প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২১ এপ্রিল ২০২০
ডা. শুভদীপ চন্দ
একটি বারো বছরের মেয়ে তিনদিন হেঁটে বাড়ি থেকে মাত্র এক ঘন্টা দূরে মারা গেল। তেলেঙ্গানা থেকে ছত্রিশগড়- ১৫০ কিলোমিটার। মূল সড়ক ছেড়ে বনবাদার দিয়ে হাঁটছিল যেন দূরত্ব কিছু কমে। ঈশ্বর ১২ বছর দিতে পারলেন, একটি ঘন্টা দিতে পারলেন না!
মৃত্যুর পর লাশ আনার জন্য এম্বুলেন্স পেয়েছে, সাথে ১ লক্ষ টাকা। কে বলে শুধু লটারি কিনেই ভাগ্য ফিরে? কখনো কখনো মরেও ভাগ্য ফিরে! মেয়েটার গাড়ি চড়ে বাড়ি ফেরার সাধ তো মিটলো! লকডাউনের দিনে কিছু টাকার নিশ্চয়তা তো মিললো!
আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম আজ হাসপাতালে যাব না৷ কাল থেকে আমাদের নতুন রোস্টার ডিউটি শুরু হচ্ছে। প্রায় ১৭০ জন ডাক্তার আক্রান্ত হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে এ এন্ডেমিক প্রজাতিকে রক্ষা করতে। আমরা এখন তিন গ্রুপে বিভক্ত। প্রতি গ্রুপ ১০ দিন টানা ডিউটি করে ১৪ দিনের আইসোলেশনে চলে যাবে সাথে ৬ দিন ছুটি। আমি প্রথম গ্রুপে নাম লেখালাম। কাল থেকে এ ডায়েরি লেখার কী হবে জানি না!
আজ সকালে উঠতেই পারছিলাম না। এর জন্য না যে আমি দেরী করে ঘুমিয়েছি বা টায়ার্ড। আসলে দুইদিন ধরে হাসপাতালে যাচ্ছি না। সে পুরনো এলার্ম সিস্টেমটাও নেই। বাসার ভিতর অফিস যাওয়ার তাড়া নেই, গাড়ি বের করার শব্দ নেই, পাশের ফ্ল্যাটের বাবুটার স্কুলে যাওয়ার সময় চিৎকার করে ‘বাই বাই’ জানানো নেই, দোকান গুলোর শাটার তোলার শব্দ নেই- কিছু নেই। সকালে ঘুম ভাঙ্গলো এম্বুলেন্সের শব্দে।
প্রথম যখন লকডাউন দিলো কতকিছু ভাবছিলাম। যেন কোনো পুরস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র! বা জেলখানার ডায়েরির মতো কিছু একটা লিখবো! হাজার হাজার প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল- কতদিন চলবে? খাবার কতটুকু স্টোর করবো? বাজারে কতদিন কিছু পাওয়া যাবে? হাসপাতালেই দিন রাত পড়ে থাকব কিনা? যদি এমন হয়- পথেঘাটে লোক মরছে কি করবো? নৈরাজ্য শুরু হয়ে যেতে পারে- কয়দিন দরজা জানালা বন্ধ করে ঘুমালাম। আর এখন প্রায়ই কারো না কারো আক্রান্তের খবর পাই। কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। কিভাবে কিভাবে জানি সব সয়ে যাচ্ছে।
প্রথম দিকে খুব খবর দেখতাম। একটু পর আপডেট নিতাম। ওয়ার্ল্ডোমিটার, ভ্যাক্সিন, ট্রিটমেন্ট, সিচুয়েশন- সার্চ দিয়ে দিয়ে পড়তাম। রাতে সুধীজনের বক্তব্য শুনতাম। ইতালি তিনহাজার ছাড়ালো, সাড়ে তিনহাজার, পাঁচ হাজার, দশ হাজার। এখন খবর দেখি না। আড়াইটা তিনটার দিকে জাস্ট একটু আপডেটটা নিই।
সময় করে বাসায় কথা বলি। ভিডিও কল দেই। হোয়াটস এপ, ম্যাসেঞ্জারকে ধন্যবাদ। কখনো কখনো মোবাইলে কার্ড খেলি। নেটফ্লিক্স ইউটিউবে সিনেমা-সিরিয়াল-গান দেখি। অনেক বন্ধুবান্ধব নক করে। গতকাল দীর্ঘ দশ বছর পর এক বন্ধু চ্যাটে জিজ্ঞেস করলো ‘খেয়েছি কিনা’! আসলে খাওয়া, ঘুম, কথা- যে মানুষের জীবনে কোনো কাজ- আমরা ভুলতেই বসেছিলাম।
এখনো আরো এক সপ্তাহ আছে অফিস আদালত খুলে দিতে। জানি না এটি আরো বাড়বে কিনা। ময়লা নেয়ার লোকটার জন্য অপেক্ষা করি। একদিন পরপর আসে। এটি এসেনশিয়াল সার্ভিস। আকাশ দেখি। ওই প্লেনগুলো ছাড়াই আকাশের ভাল চলছে। পাখির জন্য বারান্দায় পানি দিয়ে রাখি। নিচে রাজেশ্বরীরা শলা পরামর্শ করে। কখনো কখনো শুনি। ফেসবুকে ডাক্তারদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পোস্টে লাইক লাভ দেই।
এটা নিশ্চিত লকডাউনের পূর্বের পৃথিবী আর পরের পৃথিবী এক হবে না।
এদিকে একবছর পূর্ণ হতে আর মাত্র একদিন বাকি ছেলেটির। আগে বাবা মাকে পেতো না। বাবা সকালে অফিস চলে যেত, মাও চলে যেত। সে দাদু দাদীর কোলে তাদের জন্যে অপেক্ষা করতো। সন্ধ্যা সাতটায় মা আসার সময়ে অস্থির হয়ে উঠতো। একটু দেরী হলে অভিমান করতো। এ লকডাউনে তার বাবা মাকে পুরোপুরি পেয়েছে। খেলেছে, হেসেছে, হেঁটেছে। বোকা খেলনা দিয়ে কেউ তার মন ভোলানোর কথা ভাবে নি। লকডাউনও কারো কারো জন্য আশীর্বাদ হতে পারে!! তাই না?
আগামীকাল আমার ভাইয়ের ছেলেটার জন্মদিন। ওর বাপ ওর চুল ঘোড়ার মতো করে দিয়েছে!
কিছুই তো করার নেই দূর থেকে। শুধু শুভেচ্ছা জানানো ছাড়া। বড় হোক বাবুটা। আমরা তো বারো বছরের দরিদ্র মেয়েটার জন্য ‘পৃথিবী’ বানাতে পারি নি। ওরা যেন পারে!