প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৮ জুন ২০২০, সোমবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
যেকোনো উচ্চ শ্রেণির প্রাণী খুব দ্রুতই বুঝে নেয় সে পৃথিবীতে একা নয়। এবং সবার সাথে তার এক লাভ লোকসানের সম্পর্ক আছে। হয় খাদ্যের, নয় খাদকের, নয় পারস্পরিক বোঝাপড়ার, নয় প্রতিযোগীর।
একটি বানর জন্মের পরই তার মাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে পারে। মানুষের বাচ্চা কিন্তু তা পারে না। তার এক মাস লাগে মাথা তুলতে। তিন মাস লাগে স্থির বস্তুকে লক্ষ্য বানাতে। চারমাস লাগে মায়ের সাপোর্টে বসতে। পাঁচ মাসে মায়ের কোলে বসতে পারে, কিছু ধরতে পারে। ছয় মাসে চেয়ারে বসা শিখে যায়। সাত মাসে কোনো সাহায্য ছাড়াই বসতে পারে। আট মাসে মায়ের সাহায্যে দাঁড়াতে পারে। নয় মাসে ফার্নিচার ধরে দাঁড়ায়। দশ মাসে হামাগুড়ি দেয়। এগারো মাসে বাবা মা-র হাত ধরে হাঁটে। বারো মাসে নিজেই কিছু ধরে দাঁড়াতে পারে। তেরো মাসে সিঁড়ি বাইতে শিখে। চৌদ্দ মাসে কোনো সাহায্য ছাড়াই দাঁড়াতে জানে। পনেরো মাসে এসে পুরোদস্তুর হাঁটে। কোনো সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াই।
আমরা সবাই এসব পরীক্ষা পাশ করে এসেছি। কেউ আগে কেউ পরে। বারডেমে আমার বড় ভাইয়ের ছেলেটার জন্ম হয়। আমি হাসপাতালে যেতাম আর এ ডেভেলপমেন্ট মাইলফলক গুলো দেখতাম। তারা দেয়ালে দেয়ালে সাঁটিয়ে রেখেছে। দুই বছরে একটি মানব শিশু তিনশো শব্দ বলতে পারবে। তিন বছরে তার প্রায় তিনগুণ। চার বছরে ১৬০০, পাঁচবছরে ২১০০। এখানে অর্থপূর্ণ শব্দের কথা বলা হচ্ছে না। শিম্পাঞ্জিকে বহু চেষ্টা করে তিন চার শব্দ শেখানো যায়। যদিও তার স্বরযন্ত্রে সমস্যা নেই। স্বরযন্ত্র সুগঠিত, অনেককিছু বলার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু তার মস্তিষ্ক কমজোরি।
অর্থাৎ বিবর্তনবাদ মতে আমরা যে মানুষ তা প্রকৃতির খামখেয়ালে নয়, অনেক ভেবেচিন্তে পরিকল্পনা করে আমরা মানুষ। আমরা কথা বলতে পারি, ভাবতে পারি। এখন যে ঘটনাটি ঘটলো তা হয়তো এখনি ঘটেছে এবং ভয়াবহ রকমের তুচ্ছ, কিন্তু তার জন্য পৃথিবী লক্ষ-কোটি বছর অপেক্ষা করেছে। সামান্য হেরফেরে সে যোজন যোজন দূর চলে যেত পারতো।
তাই সকালের গল্পটা এক, গল্প বদলাতে থাকে দুপুর গড়ানোর সাথে সাথে। সন্ধ্যার পর যে যার নিজের ঘাটের যাত্রী। একি স্কুল, একি পরিচয়; অথচ কার যে কোথায় শেষ- কে তা জানে।
লিখতে বসেছিলাম ক্ষুধার্ত মৃত হাতিটিকে নিয়ে। ফেসবুকে আরো কিছু ছবি। মানুষের মানসিকতা প্রাণী পরিচয় থেকে তাকে আলাদা করে রেখেছে। আমরা সে দেয়াল ভেঙ্গে দিচ্ছি! আমরা এখন শুধুই ‘প্রাণী’ হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সময়টা এমন আপনি যেখান থেকেই শুরু করুন কোভিড উনিশের দুঃখ নিয়ে শেষ করতে হয়। চলে গেলেন স্কয়ার হসপিটালের মির্জা নাজিমুদ্দিন স্যার। সবসময় ম্যাচিং কালো কোট টাই জুতা পরতেন, আর পরতেন ট্রেডমার্ক হাসি। কর্মচঞ্চল এক লোক এতো দ্রুত চলে যাবেন ভাবি নি। যে আইসিইউ তিনি সামলেছিলেন এতোগুলা বছর, সে আইসিইউ থেকে আর নিজের ইচ্ছায় বের হতে পারলেন না। ওই কেবিনে তিনি কতবার রোগী দেখেছেন- কখনো কী ভেবেছিলেন এই তার মৃত্যুস্থান? এই বেডেই তার জীবনের শেষ কটা দিন পার করতে হবে? বয়স আর কত?
আমরা নীরবে প্রত্যেক বছর আমাদের মৃত্যুদিনটি পার করছি! মৃত্যুস্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি! না জানার অনেক সুবিধা। না ভাবার অনেক আনন্দ।