প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩ মে ২০২০, রবিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
এ বাসার মালিক একজন অবসরপ্রাপ্ত স্বনামধন্য শিক্ষক। তার বড় মেয়ে ঢাকা মেডিকেল, দ্বিতীয় মেয়ে ঢাকা ভার্সিটি, ছোট ছেলে বুয়েট থেকে পাশ করা। তিনি বাসার কাজ করছেন টাইলস বসাচ্ছেন বহুদিন ধরে। তার অপজিটের বাসা অঙ্কের শিক্ষকের। গতকাল থেকে ঝুলে ঝুলে রঙ হচ্ছে। দেখি আর মনেহয়- ডাক্তার, পুলিশ সাংবাদিকের রক্তে তিনি তার বাসা রাঙাচ্ছেন। এ শহরের লকডাউন এখনো উঠে নি। কিন্তু শিক্ষিত মানুষ তারা। তাদের কোনো পরোয়া নেই।
স্ট্যাটেসটিকস’এ যা আসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। আসে না ঠিক কতজন এ পরীক্ষাটি করাতে চাচ্ছেন। উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, ভয়- কোনো স্ট্যাটে কখনো আসে না। আমরা স্টেজ থ্রি বা ফোরে, যখন জানি না কার কাছ থেকে ভাইরাসটি নিচ্ছি। এ ক্ষেত্রে বাঁচার দুইটি উপায়। এক সবকিছু এভোয়েড করা, দুই খুব বেশি টেস্ট করা। যে পজিটিভ তাকে সিস্টেম থেকে আইসোলেটেড করা। আমরা আমাদের মতো আছি।
আজ অল্প কিছুক্ষণের জন্য বেরিয়েছিলাম। দেখলাম জুতার দোকান পর্যন্ত খুলে গেছে। বাজারের ব্যাগ নিয়ে লোকজন ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে। এক ক্লিনিকের সামনে কোম্পানির লোকজন ঘিরে আলাপ করছে। সবার মাস্ক থোতায় লাগানো। আজকাল টিভি দেখলে মাস্কের পজিশন দেখি। জাতীয় পর্যায়ে সবার মাস্ক থোতায় লাগানো থাকে। আগে আমরা যখন হাসপাতালে যেতাম রাস্তাঘাটে পিপিই পরা লোক দেখতাম। পিপিই পরে বাইক চালাচ্ছে, অটোতে বসে আছে। এপ্রিল মাসের প্রথম দিনগুলোতে আমরা তাদের দেখে হাসতাম। তখনো কেউ বুঝি নি যুদ্ধটা হবে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। এক মাস পর আমরা প্রায় সেখানেই আছি- একমাস আগে যেখানে ছিলাম।
রমযান মাস চলছে। এরকম রোযা কখনো দেখি নি। সকাল সন্ধ্যা সাইরেন ছাড়া কিছু নেই। আগে ইফতার খাওয়ার এক আগ্রহ থাকতো, পরিকল্পনা থাকতো, নেমন্তন্ন থাকতো। রোযা না রেখেও রমযান মাস একটি বিশেষ স্থান দখল করেছিল আমাদের জীবনে। শমরিতায় হাসপাতাল থেকে ইফতারি দিতো, বিএসএমএমইউ-য়ে আমরা নিজেরা সবাই মিলে ইফতার আনতাম, স্কয়ার সিসিইউ-র ইফতার ছিল স্পেশাল। সবাই একসাথে বসে ইফতার খেতাম। ডাক্তারি পেশায় বড় পরিবার হয় হাসপাতাল কেন্দ্রিক। এক কোভিড উনিশ কিভাবে আমাদের জীবনকে আমূল বদলে দিল। এখন কেউ কাউকে মিস করে না।
আক্রান্ত বাড়ছে, ডাবলিং টাইম কমছে, মৃতের হিসাব বোঝা যায় টিভি নিউজ দেখলে। অনেকে করোনা লাইক ফিচার নিয়ে মারা যাচ্ছেন। যাদের করোনা টেস্ট নিগেটিভ, তারা পরিসংখ্যানে আসছেন না। আমার বিবেচনায় আমরা নতুন কেসে আপওয়ার্ড ট্রাজেক্টরিতে আছি, কিন্তু এখনো পিকে যাই নি। সামনে আমাদের জন্য আরো কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
জানি না কী হবে! হয়তো বেঁচে যাব, তবে এ নিশ্চিত করে বলবো- আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করি নি। আমার বাড়িওয়ালা, তার প্রতিবেশী, জুতার দোকানদার, বাজার করা জনগন, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, কর্তৃপক্ষ- কেউই তার দায়িত্ব পালন করে নি। আমরা শুধু স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজেছিলাম। বিপদের দিনে প্রয়োজনকে কাঁটছাঁট করাই সবচেয়ে বেশি ‘প্রয়োজন’।
আজ রবীন্দ্রজয়ন্তী। এতো সাদামাটা এত কলরব হীন হয়ে এ তারিখ এর আগে কখনো আসে নি। নীরবে উনার গান শুনলাম অনেকক্ষণ। আমরা ভাগ্যবান আমরা উনার পরবর্তী প্রজন্ম। শুধু এ বিষয়টি চিন্তা করলে আমার পূর্বসূরিদের প্রতি একপ্রকার ‘করুণা’ হয়।
সবকিছু আবার স্বাভাবিক হোক, ভাল করে শ্বাস নিক পৃথিবী। এরচেয়ে বেশিকিছু এখন আর ভাবতে পারি না! সব দিবসই তাৎপর্যহীন।