প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৪ আগস্ট ২০২০, মঙ্গলবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
আমি বসে আছি হাসপাতালে। চোখ রেখেছি করিডোরে। স্বাস্থ্যবিধি দেখছি। লোকজন আসছে, যাচ্ছে। কারো নাকে মুখে মাস্ক নেই। মহিলারা নাকা বেঁধে মাস্কের কাজ চালাচ্ছেন। কেউ কেউ শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক মুখ চেপে রাখছেন। একহাতে লুঙ্গি উঁচু করে ঢুকলেন এক ভাই- তার মুখেও মাস্ক নেই। স্টাফ একজন একটু পরপর মাস্ক নামিয়ে শ্বাস নিচ্ছে। বেশিরভাগ স্টাফের মুখে গণস্বাস্থ্যের দেয়া ওয়ান টাইম মাস্ক। ছেঁড়ার আগ পর্যন্ত কত টাইম হয় কেউ বলতে পারে না।
একজন আসলেন সত্যায়িত করার জন্য। বললেন- ভুলে মাস্ক বাসায় ফেলে এসেছেন। এ ভুলটা এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ষষ্ঠ জনের পেলাম। এক্স-রে থেকে একজনকে ঘুরিয়ে পাঠিয়েছে। সে লোক অন্য একজনের কাছ থেকে মাস্ক ধারে নিয়ে আবার গেলো। সম্ভবত তারা সবাই শেয়ারে এক মাস্ক ব্যবহার করেন।
বাসে, ট্রাকে, লঞ্চে, গরুর হাট বা বাজারে- কোথাও স্বাস্থ্যবিধি নেই। সবাই সম্মিলিত ভাবে বিধি নিষেধ ভাঙছেন। ঈদের আগের দিন দেখেছিলাম পুরো মহাসড়ক জুড়ে গাড়ির লাইন। বাস ট্রাক পিকআপ। খোলা ট্রাকেই কেউ বমি করছে, কেউ অধৈর্য হয়ে শুয়ে পড়েছে। সীমাহীন কষ্ট আর অসীম স্বপ্ন। কেউ কেউ বেশি সতর্ক। পিপিই, ফেসশিল্ড, গগোলস, গ্লাভস পরে গরুর হাটে গেছে। ঘুরতে ঘুরতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড রোদে ধুলায় ও তৃষ্ণায়। তারপর সবাই তাকে ধরাধরি করে উদ্ধার করেছে। সংস্পর্শ পরিহার আর রইলো কোথায়?
কর্তৃপক্ষ বারবার বলছে সংক্রমণ কমিয়ে আনা গেছে। পরীক্ষা কম হলে সংক্রান্ত কমে যাবে- এ সহজ হিসেব উনারা কেন বুঝেন না। আজও শতাংশের হিসেবে বিশের উপরে। এখানেও যথেষ্ট ফাঁকি আছে। অনেকে দ্বিতীয়বার টেস্ট করছেন নিগেটিভ রেজাল্টের আশায়। স্কয়ারের মতো হাসপাতালগুলো অর্থোপেডিক্স অপারেশনের জন্যও কোভিড টেস্ট বাধ্যতামূলক করেছে। ফলে যারা ওসব হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন বিনা কারনে করোনা পরীক্ষা করে নিগেটিভ হচ্ছেন। অনেকে চাকরির পরীক্ষার জন্য করোনা টেস্ট করে নিগেটিভ সার্টিফিকেট শো করছেন। কেউ বিদেশ যাচ্ছেন। অর্থাৎ নিগেটিভ রিপোর্ট বহু কারনে বাড়ছে। তাদের হয়তো কোনো সিম্পটমই নেই।
দেশের প্রত্যন্ত এলাকার লোকেরা দিনের দিন টেস্ট করাতে পারছেন না। সপ্তাহে দুই দিন নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। প্রত্যেক জেলায় ল্যাব নেই। গ্রামাঞ্চলে এখনো কোভিডকে কলঙ্ক হিসেবে দেখা হয়। পরীক্ষার জন্য স্যাম্পল দিতে চান না অনেকেই। করোনা পরীক্ষা করতে হবে বললে ভয়ে পালিয়ে যান। অনেকে মিথ্যা নাম্বার দেন। পজিটিভ আসলে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
রাস্তায় রাস্তায় বেসিন আর কালিতে আঁকা বৃত্ত বা চতুর্ভুজ যুদ্ধের সাক্ষী দেয়। এ ঠিক যে পরিমাণ ভয়াবহতা আশা করা হচ্ছিলো তেমনটি হয় নি। কারন না জানার আশীর্বাদ অনেক। অথবা কোনো এক গোপন ইমিইউনিটি আমাদের বাঁচিয়ে দিচ্ছে। এখন সব ঝড় যাচ্ছে অর্থনীতির উপর দিয়ে। বন্যায় ডুবে গেছে এ জেলার অনেক রাস্তাঘাট। রাস্তার উপরে চকি বালিশ তোশক নিয়ে উঠেছেন দেখলাম কেউ কেউ। এক দুইজনকে ঘুমাতেও দেখেছি। ঘুম লাখ টাকার খাটের উপর নির্ভর করে না। ঘুম থাকে মাথার ভেতর।
ঈদের রোস্টার ডিউটি শেষ হলো। এবার অনেক রোগীকে হাসপাতালে ঈদ করতে দেখলাম। প্রায় সবাই মারামারির রোগী। এদিকে এক বিশ্বাস আছে হাসপাতালে ভর্তি থাকলে মামলা পোক্ত হয়। মারামারি করে এসে রোগীরা জোর করে হাসপাতালে ভর্তি থাকে। ঈদ যায় যাক, মামলা যেন না যায়!
আমাদের হাসপাতালে এক করোনা রোগী ভর্তি আছে। উনি কেন ভর্তি হয়ে আছেন বুঝতে পারি না। উনার কোনো সিম্পটম নেই। এমনিই শুয়ে থাকেন। সিস্টার বা অন্য স্টাফরা দূরত্ব বজায় রেখে অস্থির। উনার লোকেরাও উনাকে জানালা দিয়ে খাবার সাপ্লাই দেয়। অথচ তার বাইরে কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। পরোয়াও করছেন না। বাঙালির বল সব দুর্বলের উপর। সে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল হোক বা সামাজিক ভাবে বা শারীরিক ভাবে।
কোভিড নিয়ে এখন কেউ লিখেনও না। ফেসবুক আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে। জোছনা-গল্প-কবিতায় ভরে উঠেছে। একটি মহামারীর সাক্ষী আমাদের এ প্রজন্ম- মানুষের অভিযোজন ক্ষমতার উপর ভক্তি শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দিয়েছে।
পুরো করোনার সময় নিরলস কাজ করে ভদ্রলোক বাসার কাজ শেষ করলেন। রাজেশ্বরীদের নিচ তালা। করোনা কারো কারো জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। তিনি এমন একজন। আজ গৃহ প্রবেশের পূজা দিলেন। আমাকে ডাকেন নি। বন্ধ দরজার পাশে দুই কলাগাছ, দুই কলসি, কলসি ভর্তি ফুল বেলপাতা তুলসিপাতা দূর্বা দেখলাম। কোনো বাসাই যাদুঘর হওয়ার জন্য তৈরি হয় না। অসংখ্য গল্প তৈরির ছাপাখানা হওয়ার জন্য তৈরি হয়।
গত বছর মাইকেল মধুসূদনের বাড়ি গেছিলাম, তার আগের বছর কুষ্টিয়ার রবীন্দ্রনাথের বাড়ি। তারও আগে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি। এ বছর কলকাতার জোড়াসাঁকো যাওয়ার প্ল্যান ছিল। করোনার জন্য যাওয়া হয় নি। এ বাড়িগুলো দেখে আমার ভাল লাগে নি। মনে হচ্ছিলো কেউ না থাকার এক কান্না যেন ট্র্যাপড হয়ে আছে। দেয়ালগুলো যেন চায় বিখ্যাত হোক বা অবিখ্যাত- কেউ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিক।
আমি ভাড়াটিয়া। আর কদিন। আজ আছি কাল নেই। চলে গেলে কেউ মনেও রাখবে না। যতই বিরক্ত হই শব্দদূষণ ও করোনা সময়ে তাদের স্বার্থপরতায়, চোখের সামনে তৈরি হওয়া এ বাসায় সবসময় ভালোবাসা ঘিরে থাকুক এ প্রত্যাশা রাখি। এমনকি যখন আমরা কেউ থাকবো না- তখনও।