রমজানে করোনা প্রতিরোধের জন্য আপনি তৈরি তো?

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২২ এপ্রিল, ২০২০, বুধবার:

সবাইকে পবিত্র রমজান মাসের আগাম শুভেচ্ছা। আর মাত্র ২/৩ দিন পর সারা দুনিয়াব্যপি শুরু হচ্ছে মাহে রমজান। এই মাসকে ঘিরে সবসময় আমাদের আগাম আয়োজন থাকে। কিন্তু এই বছর করোনার মহাপ্রলয়ে আমরা এই আয়োজন থেকে বেশ দূরেই আছি। করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে কিন্তু এই মাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজকে আমার এই লিখায় করোনার প্রতিরোধে রমজান মাসে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে।

আমরা যদি আমাদের স্বাস্থ্যজনিত বদঅভ্যাসগুলির দিকে তাকাই তাহলে দেখি যে, আমাদের দেশে যুগযুগ ধরে বেশির ভাগ মানুষ যেখানে সেখানে কফ-থুথু ফেলে থাকে। বিশেষ করে, রমজান মাসে এটি আমাদের রাস্তা-ঘাটে, অফিস, আদালতে, মার্কেট, হাসপাতাল বা অন্যান্য পাবলিক প্লেসের খুবই পরিচিত দৃশ্য। আমরা জানি যে এটি করোনা ছড়ানোর একটি অন্যতম প্রধান উপায়। মাটিতে পড়ে থাকা কফ-থুথু আমাদের পায়ের জুতা, স্যান্ডেল ও নিচের দিকের পরিধেয় কাপড়ে লেগে গিয়ে করোনার সংক্রমণ অনেক বাড়িয়ে দিবে।

তাছাড়া নাক-মুখ না ঢেকে অরক্ষিত ভাবে হাঁচি-কাশি দেওয়া, সংক্রমিত রুগীর সংস্পর্শেও এই রোগ ছড়ায়। সামাজিক বা দৈহিক দূরত্ব বজায় না রাখা, অকারণে বাড়ির বাইরে যাওয়া ইত্যাদি আরও অনেক কারণও পরোক্ষভাবে এই রোগ ছড়াচ্ছে। তদুপরি, এই সময়ে অকার্যকর লকডাউন পরিস্থিতিতে পুরো জাতি বেসামাল।

এখানে উল্লেখ্য যে, যেখানে সেখানে কফ-থুথু ফেলার কারণ হিসাবে অনেকে বলেন যে, মুখ-গহ্বরের যে নিঃসরণ (লালা, থুথু ইত্যাদি) তা রোজা রেখে গিলে ফেললে রোজা ভেঙ্গে যায়, যা ধর্মীয়ভাবে মোটেও সঠিক নয়। বরং ইসলামে বলা আছে যে, এই নিঃসরণ গিলে ফেলা একটি স্বাভাবিক বায়োলজিক্যাল প্রক্রিয়া। তাছাড়া বিজ্ঞানও বলে যে, এই নিঃসরণ শরীরের জন্য উপকারী। কিভাবে? এই নিঃসরণে থাকে রোগ প্রতিরোধক অনেক দরকারি পদার্থ-যেমনঃ অ্যান্টিবডি, এনজাইম, ভাল জীবাণু ইত্যাদি। এগুলো আমাদের মুখগহ্বর ও দাঁতের স্বাস্থ্য ভাল রাখে, খারাপ জীবাণুর সাথে যুদ্ধ করে তাঁদের শরীরে প্রবেশ প্রতিহত করে। তাছাড়া এই নিঃসরণ পাকস্থলীতে গিয়ে আমাদের এসিডিটির সমস্যা, ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স, মুখের দুর্গন্ধ ইত্যাদি দূর করে। বারবার থুথু ফেললে আমাদের মুখের ভিতরটা শুকিয়ে যাবে আর আমাদের ঘন ঘন পানি পিপাসা পাবে। কিন্তু রোজারত অবস্থায় আমরা পানি পান করতে পারবো না।

তাহলে করোনা মোকাবিলায় এই রমজান মাসে করণীয় কী?

১) মুখের লালা, থুথু বাইরে ফেলবেন না বরং তা গিলে তার উপকারসমূহ শরীরের রোগসমূহ প্রতিহত করার জন্য কাজে লাগান।

২) হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলুন। অর্থাৎ হাঁচি-কাশির সময় টিস্যু, রুমাল বা পরিস্কার কাপড় ব্যবহার করুন। এগুলো না থাকলে হাতের কনুই দিয়ে মুখ ঢাকুন। ব্যবহারের পর টিস্যু বা কাপড় একটি ঢাকনাযুক্ত বিনে ফেলবেন। তারপর হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলবেন।

৩) রমজান মাসে তারাবীর নামাজ বাড়িতেই পড়বেন , যেই পর্যন্ত সরকার থেকে এই ব্যপারে কোন সুনির্দিষ্ট আদেশ জারি না হয়।

৪) যে কোন ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় জমায়েত (একত্রে তারাবীর নামাজ পড়া), ইফতার পার্টি ইত্যাদি করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকবেন।

৫) এই মাসে বাড়তি এবাদতে আমাদের অনেক উপকার। এতে বার বার অযু করার ফলে শরীরের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা পূর্বের চাইতেও বেশি বজায় রাখা যায়, আবার শরীরের জন্য ব্যায়ামও হয়। এগুলো করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের জরুরী বিষয়। এছাড়া এতে মানসিক স্বাস্থ্যও আমাদের ভাল থাকবে।

৬) অকারণে বাইরে যাওয়া বন্ধ করে বাড়িতে অবস্থান করতে হবে এবং সরকারের লকডাউন এর নির্দেশাবলী পালন করতে হবে। এই সময়ে তা কিছুটা সহজ হবে আশা করা যায়। কারণ খালি পেটে বাইরে, রোদের মধ্যে অযথা অনেকেই বের হতে চাইবেন না।

৭) ঘরে থেকে একে অন্যকে সাহায্য করে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন বাড়ানোর এটিই উপযুক্ত সময়।

৮) ঘরের তৈরি খাবারে ইফতার আয়োজন করবেন। যা স্বাস্থ্যকর এবং উপাদেয়। রোজা খোলার পর প্রচুর পানি ও পানীয় জাতীয় খাবার, ফল ইফতারের আয়োজনে রাখবেন। পরিমিত খাবেন, কারণ আপনার বাড়িতে বা দেশের যে কোন অপ্রত্যাশিত ও জরুরী অবস্থার সৃষ্টি হলে যাতে খাদ্য সংকটে না পড়তে হয়।

৯) সকল স্থানে, অফিসে, হাসপাতালে বা প্রতিষ্ঠানগুলিতে যেখানে সেখানে কফ-থুথু না ফেলার আদেশ দিয়ে এর সাথে করোনা সংক্রমণের সম্পৃক্ততা উল্লেখ করে সকলকে লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে। প্রয়োজনে আইন করে তা কার্যকর করতে হবে।

১০) একই সাথে ব্যবহৃত টিস্যু, অন্যান্য বর্জ্য ফেলার জন্য ঢাকনাযুক্ত বিন বা কন্টেইনার অবশ্যই সরবরাহ করবেন এবং তা সময়মত পরিস্কার ও নিষ্কাশনের (ডিসপোজালের) ব্যবস্থা করতে হবে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানকেই।

১১) যাদের অসংক্রামক রোগগুলো (উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের অসুখ, হাঁপানি, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ ইত্যাদি) আগে থেকেই আছে, তারা অবশ্যই নিজ নিজ চিকিৎসকের সাথে নিজেদের রোজা রাখা ও ঔষধ সেবনের ব্যাপারে পরামর্শ করে নিবেন। এটি বিশেষভাবে জরুরী এই কারণে যে, এই রুগীরা বিশেষভাবে করোনাতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।

১২) সকল ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিক ভাই–বোনদের উপরোক্ত বিষয়গুলোতে জনগণকে সচেতন করার ব্যপারে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। বিশেষ করে যেখানে সেখানে কফ-থুথু না ফেলার ব্যপারটিকে গুরুত্ব সহকারে প্রচার করতে হবে। এক্ষেত্রে ছবি, শিক্ষামূলক নাটক বা কার্টুন এর ব্যবহার করা যেতে পারে।

তাই আসুন এই পবিত্র মাসে আমরা একজোট হয়ে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনার মোকাবেলা করি। চেষ্টা ও সদিচ্ছা থাকলে আল্লাহ্‌ নিশ্চয়ই আমাদের সহায় হবেন।

লেখক:
প্রফেসর ডা. শারমিন ইয়াসমিন
চেয়ারপার্সন, পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ এবং বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।

Abdullah Al Maruf

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের তৈরি করোনার ভ্যাক্সিন আগামীকাল মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করবে যুক্তরাজ্য!

Wed Apr 22 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ বুধবার, ২২ এপ্রিল, ২০২০ আগামীকাল (২৩ এপ্রিল) বৃহস্পতিবার মানবদেহে পরীক্ষামূলক করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করবে যুক্তরাজ্য। ভ্যাক্সিনটির নাম CHADOX1 NCOV-19। করোনাভাইরাস মুক্তকরণে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের তৈরি এটিই প্রথম ভ্যাক্সিন, যা মানবদেহে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। পরীক্ষামূলকভাবে যাদের দেহে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে তারাও প্রস্তুত আছেন বলে জানান বিজ্ঞানীরা। ব্রিটেনভিত্তিক […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo