প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২১ জুন, ২০২০, রবিবার
ডা. এ. এস. এম. রেজওয়ান চৌধুরী
জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ
সেশনঃ ২০১০-১১
বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর একটি উক্তি আমরা সবাই পড়েছি, আজকের পর্বের লিখা আমি সেই কালোত্তীর্ণ, যুগোত্তীর্ণ, শিল্পোত্তীর্ণ বাণীর উল্লেখ করেই শুরু করব,
“শিক্ষকের সার্থকতা শিক্ষাদান করায় নয়, কিন্তু ছাত্রকে তা অর্জন করতে সক্ষম করায়। শিক্ষক ছাত্রকে শিক্ষার পথ দেখিয়ে দিতে পারেন, তার কৌতূহল উদ্রেক করতে পারেন, তার বুদ্ধিবৃত্তিকে জাগ্রত করতে পারেন, মনোরাজ্যের ঐশ্বর্যের সন্ধান দিতে পারেন, তার জ্ঞান পিপাসাকে জ্বলন্ত করতে পারেন, এর বেশি আর কিছু পারেন না।যিনি যথার্থ গুরু তিনি শিষ্যের আত্মাকে উদ্বোধিত করেন এবং তার অন্তর্নিহিত সকল প্রচ্ছন্ন শক্তিকে ব্যক্ত করে তোলেন। সেই শক্তির বলে শিষ্য নিজের মন নিজে গড়ে তোলে, নিজের অভিমত বিদ্যা নিজে অর্জন করে। বিদ্যার সাধনা শিষ্যকে নিজে অর্জন করতে হয়। গুরু উত্তরসাধক মাত্র।”
আমি আজ সেরকম একজন শিক্ষকের কথাই লিখব। আমার অসম্ভব সুন্দর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনন বিকাশের জন্য, অনুজদের জন্য। যাদের অন্তরে লুকিয়ে আছে শিক্ষকতা, তাদের উপরই নির্ভর করবে মেডিকেলীয় অন্ধকারের অভিশাপ মুক্তি। উদীত হবে নব রবি, রংধনুর ঝলমল আলোকে সুগম হবে পথ।
গ্রাম বাংলায় একটি প্রচলিত বাণী এরকম-
“পীরের খাছলতে খাছলত ধর, তবেই মুক্তি।”
সে রকম প্রগতিশীল সমাজে অনেকে বলেন, যোগ্য গুরু বা মেন্টর বা শিক্ষক তৈরি করেন, যোগ্য শিষ্য বা ছাত্র। জগত সংসার আপেক্ষিকতার সূত্র মেনে চলে, তাই এটিও আপেক্ষিক। এর আসলে কোন মাপকাঠি নেই, কেউ কারো যোগ্যতা বিচার করতে পারে না। হাতেগোনা কয়েকটি প্যারামিটারে যে যার মত প্রিয় শিক্ষক বা প্রিয় ছাত্র বেছে নেন। একই শিক্ষক সর্বজন সমাদৃত নন, আবার একই ছাত্র সব শিক্ষকের প্রিয়ভাজন নন।
আজ লিখব মেরুদণ্ড নিয়ে, যেটি এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার। ইন্টার্ণ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি সেরকম কাউকে খুঁজে পাইনি, যিনি প্রমথ চৌধুরীর সেই বাণীর প্রকৃত গুরু হয়ে উঠতে পারেন। আমার অন্তরে প্রচন্ড আক্ষেপ ছিল। অবশেষে সৃষ্টিকর্তা চাকুরির সুবাদে ২০১৯ সালে সেই আক্ষেপ, সেই ক্ষুধা মিটিয়ে হৃদয়কে পরিতৃপ্ত করেন।
দেখা হল, মেডিকেলীয় জীবনে আমার দেখা মেরুদণ্ডী, মানবিক, সৎ নিউরোলজিস্ট খায়রুল হাসান স্যারের। যিনি ছিলেন একইসাথে আপোষহীন, সৎ, সত্যবাদী, স্পষ্টভাষী, প্রতিবাদী, নিরহংকারী, সাদাসিধে, সময়ানুবর্তী, ধার্মিক, ছাত্রপ্রেমী, শিখাতে ভালবাসা ও শিখতে ভালবাসা মানুষ। উচ্চ আইকিউ সম্পন্ন, জ্ঞানী, তীক্ষ্ণ ক্লিনিক্যাল চক্ষুসম্পন্ন, বন্ধুর মত গল্পবাজ, আবার পিতার মত শাসন ও আদরের সমন্বয়কারী।একসাথে এতগুলো গুণ খুব কম মানুষে পাওয়া যায় বলে – আমার বিশ্বাস; যার ভিতর ও বাহির এক।
আমি তাঁর কাছে প্রথম শিখি সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার সৎ সাহস রাখাটাই আসলে সততা। সত্যকে বিনা দ্বিধার সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে পারার সাহসটাই আসলে সততা। ১০ মাস খুব কাছ থেকে স্যারকে বুঝার চেষ্টা করেছি, মানবিক গুণগুলো শিখার চেষ্টা করেছি, হয়তো কিছুটা পেরেছি, হয়তো কিছুই পারিনি।
স্যারের মায়ের প্রতি ভালবাসা ছিল অনন্য বৈশিষ্ট্য।সব সময় মায়ের কথা বলতেন, উপদেশ দিতেন আমাদের। রাউন্ডেও মা এর ফোন আসলে উনার ‘মা’ বলে একটা গাঢ় ভরাট গলার দরদ ভরা ডাকটা আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। মায়ের কথা পুরোটা চুপচাপ শুনতেন, এরপর খুব নরমভাবে বলতেন। সময় নিয়ে কথা শেষ করতেন, তারপর আবার রাউন্ড দিতেন।
এবার আসি, একটু পড়াশোনার বিষয়ে। তিনি তাঁর ছাত্রদেরকে ধরে ধরে শিখাতে চাইতেন। চাইতেন তোমরা আগে শিখ কিভাবে শিখতে হয়। উনার আবিস্কৃত কিছু সহজ পদ্ধতিতে উনি নিউরোলজিকে পানি ভাত বানাতেন, যা আমি নিজেও প্রথম শিখেছি অবাক বিস্ময়ে। একটু আধটু বকতেন আবার পরক্ষণেই ওদের ভিতরে আগ্রহ ও জানার ক্ষুধা সৃষ্টি করে দিতেন। ঐ বয়সে আসলে আমরাও ফাঁকি দিয়েছি, ওরাও দিত এটাই স্বাভাবিক। স্যারের প্রতি তাঁর ছাত্রদের নিঃস্বার্থ ভালবাসা খুব কাছ থেকে দেখেছি, আবার ছাত্র ও আমাদের প্রতিও স্যারের নিঃস্বার্থ ভালবাসা খুব কাছ থেকে দেখেছি। তিনি সব ছাত্র, মেডিকেল অফিসার, রেজিস্ট্রারকে আপনি বলে সম্মানিত করতেন। স্যার মুচকি হেসে আমাকে বলতেন,
“রেজওয়ান, মেয়ে কি বাবা বাবা ডাকে?”
অথচ স্যার জানেন মেয়ের বয়স ২ মাস।
অন্যদেরকেও বিভিন্নভাবে বুস্ট আপ করতেন। স্যার ইন্টার্ন, মেডিকেল অফিসারদের পড়ানোর পর সবাইকে নাস্তার জন্য টাকা দিয়ে যেতেন পুরস্কার হিসেবে। বলতেন,
আপনারা কষ্ট করে শুনেছেন, এবার রিফ্রেশ হন।
নিউরোলজিতে প্রচন্ড ওয়ার্ক লোড থাকতো, উনি প্রতিদিন বুস্ট আপ করতেন সবাইকে। সাহস দিতেন আগামীর জন্য। অন্য কেউ ওয়ার্ডের ব্যাপারে বাজে কথা বললে সাথে সাথে গর্ব করে বলতেন,
“ওরা আমার ছাত্র, আমি ওদের বানিয়েছি। তাই ওদের আমি চিনি।”
আমাদের সামনে কখনো আমাদের প্রশংসা করতেন না। অথচ অন্য সব জায়গায় আমাদের প্রশংসা করতেন যে আমরা সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সাথে, সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করি প্রতিটি রোগীর জন্য।এটা যখন অন্যের মুখে জানতে পারতাম, তখনকার হার্ট বিট আর মনের অবস্থাটা আমাদের কী হত ভাবতে পারেন! আমার একটা কাজের প্রশংসাও স্যার অন্যদের কাছে করেছিলেন, সেটা ছিল আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া, অবিস্মরণীয়!
স্যার আমার মেডিকেলের ১০ বছর আগের ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন, কিন্তু কখনও স্বজনপ্রীতি করেন নি। এমনকি আমার চাকুরির রিকমেন্ডেশনও উনি করেন নি। ব্যক্তিগত একটি কারণে, এটি আমার জন্য গর্বেরও বটে। সমান চোখে দেখেছেন সব মেডিকেল অফিসারকে, যেখানে বাকিরা উনারই সরাসরি ছাত্র। স্যারের ৬০ টা করেও রোগী থাকতো, কিন্তু তাও কখনো কোন ছাত্র বা ডাক্তারকে অথবা ডাক্তারের পরিবারের কাউকে দেখানোর জন্য টিকেট তো দূরে থাক, ঢুকার অনুমতি বা সিরিয়াল ধরা কোনটাই লাগতো না। স্যার ছাত্রছাত্রীদের বলতেন,
“ছেলে কেমন আছেন? বা মেয়ে সকালে নাস্তা খেয়েছেন? মেয়ে এটা পারছেন না?”
মেডিকেল অফিসারকে ডাক্তার সাহেবও বলতেন।
রোগীর জন্য স্যার ছিলেন সাক্ষাৎ দেবদূত! স্যার দিনে দুইবার ভিজিট তো করতেনই, এর বাইরে মাঝে মাঝে খারাপ রোগী থাকলে ফজরের পর ও এশার পর সারপ্রাইজ ভিজিট করতেন। গরীব রোগীর বিল নিজে দিতেন, গরীব রোগীকে মেরোপেনেম, জোভির, মিথোপ্রেডের মত দামি ইঞ্জেকশন নিজে কিনে দিতেন। এছাড়া তাদের রিহ্যাবিলিটেশন এর জন্য আমাদের দড়ি কিনে আনতে বলতেন। আমাদের মনে না থাকলে স্যার বাজার করতে গেলে নিজেই নিয়ে আসতেন। তিনি অযথা একটি টেস্ট ও পছন্দ করতেন না। রোগী নিজ থেকে সিটি স্ক্যান করাতে চাইলে উনি হাসতেন, বলতেন,
“আমি ছোট ডাক্তার, আপনি বড় ডাক্তারের কাছে যান, উনারা দিবেন।”
স্যার এর ডায়াগনোসিস দেখে মাঝে মাঝে জাদুকর মনে হত! এত সিস্টেমেটিকেলি অংকের মত মিলিয়ে দিতেন। আমি বিকেলে স্বেচ্ছায় স্যারের চেম্বারে রোগী দেখতে যেতাম। প্রায়ই বলতেন,
“রেজওয়ান, আমার সব ইন্টার্ণদের ডেকে আনেন, কেস দেখাব।”
খুবই সময় নিয়ে রোগী দেখতেন, অফিস ৫ টায় শেষ হলেও স্যারের বেশির ভাগ সময় মাগরিব পার হয়ে যেত। স্যার গল্প করতেন, সময় বাঁচানোর জন্য কিভাবে বেগুন ভর্তা খেয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশন পরীক্ষা দিয়েছেন সে কথা বলতেন; যেন আমরা সাহস পাই, হাল না ছাড়ি। স্যারের কাছে আরো একটি বড় শিক্ষা সৎ সাহস। তিনি রোগীর যে কোন অসুবিধায় কর্তৃপক্ষকে সাথে সাথে সমাধান করতে নির্দেশ দিতেন। আমাকে স্পষ্ট করে একদিন বলেছিলেন,
“মালিকরা ডাক্তারদের চাকর ভাবে।”
আমরা বলতাম,
“বেসরকারিতে তো স্যার জব সিকিউরিটি নেই, যখন তখন চাকুরি নট।”
স্যার বলতেন,
“ধুর বোকা, রিজিক তো আল্লাহ দেন। আজকে এখানে চাকুরি নেই, কালকেই আরেক জায়গায় পাবেন।”
আমি চলে আসার দিনটিতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নি স্যারের চেম্বারে। কেউই পারবে না, কারণ ভাল মানুষের দেখা আজকাল কম মিলে। আর তিনি এমন একজন মহৎ মানুষ, যিনি আজকের দিনের যেকোন প্যারামিটারেই উচ্চতার শিখরে। তাঁকে ছেড়ে আসা তাই আরো বেশি কষ্টকর ছিল। শুনেছি উনি সেই উচ্চবেতনের চাকুরিও ছেড়ে দিয়েছেন কিছুদিন পর।
লিখতে গেলে শেষ হবে না, কিন্তু কেউ যদি শিক্ষা নিতে চায় প্রতিটি লাইনে গভীর শিক্ষা নিহীত আমার ও অনুজদের জন্য। স্যারের প্রতি রইল শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম ভালবাসা।