মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সবচেয়ে বড় উপায় চিকিৎসা সেবা। আমাদের এই কলুষিত সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে যারা নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে নিজের কষ্টের কথা অনুভব করে দুর করতে চায় অন্যর কষ্টকে। যাদের জন্মই হয় মানুষের সেবা দানের জন্য। এমনি এক মানুষের নাম মোঃ জয়নাল আবেদীন। পেশায় তিনি রিক্সা চালক। রিক্সা চালানোর টাকা জমিয়ে তৈরী করেছেন একটি ছোট হাসপাতাল। এই হাসপাতলে দেওয়া হচ্ছে বিনামুল্যে চিকিৎসা সেবা ও ঔষধ!
ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রায় ১৫ কি.মি. দূরের প্রত্যন্ত চরাঞ্চল টান হাঁসাদিয়া গ্রামে ৪৩ বছর আগে জয়নাল আবেদীনের বৃদ্ধ পিতা আবদুল গনি এক রাতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পাশের সিরতা বাজারের একমাত্র ওষুধের দোকান থেকেও ওষুধ পাওয়া যায় নি। কাঠের তক্তায় বাঁশ বেঁধে ভাইদের সহযোগিতায় অসুস্থ বাবাকে কিছু দূর নেয়ার পর তিনি মারা যান। বিনা চিকিৎসায় বাবার এমন মৃত্যু বিশ বছরের যুবক জয়নাল মেনে নিতে পারেননি। গ্রামের মানুষের জন্য স্বপ্ন দেখেন হাসপাতাল গড়ার।
অভাবের সংসারে কারোরই লেখাপড়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। অনেক ভেবে নিজ মনে শপথ নেন ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালিয়ে হাসপাতাল করার মতো অর্থ নিয়ে আবার বাড়ি ফিরবেন। অন্যথায় আর কোনো দিন বাড়ি ফিরবেন না- এমন প্রত্যয় নিয়ে কাউকে কিছু না বলে স্ত্রী ও শিশুকন্যা মমতাজকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়েন জয়নাল আবেদীন।
স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তারপর ২৮ বছরের সংগ্রাম। ২৮ বছর রিকসা চালিয়ে জমানো পৌনে তিন লাখ টাকা নিয়ে ফিরে আসেন তার গ্রামের বাড়িতে।
২০০১ সালের এক শুক্রবার সকালে গ্রামের মানুষকে ডেকে বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য তার স্বপ্নের মমতাজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কথা জানান। গ্রামের সবাই তার কথা শুনে হাসাহাসি করেন। এমনকি তার পরিবারও।
সে সময় সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও পাশের গ্রামের যুবক পল্লী চিকিৎসক মো. আলী হোসেন তার পাশে এসে দাঁড়ান। অনেক কষ্টে জমানো টাকায় ২৪ শতক জমি কিনে ২০০১ সালে ছোট একটি আধাপাকা টিনশেড ঘর তৈরি করে জয়নাল আবেদীন মেয়ের নামে চালু করলেন মমতাজ হাসপাতালের কার্যক্রম। যেখানে প্রতিদিন অসুস্থ মানুষদের বিনামূল্যে সকাল-বিকেল চিকিৎসা করা শুরু করেন পল্লী চিকিৎসক মো. আলী হোসেন। শুধু তাই নয়, রোগীদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী বিনামূল্যে ওষুধও তুলে দেন জয়নাল আবেদীন।
শুরু তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন। ষাট বছর বয়সেও ঢাকায় যেয়ে রিক্সা চালাতেন আর কষ্টার্যিত টাকা নিয়ে ফিরে আসতেন হাসপাতালের জন্য ঔষুধ কেনার টাকা নিয়ে। বিভিন্ন সময় কটূক্তি আর অপমান করেছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে শুরু করে। সে সময় গড়ে প্রতিদিন গ্রামের দরিদ্র ৩০-৪০ জন মানুষ এ হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ পেতে থাকে। এখন প্রতিদিন গড়ে ১২০ থেকে ১৩০ জন রোগী প্রতিদিন চিকিৎসা সেবা পেয়ে আসছে।
ছোট্ট হাসপাতালটিতে বর্তমানে ৬টি শয্যা রয়েছে। রয়েছে একটি ডিসপেনসারি। ডিসপেনসারিতে রয়েছে প্রয়োজনীয় ওষুধ সামগ্রী। এছাড়া ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে সহকারী অধ্যাপক ডা. হেফজুল বারী খান সপ্তাহে একদিন এই হাসপাতালে এসে বিনামূল্যে রোগী দেখেন।
৩০ এপ্রিল, ২০১৪, এ ব্যক্তিকে চাঁদ সুলতানা পুরস্কার প্রদান করল ঢাকা আহছানিয়া মিশন। ২০০৫ সালে আমেরিকা প্রবাসী শাহনাজ পারভীন নামে এক মহিলা এক হাজার ডলার হাসপাতালের উন্নয়নে তাকে সহযোগিতা দেন। ২০১১ সালে পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদনের পর বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ও সংগঠন তার পাশে দাঁড়িয়েছে। আর্থিক সহযোগিতায় হাসপাতালের নামে প্রায় চার একর ফসলি জমি কেনা হয়েছে। নতুন ঘর তৈরি করা হয়েছে। মো: জয়নাল আবেদীন প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২২ হাজার ৩১৫ জন রোগীকে সেবা প্রদান করা হয়েছে।
রিক্সা চালক জয়নাল শুধু চিকিৎসা সেবা নয় দরিদ্র পরিবারের সন্তানদেরকে বিনামুল্যে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ২০০৭ সালে নির্মান করেন টান হাসাদিয়া বেসরকারি শিশু স্কুল । স্কুলটি ১০ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এই স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ১২০ জনে। এখানে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বিনামূল্যে বই, খাতা, কলম, ব্যাগ সহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরন দেওয়া হয়।