মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল, ২০২০
আর এক সপ্তাহ পরই রোযা। এ মাসে প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমদের সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযা রাখার আদেশ করা হয়েছে। তবে অসুস্থতাজনিত কারণে রোযা রাখার ক্ষেত্রে শিথিলতা আছে। পবিত্র কুরআনে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে,
“আর তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে তারা অন্য সময় তা পূর্ণ করে নেবে।” (সূরা বাকারা : ১৮৫)
সেই হিসেবে ডায়াবেটিক রোগীদের রোযা রাখার ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তবে তারা চাইলে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন মেনে সিয়াম সাধনা করতে পারেন। রোযা রাখার ক্ষেত্রে ডায়বেটিস রোগীদের ৩ টি বিষয় সম্পর্কে খেয়াল রাখতে হবে-
১। ডায়বেটিস সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান রাখা, যেমন: কমে গেলে কি হতে পারে, বাড়লে কি হতে পারে। এমন কিছু হলে প্রাথমিকভাবে কি করণীয়, এবং কোন ধরণের বিশেষ সেবা গ্রহণ করতে হবে।
২। নিয়মিত বা জরুরী প্রয়োজনে ব্লাড গ্লুকোজ চেক করার সুযোগ আছে কিনা। বাসায় গ্লুকোমিটার আছে কিনা।
৩। রোগী যে ওষুধ গুলো খায় বা ইনসুলিন নেয়, সেগুলো রমজানের রুটিনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা। ওষুধ পরিবর্তন করতে হলে রোযার কমপক্ষে ১ মাস আগেই সেটি করতে হবে, যাতে করে নতুন ওষুধগুলো শরীরের সাথে খাপ খেয়ে নিতে পারে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট সময় পায়। তাই যারা ডায়াবেটিক রোগী তাদের উচিৎ রোযা শুরু হওয়ার আগেই ডাক্তারের কাছে যেয়ে ওষুধ এডজাস্ট করে নেয়া।
★ প্রচলিত Biphasic ও Rapid acting insulin ইঞ্জেকশন, এবং মুখে খাওয়ার ওষুধের মধ্যে Insulin Secretagogues (Sulphonylureas) যেমন Glimepiride, Gliclazide ও Glipizide গুলো Hypoglycaemia করে অর্থাৎ গ্লুকোজ কমিয়ে দেয়। রমযান মাসে Fasting এর জন্য রক্তে গ্লুকোজ এমনিই কিছুটা কমে যায়, তার উপর উপরের ওষুধগুলো যেহেতু হাইপোগ্লাইসেমিয়া করে, তাই এসব ওষুধ গ্রহণকারী রোগীদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। রোযা রাখা অবস্থায় কখনো হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে, রোযা ভেঙে ফেলতে হবে।
এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বলা হয়েছে,
“তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে হত্যা করোনা। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু।” (সূরা নিসা : ২৯)
ওষুধের ডোজ এডজাস্টমেন্ট করার সময় যেটা মনে রাখতে হবে, স্বাভাবিক সময়ে দিনের প্রধান খাবার সকালের নাস্তা হলে, রোযায় প্রধান খাবার কিন্তু ইফতারি। তাই সকালে নাস্তার সময় যে ডোজে ওষুধ খেত সেটা সে খাবে ইফতারিতে। আর রাতে যে ওষুধ খেত সেটা খাবে সেহরীতে। এবার একটা বিষয় চিন্তা করতে হবে। ইফতারীর সময় অনেক বেশি খাওয়া হয়, মাঝে রাতেও আবার খাওয়া হয়, কিন্তু সেহরীর পর দীর্ঘ সময় থাকতে হয় না খেয়ে। তাই সেহরীর ডোজকে স্বাভাবিক ডোজের চেয়ে কমাতে হবে! কতটুকু কমাতে হবে? ২৫-৫০% কম। অর্থাৎ স্বাভাবিক ওষুধের অর্ধেক বা তিন ভাগের দু ভাগ খাবে সেহরীতে।
★ Sulphonylurea – Glimepiride সকালে ১ বেলা খেলে, রোযার সময় সেটি ইফতারে খাবে। আর Gliclazide দিনে দুবেলা খেলে, রোযার সময় স্বাভাবিক ডোজের অর্ধেক সেহরিতে ও পুরোটা ইফতারে খাবে। যেহেতু এই ওষুধগুলো হাইপোগ্লাইসেমিয়া করে, সেহেতু ইফতারির সময় হালকা কিছু দিয়ে ইফতারি করে, এরপর ওষুধটা খেয়ে তার ৩০ মিনিট পর ভারী ইফতারি করতে হবে।
Biphasic Insulin এর ক্ষেত্রে উপরের ওই একই নিয়ম। অর্থাৎ, সকালের ইনসুলিন ইফতারীতে, আর রাতের ইনসুলিনের অর্ধেকটা সেহরীতে। এরপরেও ইফতারীর পর ও সেহরীর আগে গ্লুকোমিটার দিয়ে ব্লাড গ্লুকোজ চেক করে ডোজ এডজাস্ট করা যাবে।
★ কিন্তু যারা ৩ বেলা Rapid acting insulin নেয়, তাদের ক্ষেত্রে সেটি চেঞ্জ করে উপরের নিয়মে সেহরি ও ইফতার এই দু’বেলা Biphasic insulin দেওয়া যেতে পারে।
★ Insulin এর ক্ষেত্রে আর একটি ভাল অপশন Long acting insulin, যা প্রতিদিন সন্ধ্যায় ১ বার নিলেই হয়, আবার হাইপোগ্লাইসেমিয়াও করে না। তাই যারা Biphasic বা Rapid acting insulin নেয়, রমযান মাসে তাদের জন্য একটি ভাল বিকল্প হল এই Long acting insulin. তবে প্রবলেম হল – এর দাম বেশি, সহজলভ্য নয়, ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় নেয় বেশি।
★ রমযান মাসে আর একটি ভাল অপশন হল GLP-1 agonists যেমন Exenatide, Liraglutide. এগুলোও ইনসুলিনের মত injectable ওষুধ। Insulin এর বিকল্প হিসেবে এগুলো দেওয়া যায়। এগুলোর সুবিধা হল, এরা Glucose dependent insulin secretagogue. গ্লুকোজ বাড়লেই কেবল এরা insulin secretion বাড়ায়, তাই তারা হাইপোগ্লাইসেমিয়া করে না; অন্যদিকে insulin এর মত তারা weight gain ও করে না, তাই obese patient দের ক্ষেত্রে সহজেই এদের ব্যবহার করা যায়।
★ আর যারা injectable agent নিতে চায় না, আবার sulphonylurea ব্যবহারে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি আছে, তাদের জন্য মুখে খাওয়ার ওষুধের মধ্য সবচেয়ে ভাল হল incretin mimetics (DPP-4 inhibitors) যার মধ্যে আছে sitagliptin, vildagliptin, linagliptin ইত্যাদি। GLP-1 agonist এর মত এরাও glucose dependent insulin secretagogue, অর্থাৎ রক্তে গ্লুকোজ বাড়লে insulin secretion বাড়ায়, তাই এদের ক্ষেত্রেও হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি নেই।
উপরের আলোচনা থেকে একটি বিষয় ক্লিয়ার, আর সেটি হল – রমযানে ডায়বেটিস রোগীদের অন্যতম ঝুঁকি হল হাইপোগ্লাইসেমিয়া!
রোযা রেখে তাই-
> হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয় এমন ড্রাগ খুব সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা।
> সবচেয়ে ভাল হয় DPP-4 inhibitors বা GLP-1 agonists এর মত incretin mimetics ব্যবহার করা যারা হাইপো করে না।
> আর একটা বিষয় যা আমরা সবাই জানি, ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে প্রধান দুটি নিয়ামক হল Diet ও Discipline. রমযান মাসে Diet control করতে যেয়ে যেন ইফতারির পর রাতের খাবার মিস না হয়। আর নিয়ম মানতে গিয়ে যেন দিনের বেলায় অতিরিক্ত পরিশ্রম করা না হয়। কারণ meal skipping (খাবার বাদ দেয়া) ও strenuous exercise (শারীরিক পরিশ্রম) দুটোই হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
পৃথিবীর সকল অসুস্থ মানুষ সুস্থ হয়ে উঠুক, এবং চিকিৎসকরা সেই সুস্থতার আস্থাশীল নিয়ামক হিসেবে কাজ করুক, এই কামনায় শেষ করছি। ধন্যবাদ সবাইকে।
🍀 রোযা অবস্থায় রোগী অসুস্থ হয়ে গেল, কারণ যদি হয় Hypoglycaemia তবে যে symptoms গুলো থাকবে,
> দূর্বলতা
> ঘাম হওয়া
> বুক ধরফর করা
> হাত পা কাঁপা
> কনফিউশন
> অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
এসব প্রকাশ পেলে ভাল হয় সাথে সাথে ব্লাড গ্লুকোজ চেক করে দেখা। যদি সেটা 4 mmol/L এর নিচে নেমে যায় তাহলে কনফার্ম Hypoglycaemia! চেক করা সম্ভব না হলেও যেহেতু symptoms আছে তাই,
> যদি রোগীর জ্ঞান থাকে তাহলে সাথে সাথে গ্লুকোজ বা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার যেমন চিনির পানি, মিষ্টি, শরবত বা অন্য কোন শর্করা যা আছে বাসায় সেটাই খাইয়ে দিতে হবে।
> আর জ্ঞান না থাকলে সোজা হাসপাতাল, চিকিৎসা সেখানেই হবে, গ্লুকোজ শিরায় দিতে হবে।
আর এরকম কোন ঘটনা ঘটলে একটু খোঁজ খবর নিয়ে দেখতে হবে স্বাভাবিক খাবার গ্রহণে তার কোন অনিয়ম হয়েছে কিনা। যদি তেমন কিছু হয় সেটা ঠিক করা। আর সেটা ঠিক থাকলে রোযা না রাখতে নিরুৎসাহিত করা এবং রোগীকে এ ব্যাপারে বুঝিয়ে বলা।
COVID-19 এর দুঃসময়ে সবাই সকল সমস্যা কাটিয়ে ঠিকভাবে রোযা রাখতে পারে সেই কামনা করছি। ধন্যবাদ।
ডা. কাওসার
ঢামেক, কে-৬৫
একাডেমিক কো-অর্ডিনেটর, পোস্টগ্রাজুয়েট এডুকেশন, প্ল্যাটফর্ম একাডেমিয়া।