১.
কুলসুমা(ছদ্মনাম), বয়স ত্রিশ কিংবা পয়ত্রিশ। আরো বয়স্ক দেখায়। দারিদ্র্যর আঁকিবুকি ওকে অনায়াশে চল্লিশের পাল্লায় ঠেলে দেয়। সারাক্ষণ ক্ষুধা লেগেই থাকে নিশ্বাসের মতো। দুইবেলা দুমুঠো জোগার দিতে এ বাড়ি ও বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে। গন্ডগ্রামে কাজের লোক রাখার বিলাসিতাই বা কয়জনের হয়? তাই ও পাড়ি দেয় রাজধানী ঢাকায়। ইট কাঠের নগরীর খোপে খোপে কাজের লোক লাগে। কর্মজীবী নারীদের সংসার আর নির্জলা গৃহিণীর ভাতঘুমের আয়েসে এদের অবদান খাটো করে দেখার উপায় নেই। তাই নাজমা খালা( ছদ্মনাম) যখন বলে,
‘এই গেরামে তোর কামের ঠিক ঠিকানা নাই। এক বেলা খাস তো আরেক বেলা উপাস থাকস। আমার লগে আয়, ভালা এক বাসা লইয়া দিমু। বিবিসাব অফিসে চারকি করে। একটা ছুইটকা, দেইখা শুইনা রাখবি। মাস শেষে চার পাঁচ হাজার টাকা পাবি। খাওয়া দাওয়া, তেল সাবান ফিরি। দুই চার মাস পর পর বাড়িত আসবি।’
লোভে কুলসুমার চোখ চকচক করে উঠে। ক্ষুধার জ্বালা বড় জ্বালা। পেটে দানা পড়লে পিঠে সয়। তার ব্যাডা হইসে বাদাইম্মা। কাজকামের নাম নাই। খালি খাবলাইতে পারে। ঘিণ্না ধরে যায় কুলসুমার। মনেমনে ভাবে, আমি চইল্লা গেলে ওরও একটা শিক্কা অইব।
পরদিনই নাজমা খালার কাছে যাইয়া আব্দার করে,
‘খালা আমারে তোমার লগে লইয়া যাও।’
নাজমা খালা মনেমনে খুশি হয়। বিবিসাব কইসে একটা ভালা বুয়া আইন্না দিতে পারলে বকশিশ দিব, কমসে কম একমাসের বেতনের সুমান! তাছাড়া প্রতি দুই মাস পর পর ঘুরায়া ঘুরায়া এই বাসা ও বাসা অদল বদল কইরা আরো এমন কত বকশিশ, মনেমনে হিসাব করে নাজমা বেগম। কইতে দোষ নাই, এই কইরাইতো নাজমা বেগম চলে। ঝকঝকে ছাপার শাড়ি পরে। বাড়িতে এক কানি জমি বন্ধকও রাখসে। তার কাজে কুলসুমাদেরও গতি হয় আবার বিবিসাবরাও খাতির করে। এইটা ওইটা খাইতে দেয়। আদর কইরা কথা কয়। সেইসব কথা মনেমনে চাপা রাইখা নাজমা খালা একটু ঠাট দেখাইয়া কয়,
‘হ নিয়া তো দিমুই। তহন আবার ভুইলা যাইস না যেনো। শহরের বাতাসে তোগো আবার তেজ বাইড়া যায়। যেমনে কই হেমনে হুনবি, কামের অভাব অইব না। এক বাসা ভালা না লাগলে আরেক বাসায় দিমু। এক বাসায় থাহন লাগব, এত ঠেকা আছে নি? বিবিসাব কিছু কইলে কবি, নাজমা খালাই আমার ভালো মন্দ দেখব। বুঝলি? দেখ না তোরে কত ভালা রাহি।’
কুলসুমা সায় দিয়া যায়। দুইবেলা দুইমুঠো ভাত, মাইয়ার স্কুল আর কুঁইড়া স্বামীরে একটা শিক্ষা দেবার মোক্ষম সুযোগকে লুফে নেয়। কিন্তু কুলসুমা তখনো জানে না কী অর্বাচীন ক্লেদাক্ত ভবিষ্যৎ তার জন্য অপেক্ষা করছে।
নাজমা খালা ভালা একটা বাসায় তার কাজ যোগায় দেয়। বিবিসাব, স্যার বড় চাকরি করে। তাদের দুই পোলা, একটা এহনো স্কুলে যায় না। হেরে লইয়া কুলসুমার থাকা লাগে। কাজ বলতে এইডা। বিবিসাব রাতে তরকারি রান্ধে। ভাত ডাল, ভাজিভুজি কুলসুমা করে। ঘরমোছাটা একটু কষ্ট। কাপড় তো ধোয় তো মেশিনে। কুলসুমার দিন তরতর করে যায়। তবে খালি মেয়েটার কথা মনে পড়ে। মনে কেনো যে কু ডাকে? মায়ের মন বলে কথা।
কুলসুমা আয়নায় ঘুরেফিরে নিজেকে দেখে। শরীরে মাশাল্লাহ রং ফিরেছে। ফিরবে না ক্যান, ভালা খায়, ছায়ার মধে থাহে। স্নো পাউডার তেল সাবান আলাদা আলাদা। কোন কিছুর কমতি নাই। মেয়ের লইগা থ্রিপিছ কিনে। শাশুড়ির লইগা শাড়ি। জামাইয়ের লইগা শার্ট লুঙ্গি। মনেমনে খুশি কুলসুমা। সবাই ওরে দেখে কী কইব, কেমুন অবাক অইব! এসব ভাবতে ভাবতে কাম করে। প্রায় ছয় মাস পর বাড়ি যাচ্ছে সে। এক ঝাঁপি আনন্দ নিয়ে। টাকা সুখ দেয়, সাচ্ছন্দ্য দেয় এটা নতুন করে আবার আবিস্কার করে কুলসুমা। হাজার পনেরো টাকা তার ছোট্ট কাপড়ের পুঁটলিতে। একটা রিকশা কিনে দিবে মাইয়ার বাপকে। তখন আর কাজ না করার কোন অজুহাত দেখাতে পারবেনা লোকটা। নতুন রিকশায় পুরানো সংসার, দুইবেলা দুইমুঠো খাবারের নিশ্চয়তা হলে কুলসুমা আর শহরে যাবে না, অন্যর সংসার সামলাতে। মেয়েটা হাত পায়ে ডাগর ডগর যেভাবে হইতাসে, দুই তিন বছর পর বিয়া দিতে হইব। মাসিক হয় বছর খানেক ধরে। আগে তো কুলসুমা দেখায় দিত, কেমনে কাপড় ভাঁজ কইরা লওন লাগে। এহন ক্যামনে কি করে কে জানে। ডর লাগে কুলসুমার। মাইয়ার মাসিক হওয়ার পর থাইকা আরো বেশি। শাশুড়িরে কইয়া আইসে খেয়াল রাখতে। তয় হের নিজেরই হুস নাই। পান খাওনের লইগা এই বাড়ি হেই বাড়ি ঘুইরা বেড়ায়।
২.
বাড়িতে তার আগমনে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। আশেপাশের সবাই দেখতে আসে। কত্ত সুন্দর হয়েছে কুলসুমা। তেল চিকচিক করছে মাথার চুল। সুন্দর ছাপার শাড়ি পরনে। তবে তার মেয়েটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ! আর ওর স্বামীর চোর চোর ভাবটা একটু বেড়েছে যেনো। কী জানি অনেকদিন পর বলে এমন হতে পারে, ভাবল কুলসুমা। আরেকটা ব্যাপার, এত্তদিন পর পাশাপাশি শুয়ে আছে, অথচ লোকটা হামলে পড়ছে না! অবাক কান্ড! কী জানি ছয় মাসে কত কিছুই দেখি পরিবর্তন হয়ে গেছে! একটু রুশো কুলসুমা। তুমি এখনো জানোনা কী বিপর্যয় তোমার জন্য অপেক্ষা করছে!
মেয়েটার পরিবর্তন আগেই চোখে পড়েছিলো কুলসুমার। এখন দেখে থেকে থেকে বমি করে! কিছু খেতে পারে না। পাড়ার ফার্মেসিতে কানু ডাক্তরকে দেখাইসে। হেয় কইসে জন্ডিস। জন্ডিসের তেল পড়া, নুন পড়া দেয়া হইসে। কোন উন্নতির লক্ষণ নাই। মেয়ে দিন দিন কাহিল হয়ে পড়ে। বেঢপ পেট মোটা মাছের মতো দেখায়। মাসিকের হিসাবেও গন্ডগোল। অবশেষে এক এমবিবিএস ডাক্তারের পরামর্শে আলট্রাসাউন্ড করা হলো। রিপোর্ট দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ! তেইশ সপ্তাহের বাচ্চা!
কুলসুমার পায়ের নীচের মাটি সরসর করে সরে যায়। নিমিষে অতল গহবরে পড়ে যায় যেনো। আমার এত বড় সর্বনাশ কে করল? বলে লুটিয়ে পড়ে। জ্ঞান হারায় কুলসুমা
মাইয়া কোনহানে যায়না। বাড়িতে কোন পুরুষ পোলা আসে না। ঘরে বাইরে মানুষ বলতে তিনজন। তাহলে ঘটনা কেমনে প্যাচ খাইল? কুলসুমার মাথায় ঢুকে না। কোন মতেই যখন মিলানো যায় না, তখন সে মেয়েকে পাড়া দিয়ে ধরল,
‘ক মাগী কে তোর পেট বানাইসে। আমি খাইয়া না খাইয়া বান্দিগিরি কইরা টেহা পাডাই তোর পেট লাগানোর লইগ্গা?’
মেয়ে মায়ের রণমূর্তি দেইখা ভয় পেয়ে যায়। হরহর কইরা বলতে শুরু করে…
আমারে কস নাই ক্যান?
কেমনে কমু? তুমি তো ঢাহায়? তাছাড়া তুমি নাকি আমার কথা বিশ্বাস করতা না। যেমন দাদী বিশ্বাস করে নাই। দাদী কয়, আমি নাকি মিছা কথা কই?
কুলসুমা শাশুড়ির মুখোমুখি হয়। মহিলা আমতাআমতা করে ছেলের পক্ষ নিতে চাইল। বলতে চাইল, কইত্থেক্কা না কইত্থেক্কা… কুলসুমার স্বামী কথা শেষ করতে দেয় না।
‘থাকসি ভালো করসি। আমি একলাই, তোর মাইয়া থাহে নাই? এত্ত কপকপ করবি না। বেশি উজাইলে এখনি তোরে তালাক দিমু। টেহা তো গতর খাটায়া আনছসঅই। অহন মাইয়ার পেট খালাশ কইরা আন। তুই তোর মতো থাক, আমাগো আমগোর মতো শান্তিতে থাকতে দে। তুই জানছস, আর কেউ যেনো না জানে। মনে রাহিস, তালাইক্কা বেডিগো কাউয়ায় ও পোছে না। আর হোন, তোর মাইয়া যেমনে আছে হেমনেই থাকব। বেশি বাড়াবাড়ি করলে, এমুন ব্যবস্থা করমু, তোর মুখ দেখানোর জো থাকব না কইয়া দিলাম।’
কুলসুমার মাথায় বজ্রসহ আকাশ ভাইঙ্গা পড়ে। কোন কুল কিনারা পায় না। মুখ ভর্তি থুতু আসে। বমি করে সব ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছা করে। তার কেবলি থেকে থেকে একটা কথা মনে হয়, কোথায় যেনো শুনেছে, যে পুরুষ তার মেয়ের সাথে বিছানায় যায়, তখনি নাকি স্ত্রীর সাথে তার বিয়ে বাতিল হয়ে যায়। এটাই শরিয়তের বিধান।
এতটুকু বলে থামে কুলসুমা। পানি খেতে চায়। তারপর আবার বলা শুরু করে, বুঝলেন ডাক্তর আফা কি করসি না করসি কিচ্ছু মনে নাই। শুধু মনে হইসে ওরে উচিৎ শিক্ষা দিতে হইব। এই অনাচার সহ্য করা যায়না। খাক এখন জেলের ভাত। আমি এমনিও মরসি ওমনি ও মরসি। ওরে নিয়াই মরমু। ছাইড়া দিমু না।
৩.
কুলসুমার মেয়ে এখন ওসিসিতে ভর্তি। ডাক্তার, আইনজীবী পুলিশ সমাজকর্মি ও সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গলদঘর্ম এই বাচ্চার পিতৃ জটিলতা নিয়ে। ভাবা যায় কনসিকুয়েন্স কি হতে যাচ্ছে? ওই সন্তানের বাবার নাম কি হবে? বাচ্চার বাপ তার মায়েরও বাপ!ভয়ংকর নরক অবস্থা বললেও কম বলা হয়!
দেশের আইনে তেইশ সপ্তাহের সুস্থ সবল বাচ্চা টার্মিনেট করা যায় না। হোক সে অবৈধ বাচ্চা। না হলে হয়তো এবর্ট করে ফেলাটাই ভালো হতো। ঘটনাটা কতটা ভয়াবহ নৈতিক স্খলনের প্রতীক, চিন্তা করলেই ঘাড় বেয়ে শীতল স্রোত নামে!
একটা অনাচার যখন দিনের পর দিন ঘটতে থাকে, সেটাতে মানুষ অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। মনে হয় না অন্যায় কিছু। বাবা মেয়ে সম্পর্ক নিয়ে মানুষ ভিণ্ন কিছু কল্পনাও করতে ভয় পায়। আর এর ফায়দা উঠায় কিছু কিছু বর্বর। পুলিশের কাস্টডিতে বাবাকে নেয়ার সময় মেয়েটির কাণ্না অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। পচনের ভয়াবহতা কতটা গভীরে নতুন করে ভাবতে শেখায়। অনাচারে অভ্যস্ততার ইঙ্গীত দেয়। সেটাই সবচেয়ে ভয়ংকর দিক। ভাবনার বিষয়। মেয়েটা বুঝতেই পারছেনা তার কত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। তারপরও সে বাবার জন্য কাঁদে!
ওসিসির এটেন্ডিং ডাক্তার সামিহার(ছদ্মনাম) মন চুড়ান্ত খারাপ। ভাবে, দুরর ডাক্তারদের এই এক জীবন। চকচকে সমাজের ক্লেদাক্ত কুৎসিত রূপ না চাইলেও তারা দেখে, দেখতে হয়। মুখোশ ও মুখের ভিতরের পচা গলা পূতিগন্ধময় রুপটা তাদের কাছে এসে খোলে সো কলড সভ্যরা। সব দেখে শুনে প্রফেশনাল ওথ মেনে চিকিৎসা দিয়ে যায় তারা। এমনও হয়েছে, রোগীর কথা শুনে বমি করে দিয়েছি, চোখের কোনে চিকচিক মুক্তা নিয়ে প্রেসক্রিপশন লিখেছি। পাপিষ্ঠার শরীর ছুঁয়ে চিকিৎসা দিয়ে ডলে ডলে হাত ধুয়েছি। তারপর মুখে কুলুপ এটে থেকেছি। না হলে দেখা যেতো কত মুখ আর কত মুখোশ।
বাবা সবচেয়ে নির্ভরতার নাম। শুদ্ধতম মানুষের সঙ্গা কন্যার কাছে। বাবা কন্যার সম্পর্ক আত্মিক। দেহজ নয়। এই বাবাই যখন…
সন্তান ভুল করতে পারে। বাবা নয়। মা নয়। বাবা মারা সন্তানের চারপাশ নৈতিকতার মোড়কে মুড়ে দেন। আর নৈতিকতার বাঁধ যখন ভেঙ্গে যায়, তখন কোন সম্পর্ক আর সম্পর্ক থাকে না। নারী পুরুষ তখন জননাঙ্গ সম্বলিত প্রাণী কেবল। আর মানুষ যদি শুধুমাত্র জননাঙ্গ দ্বারা চালিত হয়, তখন তার পক্ষে সবকিছুই সম্ভব। সব।
এই গল্পগুলো লিখতে ইচ্ছা করে না। বিবমিষা, অস্বস্তি দম বন্ধ লাগে। তারপরও সমাজের অন্ধকার অধ্যায়গুলোতে আলো জ্বালানো দরকার। জানলে পরিবর্তী পদক্ষেপ নিতে সহজ হয়।
শোন বাবা, শোন পুরুষ, শোন ছেলে, তোমারও কিছু দায় আছে মানুষ হিসাবে জন্মানোর। দায় আছে মাতৃদুগ্ধের। দায় আছে সন্তানকে সুরক্ষা দেয়ার। দায় আছে পরকালের। শুধুমাত্র একটা পশু প্রবৃত্তির কাছে এতগুলো দায় মাথা কুটে মরতে পারে না। অবশ্যই না। পুরুষ হওয়ার আগে মানুষ হওয়া দরকার। নির্জলা নীরেট শুদ্ধ মানুষ। সেটাই বেশি জরুরি।
ডা. ছাবিকুন নাহার
মেডিকেল অফিসার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ
ফিচার রাইটার: জামিল সিদ্দিকী
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ,গাজীপুর
সেশন: ২০১৫-১৬