যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনারী কেয়ার ইউনিটে কর্তব্যরত এক ডাক্তারকে মারপিট করেছে রোগীর স্বজন পরিচয়দানকারী সংঘবদ্ধ একটি দুর্বৃত্ত্বচক্র। চিকিৎসা অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে গতকাল সকালে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। সহকর্মীর উপর হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে হাসপাতালের অন্য ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবীরা কর্ম বিরতি ও বিক্ষোভ করেছে। এতে রোগীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবী ও হাসপাতালে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার জন্যে জেলা প্রশাসনের কাছে পত্র দিয়েছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার শ্যামল কৃষ্ণ সাহা। একই সাথে ডাক্তারকে মারপিটকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের দাবিতে কোতয়ালী থানায় এজাহার দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, ঝিনাইদহ কোটচাঁদপুরের জালাল মিয়ার স্ত্রী হাসিনা বেগমকে (৫০) গত ২৭ মে রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হয়। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে করোনারী কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করান। তার ভর্তি রেজিস্ট্রেশন নম্বর ২২৫৮/২৪। মহিলা ইউনিটের ১ নম্বর শয্যায় রেখে তার চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হন হাসিনা বেগম হার্ট ও কিডনী রোগে আক্রান্ত।ডাক্তাররা সাধ্যমত চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হচ্ছিল না। ২৮ মে রাতে তার অবস্থার চরম অবনতি হয়। কর্তব্যরত ডাক্তার প্রিয়ব্রত রায় ৩ দফা রোগীর কাছে গিয়ে চিকিৎসা দিয়েছেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। ২৯ মে ভোর সাড়ে ৫টায় হাসিনা বেগমের মৃত্যু হয়।
মৃত্যুর খবর স্বজনদের কাছে পৌঁছে যায়। যশোর আরএন রোড এলাকার বাসিন্দা ও রোগী হাসিনা বেগমের স্বজন পরিচয়দানকারী ৫/৬ জন যুবক করোনারী কেয়ার ইউনিটে ডাক্তার প্রিয়ব্রত রায়ের চেম্বারে। রোগীর মৃত্যু হলো কেন কৈফিয়ত চান তারা। এক পর্যায়ে গালিগালাজ শুরু করেন। তাদের শান্ত করার চেষ্টা করায় দু’যুবক ডাক্তার প্রিয়ব্রতকে মারপিট করে। এতে আহত হন তিনি। সহকর্মীরা তাকে জরুরি বিভাগ থেকে চিকিৎসা করান। এ সুযোগে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।
সকাল ৮টার পর হাসপাতালের সকল ডাক্তার কর্মস্থলে এসে জানতে পারেন ডাক্তার প্রিয়ব্রত হামলার শিকার হয়েছেন। তাৎক্ষণিক তারা কর্মবিরতির ঘোষণা দেন। বন্ধ হয়ে যায় ভর্তি রোগী ও বর্হিঃ বিভাগে আসা রোগীদের সব ধরণের চিকিৎসাসেবা। শুরু হয় জনসাধারণের ভোগান্তি। চিকিৎসা পাওয়ার জন্যে দুপুর ১২টা পর্যন্ত রোগীদের অপেক্ষা করতে হয়। পরিস্থিতি বেসামাল হওয়ার খবর পেয়ে হাসপাতালে আসেন অতিরিক্তি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল হাসান, সহকারী পুলিশ সুপার (ক-সার্কেল) ভাস্কার সাহা, এনডিসি নাজমুল আলম, কোতয়ালী ওসি ইলিয়াস হোসেন। তারা আন্দোলনরত ডাক্তারদের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দেন। সকাল সাড়ে ১০টায় হাসপাতালের সভাকক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ডাক্তাররা দাবি তোলেন হাসপাাতলে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে হামলাকারীদের ২৪ ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয় হামলাকারীদের ২৪ ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতারের সবরকম চেষ্টা চালানো হবে। নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। প্রশাসনের আশ্বাসের পর ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নেন কর্মবিরতি প্রত্যাহারের। দুপুর ১২টা থেকে হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়। প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে সভায় উপস্থিত ছিলেন, হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার শ্যামল কৃষ্ণ সাহা, সহকারী পরিচালক ও যশোর বিএমএ’র সভাপতি ডাক্তার একেএম কামরুল ইসলাম বেনু, সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার এম এ শামসুল আরেফিন, সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার কাজল কান্দি দাঁ, ডাক্তার অজয় কুমার সরকার, জুনিয়র কনসালটেন্ট ডাক্তার শরিফুল আলম খান, ডাক্তার শেখ মোহম্মদ আলী প্রমূখ।
সভা শেষে যশোর বিএমএ’র উদ্যোগে হাসপাতাল চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। সংগঠনের সভাপতি ডাক্তার একেএম কামরুল ইসলাম বেনুর নেতৃত্বে মিছিলে ডাক্তার, নার্সসহ হাসপাতালের সকল পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবী অংশ নেন। মিছিল শেষে হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের সামনে প্রতিবাদ সভা করা হয়। এতে ডাক্তার একেএম কামরুল ইসলাম বেনু বলেন, মানুষের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে ডাক্তাররাই আজ জীবন সংকটে রয়েছেন। হাসিনা বেগম নামে যে রোগীর মৃত্যু চিকিৎসা অবহেলায় হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে ডাক্তারের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে তা অত্যন্ত পীড়াদায়ক। ওই রোগীর অবস্থা ভর্তি সময় থেকেই খারাপ ছিলো। হার্ট ও কিডনী আক্রান্ত ছিলো তার। একাধিকবার তার স্বজনদের জানানো হয়েছে। যশোর হাসপাতালের সক্ষমতা ও ডাক্তারদের সামর্থ অনুযায়ী সাধ্যমত চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি রোগীর স্বজনদের জানানো হয়েছিলো উন্নত চিকিৎসার সুবিধা পেতে হলে ঢাকা নিয়ে যেতে। কিন্তু তারা তা করেনি। এক পর্যায়ে রোগীর অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মারা যান তিনি। এতে ডাক্তারের দোষ কি ? রোগীর স্বজনরা কর্তব্যরত ডাক্তারকে মারপিট করলো। এটা ডাক্তার সমাজ তথা যশোর বিএমএ মেনে নেবে না। ডাক্তার বেনু ঘোষণা দেন, প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে, ২৪ ঘন্টার মধ্যে হামলাকারীদের গ্রেফতার করবে। হাসপাতালে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। তাদের আশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে বিএমএ’র পক্ষ থেকে কঠোর কোন কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে না। নির্দিষ্ট সময় পরও যদি হামলাকারীরা গ্রেফতার না হয় সেক্ষেত্রে লাগাতার কর্মবিরতিসহ কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। ডাক্তারের উপর হামলার প্রতিবাদে ডাক্তার, নার্সসহ সকল স্বাস্থ্যসেবীকে কালো ব্যাজ ধারণের আহবান জানানো হয়। এদিকে কোতয়ালী মডেল থানা থেকে জানা গেছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে এজাহার দিয়েছেন তা গতকালই নিয়মিত মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। মামলা নম্বর ১০৫। ওসি ইলিয়াস হোসেনকে রাত ৮টা ৩৬ মিনিটে মোবাইল করা হলে তিনি জানান, ডাক্তারের হামলাকারীদের গ্রেফতারের ব্যাপারে কোন অগ্রগতি হয়নি।
তথ্য দাতাঃ মুশফিকুল আরেফিন খান
সূত্র: গ্রামের কাগজ
বিচার চাই