে। এর মধ্যে ভালো একটা পাত্র হাতছাড়া হবে এই ভেবে বাবা মা ওর বিয়েও ঠিক করে ফেলেছে। বেশ লম্বা, সুশ্রী, স্মার্ট। এক কথায় পাত্রী হিসাবে বেশ ভালো। হাতে মেহেন্দিরর রঙ। মাত্র কয়দিন হল বাকদানও হয়ে গেছে। মেয়ের মলদ্বারে সামান্য কিছু সমস্যা ছিল হয়তো, রোগের উপসর্গ শুনে আমার মনে হয়েছিল হয়তো এনাল ফিসার ছিল। ঔষধেই ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। অপারেশন লাগলেও অতি মাইনর অপারেশন, এবং দুদিনেই সুস্থ্য হয়ে যাওয়ার কথা। বাবা মা ভাবলেন বিয়ের আগেই মেয়েকে সুস্থ্য করে তুলবেন। তাই নিয়ে গেলেন এক কবিরাজ এর কাছে। কবিরাজ আট হাজার টাকা নিয়ে মলদ্বারে কি যেন একটা ঔষধ লাগিয়ে দিলো। তাতেই পুরো মলদ্বার পুড়ে চামড়া খসে পড়লো। আমার কাছে যখন মেয়েটা প্রথম আসে তখন ওর হাতে মেহেন্দিরর রঙ আর সম্পুর্ন মলাদ্বার আর আশেপাশের এলাকাজুড়ে দগদগে ঘা। আর রক্ত পুঁজের কষানি ঝড়ছে। মলদ্বার বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই । সেই মুহুর্তে আমার তেমন কিছুই করার ছিল না। কিছু এন্টিবায়োটিক, ব্যথানাশক আর হিপবাথ দিয়ে বাড়ী পাঠালাম। প্রায় দুই মাসের চিকিৎসায় ওর মলদ্বার আর আশেপাশের ঘা শুকালো ঠিকই কিন্তু মলদ্বার সংকুচিত হয়ে ছোট্ট একটা ছিদ্রে পরিণত হলো। রোগী আর মলত্যাগ করতে পারে না বললেই চলে। পরীক্ষা করে দেখলাম আমার কনিষ্ঠ আংগুলির মাথাও ঠিক মত প্রবেশ করে না। এই অবস্থা কে বলে “Severe anal stenosis”. রোগীটির মলদ্বার আমি ঠিক করে দিয়েছিলাম এনোপ্লাস্টি (Anoplasty) নামক একটি অপারেশন করে। অপারেশন টেবিলে মেয়েটির একটি কথা আমার বেজায় মন খারাপ করে দিলো। “স্যার, জানেন এই কবিরাজ এর জন্য আমার বিয়েটা ভেংগে গেছে। যদিও আমাদের লাভ ম্যারেজ ছিল না,তারপরও ওই ছেলেটাকে আমি বেশ পছন্দ করে ফেলেছিলাম। আমরা অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিলাম।” – বেশ মন খারাপ নিয়েই সেদিনের সেই অপারেশন টা শেষ করেছিলাম। তারপর মেয়েটা বেশ কবার ফলোআপ এ এসে ছিলো এবং মলদ্বারের ক্ষত চিহ্নটা বাদ দিয়ে সে ছিল সম্পুর্ন সুস্থ্য। শেষ ফলোআপ এ এসে মেয়েটি একটি কথা বলেছিল। “স্যার অপারেশন টেবিলে আমার বিয়ে ভাংগার খবর শুনে আপনি মনে কষ্ট পেয়েছিলেন বলে আমার মনে হয়ে ছিল। তাই আপনাকে বলা। হয়তো যা হয়েছে তা হয়তো আমার ভালোর জন্যই হয়েছে। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনোমিকস এ চান্স পেয়েছি। আগে ক্যারিয়ার তারপর বিয়ের কথা নতুন করে ভাববো “। নতুন জীবনটা খুব খারাপ হবে না। হয়তো আগের জীবনের চাইতে ভালোই হবে। মেয়েটি এই কথাগুলো বলার সময় ওর বাবা মা দুজনেই আমার সামনে মুখ নিচু করে বসে ছিলেন।
রোগী(৩) – আরও একজন রোগীর কথা বলি। একজন বৃদ্ধা। হয়েছে মলাশয়ে ক্যান্সার (Rectal cancer)। যেহেতু মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়, তাই পাইলস বা অর্শ মনে করে কবিরাজ দিয়েছে মলদ্বারে ইঞ্জেকশন। ফলে মলদ্বার পুড়ে গিয়ে যাচ্ছে-তাই অবস্থা। একেতো ক্যান্সারের মরন যন্ত্রনা তারপর মলদ্বারের পুড়ে যাওয়া ক্ষত। যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা।
রোগী(৪)- হঠাৎ রাতে একটা কল পেলাম । তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। এক সেনা সদস্যের স্ত্রী – ” ***** পাইলস ক্লিনিক”- এ বিকালে অপারেশন হয়েছে। প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে মলদ্বার দিয়ে। আমি যখন রোগী এটেন্ড করি তখন রাত ১১টা। রোগীর পড়নের কাপড়চোপড়, বিছানাপত্র রক্তে ভিজে জবজবে। রোগী একেবারেই রক্তশুন্য। রক্তচাপ রেকর্ড করা যাচ্ছে না। পালস হাতে পাচ্ছিনা। হার্টম্যান স্যালাইন, বেশ কয়েকব্যাগ রক্ত দিয়ে রোগীকে Ressuscitate করার পাশাপাশি অপারেশন শুরু করলাম। অপারেশনের সময় রোগীর মলাশয়ে জমে থাকা আরও প্রায় ৫০০ মিলি রক্ত মলদ্বার দিয়ে বের হয়ে আসলো। এর আগে বাইরে যে পরিমান রক্ত ক্ষরন হয়েছে তার তো কোন হিসাব নেই। বেশ কষ্ট করেই ব্লিডিং বন্ধ করলাম। রোগী প্রানে বাঁচলো। শুনলাম কবিরাজ নাকি ১৩০০০ টাকা নিয়েছে অপারেশন করতে। জেলা লেভেলে কোয়ালিফাইড ডাক্তারও এর চেয়ে কম টাকায় এই অপারেশন করে। ১৩০০০ টাকা, তাও আজ থেকে ১১ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৭ সালে।
এবার আসা যাক অর্শ,গেজ, ভগন্দর চিকিৎসালয় গুলতে আসলে কি করে। এরা মুলত তিন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে।
পদ্ধতি (১)- ইনজেকশন। এই পদ্ধতিতে এরা কার্বোলিক এসিড নামক একটি এসিড মলদ্বারের ভিতরে পাইলস এর গোড়ায় ইনজেকশন দিতে হয়।ঠিক নির্দিষ্ট স্থানে পরিমাপ মত ইনজেকশন দিতে পারলে এটি আয়ুর্বেদ শাস্ত্র স্বীকৃত একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। তবে এর জন্য দক্ষতা প্রয়োজন। অদক্ষ হাতে ভুল স্থানে বা পরিমাণ এর তারতম্যের জন্য মলদ্বার পুড়ে যেতে পারে। স্বীকৃত পদ্ধতি হলেও এর চাইতে আরও ভালো চিকিৎসা আবিষ্কৃত হওয়ায় এই পদ্ধতি এখন আর তেমন ব্যাবহার হয়।
পদ্ধতি (২)- গাছ লাগানো। যদিও ওরা বলে যে গাছ লাগাবে। আসলে কার্বোলিক এসিডের সাথে আরও কিছু উপাদান মিশিয়ে একটা পেস্ট তৈরি করে সেই পেস্ট মলদ্বারে লাগিয়ে দেয়। ফলে মলদ্বারে ছোট খাটো গুটি থাকলে পুড়ে ঝড়ে পরে যায়। এই পেস্ট পরিমানে বেশী লাগালে সম্পুর্ন মলদ্বার পুড়ে যেতে পারে।
পদ্ধতি (৩)- অপারেশন এমন একটা কাজ যার জন্য প্রয়োজন দক্ষতা। ওরা অপারেশন এর নামে যা করে তা হলো কাঁটাছেড়া। ফলে রোগীর মলদ্বারের বারোটা শুধুই না চৌদ্দটা বাজতে বাধ্য। এমনকি মলদ্বারের মল ধরে রাখার ক্ষমতা চিরতরে নষ্ট পর্য্যন্ত হয়ে যেতে পারে।
ডাক্তার হওয়ার অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন পাড়া – মহল্লায়, অলিতে – গলিতে, বাসে – ট্রেনে, স্টিমার – লঞ্চে বিভিন্ন আকার আকৃতির সাইনবোর্ড, ব্যানার,ফেস্টুন,লিফলেট চোখে পড়েছে এই সব পাইলস ক্লিনিকের বিজ্ঞাপন। বড় বড় করে লেখা- অর্শ গেজ ভগন্দর শতভাগ গ্যারান্টি সহ চিকিৎসা করা হয়।
অনেক সাধনার পর জানতে পারলাম অর্শ অর্থ হলো পাইলস বা haemoerhoids আর ভগন্দর এর অর্থ ফিস্টুলা। গেজ সম্ভবত এনাল ফিসার হলেও হতে পার
প্রচলিত বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি এই কোয়াক চিকিৎসা আমদের দেশে অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান। অশিক্ষিত মানুষের কথা না হয় বাদ দিলাম। অনেক শিক্ষিত মানুষও এদের কাছে চিকিৎসার জন্য যায়। এদের অপচিকিৎসার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হলে এদেরকে দোষারোপ না করে এদের কাছে চিকিৎসা নিতে যাওয়া জনিত কারনে নিজেদের মুর্খতাকে দায়ী করেন। অথচ এই মানুষগুলোই যখন কোয়ালিফাইড ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে আসে তখন চিকিৎসা মনপুত না হলে কিংবা একটা কিছু হলেই ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তোলেন।যেমন সম্প্রতি চট্টগ্রামের শিশু রাইফার কথাই বলি – অভিযোগ ডাক্তার ভুল চিকিৎসা করে শিশুটিকে মেরে ফেলেছে। একটা কোথাও বা এমন কেউ কি একটিবারের জন্য বলেছেন বা লিখেছেন যে ডাক্তার সাহেব চেষ্টা করেও শিশুটিকে বাঁচাতে পারলেন না।
আমাদের দেশে মিডিয়ার কয়েকটি প্রধান কাজের মধ্যে একট হলো ডাক্তাদেরকে ভুল চিকিৎসার অপবাদ দেয়ার মত অজুহাত গুলো খুজে খুজে বের করা। অথচ অর্শ,গেজ, ভগন্দর চিকিৎসালয় গুলো এদের চোখে পড়ে না। বরং এদের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে।
আমদের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় আছে। তাদের একটি অধিদপ্তর, কয়েকটি বিভাগীয় দপ্তর, প্রত্যেক জেলা উপজেলায় নিজস্ব দপ্তর আছে অথচ এদের অপকর্মগুলো কেন যেন কারও নজরে আসে না।