চলুন, এক সতীসাবিত্রী গ্রিক পরীর গল্প দিয়ে শুরু করা যাক, যার নাম ছিল ‘সিরিংক্স’। ললুপ দেবতা প্যানের কুনজর থেকে বাঁচতে সে নিজেকে যাদুবলে জলখাগড়ায় পরিণত করেছিল। অবশ্য শেষরক্ষা হয়নি তার। রুষ্ট দেবতা সেই জলখাগড়া কেটে বাঁশি তৈরি করেছিলেন। আর এই Syrinx (ফাঁপা নল) থেকেই ‘Syringe’ শব্দটির উৎপত্তি।
এই ফাঁকে আরেকটা গল্প বলে ফেলি। ^_^ আমার বাবা যে প্রাইমারি স্কুলে পড়তেন, তার বেড়ার একপাশটা ছিল ভাঙা। স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা দিতে আসলে ওই মোটা সুঁই ফোটানোর ভয়ে সবাই মিলে নাকি সেই ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে চম্পট দিতেন। 😀 ইঞ্জেকশন নিয়ে এমন ভীতি, যাকে বলে ‘ট্রাইপ্যানোফোবিয়া’, মানুষের মধ্যে নেহায়েত কম নয়। আর হবেই বা না কেন, প্রথম দিকে ইঞ্জেকশন দেয়াটা ছিল এক ভয়ানক বিভীষকার মতো। এর প্রাথমিক উদ্ভাবকদের অন্যতম হলেন ক্রিস্টোফার রেন, যিনি অক্সফোর্ডের একটি কুকুরের শিরায় এলকোহল প্রবেশ করিয়ে তার প্রভাব দেখতে চেয়েছিলেন। তার সিরিঞ্জটা ছিল ফাঁপা হাঁসের পালকের মাথায় লাগানো একটা ব্লাডার এবং শিরা খুঁজে পেতে তিনি প্রথমে চামড়ায় ইনসিশন দিতেন। একই পরীক্ষা তিনি মানুষের উপরেও করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর সাবজেক্টরা এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিল, যে পরীক্ষাটা আর চালিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি।
সিরিঞ্জের ইতিহাসটা অবশ্য অনেক পুরনো। প্রথম শতাব্দীতে সাপের বিষদাঁত ব্যবহারের পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করে সরল পিস্টন সিরিঞ্জ তৈরি করেছিলেন রোমান চিকিৎসাবিজ্ঞানী অলাস কর্নেলিয়াস সেলসাস, যার বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর ‘De Medicina’ বইয়ে। এর প্রায় ৮০০ বছর পর মিশরীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানী আম্মার বিন আলী আল মাওসিলি চোখের ছানি অপসারণ করতে একটি কাচনলের সিরিঞ্জ ব্যবহার করেন। পরবর্তী প্রায় ৬০০ বছর তাঁর এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হতে থাকে, কিন্তু শুধুই দেহ থেকে কোনো পদার্থ অপসারণ করতে।
প্রথম আধুনিক সিরিঞ্জের ডিজাইন করেছিলেন ফরাসি গণিতবিদ ব্লেইজ প্যাসকেল, তাঁর চাপের সূত্র প্রমাণ করার জন্য; আর একে চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রথম ব্যবহারের চেষ্টা করেছিলেন ক্রিস্টোফার রেন, যার গল্পটা বলা হয়েছে শুরুতেই। একই সঙ্গে আরো দুজন জার্মান চিকিৎসাবিজ্ঞানীর নাম বলতে হয় – ড্যানিয়েল মেজর ও সিগিসমুন্ড এলসহল্টজ। অবশ্য তাঁদের পরীক্ষার ফলাফলও ছিল ভয়াবহ, সকল রোগীই মারা গিয়েছিলেন। এমন ট্রাজেডির পর চিকিৎসকরা আর এবিষয়ে তেমন আগ্রহী হননি।
১৮৪৪ সালে আইরিশ চিকিৎসক ফ্রান্সিস রাইন্ড প্রথমবারের মতো ফাঁপা স্টিলের সুঁচ তৈরি করেন। ১৮৫৩ সালে ফরাসি চিকিৎসক চার্লস প্রাভাজ ও স্কটিশ সার্জন আলেকজান্ডার উড হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ তৈরি করেন, যার সুঁচটি চামড়া ভেদ করার মতো যথেষ্ট সূক্ষ্ম ছিল। এর সাহায্যে তিনি নিউরালজিয়ার চিকিৎসায় মরফিনের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তাঁর সময়ের অন্যান্য চিকিৎসকের মতো উডও মনে করতেন ইঞ্জেকটেড ড্রাগের কেবল লোকাল ইফেক্ট আছে, কোনো সিস্টেমিক ইফেক্ট নেই। সেন্ট জর্জ হাসপাতালের সার্জন চার্লস হান্টার যখন ইঞ্জেকটেড মরফিনের সিস্টেমিক ইফেক্ট সম্পর্কে ধারণা দেন তখন এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে উডের ব্যাপক মনোমালিন্যের সূচনা হয়। মরফিন আসক্তি কেবল পরিপাকতন্ত্র নির্ভর এবং ইঞ্জেকটেড মরফিনের কোনো সিস্টেমিক ইফেক্ট নেই বলে তাতে আসক্তিও তৈরি হয়না – এমন ধারণা থেকে ব্যথানাশক হিসেবে ইঞ্জেকটেড মরফিনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। এর ফলাফল হয়েছিল ভয়াবহ – অনেকেই মরফিনে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, একসময় আলেকজান্ডার উড ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই এতে আসক্ত হয়ে পড়েন। প্রচলিত আছে তাঁর স্ত্রীই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইঞ্জেকটেড মরফিন ওভারডোজে মারা যান।
উনিশ ও বিশ শতকের প্রথমদিকে অধিকাংশ মেডিকেল বা ননমেডিকেল ইঞ্জেকশন দেয়া হতো সাবকিউটেনিয়াস বা কখনো কখনো ইন্ট্রামাসকুলার রুটে। তখনকার মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা অনেক সময় সাবকিউটেনিয়াস ইঞ্জেকশন দিতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত শিরায় দিয়ে দিত। তারা লক্ষ করে, এমনটা হলে অনেক কম ডোজেই অনেক বেশি ‘ফিলিংস’ পাওয়া যায়। ইন্ট্রাভেনাস রুটের উপযোগিতা প্রথম চিকিৎসকদের নজরে আসে ১৯২০ এর দশকে যখন তাঁরা লক্ষ করেন, alkaline Salvarsan এর ননটক্সিসিটি বজায় রাখতে এবং সর্বোচ্চ ফল পেতে I/V রুটই সবচেয়ে উপযুক্ত। এরপর এ রুটের উপযোগী করতে সুঁচ, সিরিঞ্জ, ড্রাগ কম্পোজিশন সবকিছুরই পরিবর্তন ও উন্নতি সাধন হয়।
প্রথম ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ তৈরি করেছিলেন জেমস গ্রিলি, ১৯১২ সালে। এতে একটি সুঁচযুক্ত টিনের টিউবে মরফিন ভরা থাকতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের মধ্যে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৪৬ সালে বার্মিংহাম গ্লাসওয়ার ফাক্টরি প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ কাচের তৈরী সিরিঞ্জ বাজারে আনে, যার বিভিন্ন অংশ আলাদাভাবে পরিবর্তন করা যেত। এর প্রায় এক দশক পর যখন ‘স্টেরিলাইজেশন’ ইস্যুটি বিশ্বজুড়ে আলোচিত তখন একক ব্যবহারযোগ্য ডিসপোজেবল প্লাস্টিক সিরিঞ্জ তৈরিতে কাজ করেন অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানী চার্লস রোথাউজার ও নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানী কলিন মুরডক। ১৯৮৯ সালে আর্জেন্টাইন বিজ্ঞানী কার্লোস আর্কোস্টিন অটো ডিসপোজেবল নিডল সিরিঞ্জ তৈরি করেন।
শুরুতেই বলেছিলাম ইঞ্জেকশন ভীতির কথা। এর সমাধানে বিজ্ঞানীরা ব্যথাহীন ইঞ্জেকশন পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন এবং বেশকিছু প্রোটোটাইপও ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে। যেমন ২০১১ সালে জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সেইজি আয়োয়াগি যে সিরিঞ্জ ডিজাইন করেছেন, তার সুঁচের সাইজ মাত্র একটা মশার শুঁড়ের সমান। আর MIT এর গবেষকদের ডিজাইন করা Magnetic Jet Injection Device এ সুঁচের কোনো কারবারই নেই। বরং এটি শব্দের বেগে অতি সূক্ষ্ম ওষুধের জেট ‘ফায়ার’ করে। ২০১৩ সালে আমেরিকান কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ার মার্ক প্রাউসনিটজ তাঁর microneedle prototype প্রস্তাব করেন, যাতে অনেকটা নিকোটিন প্যাচের মতো ৪০০টি সিলিকনের তৈরি কম্পিউটারাইজড সুঁচ থাকবে, যার আকার এতটাই সূক্ষ্ম, যে সেগুলো নিউরনে কোনো ব্যথার উদ্দীপনা সৃষ্টি না করেই চামড়া ভেদ করে ওষুধ পাঠাতে সক্ষম। এগুলো বাজারে এলে আমার মতো ইঞ্জেকশন ভীতু মানুষের সংখ্যা কিছুটা হলেও কমবে আশা করা যায়। ন
লিখেছেনঃ
আব্দুর রাফি,
রাজশাহি মেডিকেল মেডিকেল কলেজ।