প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৬ মে ২০২০, মঙ্গলবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
আমি তাকে চিনি যখন তাদের প্রেমের প্রথম পর্যায় চলছে। যখন মানুষ অল্পতেই অন্যজনকে ‘স্যরি’ বলে। এবং তেমন লাগে নি জেনেও বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকে ‘কিছু হয় নি তো?’ কোনোভাবেই যেন সামান্য উন্ড বেড়ে না গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়- এরজন্য প্রতিনিয়ত ড্রেসিং করতে থাকে!
তারপর একদিন তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে গেল। সে এখন গাইনী ডাক্তার। পেট কেটে বাচ্চা বের করে। ছোট এলাকায় অনেক সুনাম। মায়েরা ভরসা পায়। বাবারা বলতে থাকে ‘উপরে আল্লাহ, নিচে ডাক্তার’। সে মনে মনে ‘তওবা তওবা’ করতে থাকে।
কারন চিকিৎসা শাস্ত্রে মানুষের বাহাদুরি নেই। যেকোনো ওটি যেকোনো মুহূর্তেই খারাপ হয়ে যেতে পারে। এই যে খোদার সাথে এক নিঃশ্বাসে তার নাম নেওয়া- সে একে ভয় পায়। কোনো ভাবেই রব কে রুষ্ট করা চলবে না। অহংকার আনা যাবে না। তারপর যখন বিদায়ের সময় সবাই বলে বাচ্চার জন্য দোয়া করতে, সে হাসে। সবাই ‘সে’ হতে চাইবে, কেউ তার ভাগ্য নিতে চাইবে না।
৩২ বছর হয়ে যাচ্ছে বিয়ে হয় নি। এখন যে প্রায় অসম্ভব টের পায়। জুটলে জুটবে দুই বাচ্চার বাপ বা ডিভোর্সি। অথবা দ্বিতীয় তৃতীয় স্ত্রীর মর্যাদা। নয়তো চরম অসমী সমীকরণ। কোনোকিছুই খুব মন্দ নয়, কিন্তু কেন জানি সে মেনে নিতে পারে না।
এমনি মানুষ তাকে অনেক সম্মান করে। যে অদৃশ্য জগতের সাথে দৃশ্যমান জগতের সংযোগ করে তাকে মানুষ সম্মান করবেই। অন্ধকারতম প্রকোষ্ঠ থেকে প্রাণকে আলোয় আনতে পারেন কেবল ধাত্রী-বিদরা। ডাক্তারিতে এটি শ্রেষ্ঠ; অন্যসব ব্রাঞ্চ থেকে কয়েক ধাপ উপরে। বলা চলে একদম শুরুতে। দিন নেই রাত নেই, শীত নেই বর্ষা নেই- সে ব্যস্ত। কখন ঘরের দরজায় টোকা পড়বে, তাকে বেরোতে হবে, অনাগতকে অভ্যাগত করতে হবে। অতিথির মর্জি অতিথি কখন কড়া নাড়বেন! কেউ ৩২ সপ্তাহে, কেউ ৩৬ সপ্তাহে, কেউ ৩৮ সপ্তাহে।
সে কখনো কখনো ডর্মিটরির জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। এ শহরটার বাইরে শক্ত ভেতর নরম। যদি এমন কেউ আসতো তার জীবনে! রাফ টাফ আর টেন্ডার হার্ট। আপাতভাবে সে সংসারী। বাবার ঔষধ, মায়ের খুঁটিনাটি, তার ঘরের ধবধবে বেডশিট, চায়ের কাপ- যেখানেরটা যেখানে থাকা উচিত। সংসার সংসারের সবচেয়ে বড় সংসারীকে চেনে বৈরাগী হিসেবে।
আজ ঈদের দিন। ঈদ সর্বত্রই। হয় শপিংয়ে, নয় মহাসড়কে, নয় উদ্যানে, নয় রান্নাঘরে, নয় ক্যামেরার সামনে। নয়তো ফেসবুকে। তার ঈদ কোথাও নেই। ফেসবুক একাউন্ট ডিএক্টিভেটেড। কিছুক্ষণ পরেই পরিবার পরিজনের খুশিখুশি ছবি উপচে পড়বে। তার কিছুই নেই।
পরতে পরতে কাপড়ের নিচে যে সাদা চামড়া, তার নিচেও যে বাসনকোসন- চুলা- বইয়ের তাক- বাহারি শাড়ি- বাচ্চাদের খেলনা- বালতি- মগ আছে, কেউ দেখতে আসে না। ঈদের সকালে সে প্রতিদিনকার মতো কফি বানায়। কফি হচ্ছে ভালোবাসার মতো- যত ধৈর্য তত স্বাদ। সে একবারই ভালোবাসা পাকিয়েছিল। বিস্বাদ হয়েছে।
সে খবর খুব বেশি লোক জানে না।
যদি বলেন আমি অতকিছু জানলাম কি করে। বলবো- মেহেদি পাতার যে এত রঙ তা বাকি পৃথিবী কতটুকু জানে? সে জানে যে সমঝদার। আজ তার অনুপস্থিতিতে তাকে নিয়ে লিখে রাখলাম।
কাঁচের জার হারিকেনের শিখাকে যতই ঢেকে রাখতে চা’ক, পারে কি?