অধ্যাপক মেজর জেনারেল ডা. এম এ বাকী (অবসরপ্রাপ্ত), বর্তমানে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা প্রথম ডাক্তার যিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এর মেজর জেনারেল পদে দায়িত্ব পালন করেন। আসুন সংক্্ষেপে শুনি এই প্রথিতযশা সার্জনের আত্মজীবনী।
“৭০ সালে এসএসসি দিয়ে যখন ঢাকা কলেজে ভর্তি হই তার কিছুদিন পরই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। আমার বড়ভাই ৯ মাস যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি যুদ্ধ করেছিলেন। চারিদিকে যুদ্ধের ভয়াবহতা তখন চরমে। তাই যুদ্ধ শুরু হবার পর কিছুদিন পর বাবা মা আর আমি গ্রামে চলে যাই। তবে সেখানে আমি বসে থাকিনি, একজন সংগঠক হিসেবে কাজ করি। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করি। গ্রামে আমাদের পাশের বাড়িটি ছিলো রাজাকারের। মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন শেষ করে যাওয়ার সময় আমাকে অন্ধকারে দেখতে পায় ,তারা গুলিও তাক করে ফায়ার করবে বলে। পরে আমাকে চিনতে পেরে রাইফেল নামিয়ে ফেলেছিলো , আর তাঁদের অপারেশনের বিভিন্ন গল্প আমার সাথে করেছিলো।
৭২ সালে ইন্টার পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিসন পেয়ে পাশ করে চান্স পাই বুয়েটে কিন্তু মার ইচ্ছা ছিলো আমি যেনো ডাক্তার হই। তাই ৭৩ সালে ভর্তি হই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। তখন এই মেডিকেল কলেজ মাত্র যাত্রা শুরু করেছে। আমাদের হোস্টেলের সিট নিয়ে বেশ কষ্ট করতে হয়েছিলো। প্রথম দেড় বছর বিশাল কমনরুমে অনেকজন মিলে থাকতে হত। তারপর আমরা সিট পাই পক্স ওয়ার্ডে যার বর্তমান নাম আলাউদ্দিন হোস্টেল। কিন্তু সেখানে তখনো সব সুযোগ সুবিধা ছিলো না। তাই দুপুরে মেইন হোস্টেলে গিয়ে গোসল , খাওয়া-দাওয়া করে আমরা পড়তে যেতাম। আমরা যখন ইন্টার্নি করি তখন বাংলাদেশ আর্মি থেকে একটা টিম এসে আমাদের ব্রিফ করে। আমিও অনেক কিছু বিবেচনা করে আর্মিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।৭৯ সালে আমি আর্মিতে জয়েনকরি।
প্রথমে মেডিকেল অফিসার হিসেবে ছিলাম আমি। তারপর আর্মিতে একটা পরীক্ষা দেই আমি। তারা আমাকে সার্জারীতে সিলেক্ট করলো। এরপর আমি হলাম Graded Specialist in Surgery। ৯৮ এ আমি সার্জারীতে এফসিপিএস কমপ্লিট করি। এর মাঝে আমাকে দেড় বছরের একটা ট্রেনিং এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিলো। খুব কঠিন ছিলো ট্রেনিংটা। সারাদিন হাসপাতালে কাজ করতে হত। এমনও হত পুরো হাসপাতালে সার্জারীতে আমিই ছিলাম একমাত্র ডাক্তার। রোগিদের ইনভেস্টিগেশন, ডায়াগনোসিস করে, অপারেশন করা,
প্রি-অপারেটিভ, পোস্ট-অপারেটিভ সব আমাকেই করতে হত। রাতে বাসায় গিয়ে আবার পরদিন ভোর ৬ টায় কাজে যেতাম। অমানসিক পরিশ্রম করতে হত। তবে রোগিদের ভালবাসাও পেয়েছি এইক্ষেত্রে , যা আমার প্রেরণা হয়ে কাজ করেছে সবসময়।
আমি তখন রংপুর সিএমএইচে। এক ছেলে আসলো অনেক কমপ্লিকেটেড কেস নিয়ে। সে ইন্ডিয়া গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এসেছিলো কিন্তু সেখানকার ডাক্তাররা কিছু করতে পারেনি।অবশেষে আমি তার কেসটা নেই এবং অপারেশন করি । পরে সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। আমার এখনো মনে আছে তার নাম ছিলো সালেহ। এই ঘটনার পর আমি আত্মবিশ্বাস পাই এবং সার্জারীতে ক্যারিয়ার করার সিদ্ধান্ত নেই। কারণ সার্জন হওয়া বেশ কঠিন একটা বিষয়। এখানে শারীরিক ও মানসিক শক্তি যেমন দরকার, তেমনই দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও থাকা দরকার। আর আমার ক্যারিয়ারে সবসময় আমার পাশে থেকে এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন আমার স্ত্রী। উনার সহযোগিতা না থাকলে আমি হয়তবা এতদূর আসতে পারতাম না।
সরকার থেকে আমাকে সাংহাই, সিঙ্গাপুরে সার্জারীতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে পাঠানো হয়। বিদেশে অনেক ওয়ার্কশপেও অংশগ্রহণ করেছি আমি। বিভিন্ন জার্নালে আমার প্রায় ১৫/১৬ টি পাব্লিকেশন আছে। আমার মনে হয় প্রফেসনালিজম থাকা উচিত সব ডাক্তারের আর থাকতে হবে ডেডিকেশন। আর্মি হোক আর সিভিল হোক ডাক্তারের কাজ তো একই ,মানুষের সেবা করা। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা সবার মধ্যে থাকতে হবে।কারণ আমি মনে করি ওইটাই আমাদের বেসিক, দেশগড়ার অনুপ্রেরণা।”
আত্মজীবনী সংগ্রহ: হিউম্যানস অব মিটফোর্ড
সম্পাদনা: বনফুল