প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩ মে ২০২০, রবিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
ডা. রেহেনুমা আরিফ তার ফেসবুক একাউন্টে পোস্ট দিয়েছেন- ‘না আমি ভাল নেই। হ্যাঁ, আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। অন্যেরা যখন বাসায় বসে বসে বিরক্ত, আমি তখন হাসপাতালে যাই। ভয় নিয়ে ডিউটি করি। ভয় নিয়ে বাড়ি ফিরি। বাসায় আমার দুটি ছোট বাচ্চা। আমি সহ আমার বারো কলিগ এখন কোভিড রিপোর্টের অপেক্ষা করছি। আমার ভাই হোম আইসোলেশনে। সে হোমে আবার বাবা মা আছেন। আমার ভাবি আক্রান্ত। তার পাঁচ বছর বয়সী ছোট বাবু সাসপেক্টেড। আপনারা আমাকে বলবেন ইনসেন, হ্যাঁ আমি ইনসেন।’
‘বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ডাক্তারদের অনলাইন গ্রুপ আছে। আজ সেখানে একটি পোস্ট দেখলাম-
“আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনেই covid-19 positive. আমাদের ২৮ দিন বয়সী শিশুকন্যা জম্ম হতে nicu তে ভরতি। সবার সহযোগিতা কামনা করছি।”
একদিন সব মেঘ কেটে যাবে। একবছর, দুইবছর, তিনবছর, চারবছর। অনেক মানুষ আক্রান্ত হবেন, অনেকে সুস্থ হবেন। কেউ কেউ মারা যাবেন। পার্সেন্টেজ করে স্বাস্থ্যকর্মীদের হিসেব হবে। সব লেখা থাকবে। থাকবে না শুধু সে গল্পটা- কত ভয় কত দুশ্চিন্তা নিয়ে এ মাসগুলো এসেছিল। কতটা নিরুপায় ছিলেন তারা তাদের ডিউটিতে। উপরের স্ট্যাটাস গুলো একান্ত ব্যক্তিগত। সেখানে জীবন আছে, রাগ আছে, ভর্ৎসনা আছে, অভিমান আছে; নালিশ নেই। আজ ঢাকায় ঢুকতে ঢুকতে দু’পাশের মানুষ দেখছিলাম। ভাবছিলাম কে খুনী নয়? সরকারি ছুটি ষষ্ঠ বারের মত বাড়লো ষোলোই মে পর্যন্ত। আর কেন বাড়ানো!
শুনেছি সম্রাট নোপেলিয়নের কবর সমতল ভূমি থেকে কিছুটা নিচুতে। স্থপতিকে এর কারন জিজ্ঞেস করায়, উনি বলেছিলেন- ‘যে সম্রাটের জীবদ্দশায় তাঁর সামনে সবাইকে মাথা নিচু করে দাঁড়াতে হতো, মৃত্যুর পরও যেন তার সামনে সবাইকে মাথা নিচু রাখতে হয়- এরজন্য ভূমি থেকে নিচুতে কবর।’ এ দুর্যোগে মৃত স্বাস্থ্যকর্মীদের কবরও যেন একটু নিচু করে রাখা হয়। আমরা পর্যাপ্ত সুরক্ষা পর্যাপ্ত পরিকল্পনা ছাড়া তাদের যুদ্ধে পাঠিয়েছিলাম, আমাদের মাথা যেন হেঁটই থাকে। এ হেঁট তাদের প্রতি নয়। আপুর ছোট দুই বাবুর প্রতি, আটাশ দিনের সে এনআইসিইউ-র বেবির প্রতি, এবং অসংখ্য বৃদ্ধ মা বাবার প্রতি।
আমরা কি করতে পারতাম? কিছুই করতে পারতাম না। কিন্তু আমরা কিছু করিও নি। আমরা আধপেটা থাকি নি, ধৈর্য ধরে লাইনে দাঁড়াই নি, আকাশ দেখা বন্ধ করি নি। কোনো ফ্রন্ট থেকে কেউ সাহায্য নিয়েও আসে নি। অল্পদামে ভেন্টিলেটর মেশিন, থার্মাল স্ক্যানার, ইফেক্টিভ পিপিই-মাস্ক-সেনিটাইজার, ডিজইনফেক্টিং সিস্টেম, ট্র্যাকিং সিস্টেম- বুয়েট, রুয়েট, ঢাবি, রাবি, প্রযুক্তি- থেকে কেউ নিয়ে আসে নি।
প্রতিদিন ডিউটিতে যাওয়ার আগে শুধু দায়িত্ববোধ আর কর্তব্যই থাকে না। শঙ্কা, অভিনয়, পিছুটানও থাকে অনেক। এ নিয়ে কাব্য-গল্প-স্ট্যাটাস হয় না লোকলজ্জার ভয়ে। মাফ করবেন ভাইসাব। আমরা পারতাম- স্বামী স্ত্রী দু’জনেই ডাক্তার হলে একজনকে ডিউটি থেকে অব্যাহতি দিয়ে দিতে। আমরা সেটুকু উদার হতে পারি নি!