প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৭ অক্টোবর ২০২০, মঙ্গলবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
গতকাল গিয়েছিলাম মধুটিলা চার- পাঁচ জন কলিগ মিলে। জামালপুর শেরপুর ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে ব্রহ্মপুত্রকে দেখছিলাম। চর পড়ে গেছে নদীতে। সে চরে আটকে আছে সামান্য পানি। বিন্দুমাত্র স্রোত নেই। নদী যেন চরের সাথে সমঝোতা করে বেঁচে থাকছে! এ ব্রহ্মপুত্র নদ আমাদের প্রতিচ্ছবি। কোথাও ঢেউ নেই। অদ্ভুত জড়তা। এখানে প্রিয় ডিফেন্স ‘কোনোদিন করিনি’। চিকিৎসা দিবেন, আগে ভাবতে হয় পুরোটা শেষ করতে পারবেন তো। সিস্টার এসে বলবে ‘স্যার আমরা কখনো করি নি’। তারপর ধরুন দুর্গাপূজা। পশ্চিমবঙ্গে কী চমৎকার থিমে মণ্ডপ হয়। আমাদের এখানে প্রতিবছর বাজেট বাড়ে, গান বাজনা বাড়ে, লাইটিং বাড়ে, কিন্তু বক্তব্য সে একই- পুরনো। নতুন কিছু নেই। এক দুইজন ভাবলে তা সহজে গ্রহণ হয় না। বান্দরবন পাহাড়ে বেশ কিছুদিন ছিলাম। পাহাড়ের নিস্তব্ধতা, নিস্তরঙ্গ জীবন আমার কাছে নতুন নয়। আকাশপানে যে ভূপৃষ্ঠ উঠে তার সখ্যতা সবচেয়ে বেশি হয় সূর্যের সাথে। সেজন্য পাহাড় রাতের অন্ধকার শোষণ করে। পাহাড়ী রাত নদী বা সমতল রাতের চেয়ে বেশি ঘন। একটানা ঝিঁ ঝিঁ ডাক, নদীর প্রবাহমান শব্দ অনেকরাত পর্যন্ত শুনেছি। পাহাড়ের বাঁক ঘেষে আবার পাহাড়। পাহাড়ের গল্পে এতো ট্যুইস্ট যে সেখানকার জীবনে কোনো ট্যুইস্ট নেই। ট্যুইস্ট বিহীন জীবনের গল্প জড় গল্প। ঠিক ‘গল্প’ হয়ে ওঠে না।
আজকাল বিয়ে নিয়ে অনেক কথা শোনা হয়। একইসাথে দুইজনের প্রতি অন্যায় এরেঞ্জ ম্যারেজ ছাড়া আর কিছুতে নেই। যে সংসারে অভিযোগ থাকে সেখানেও কিছু সমতা থাকে। যেখানে অভিযোগ নেই অথচ দুইজন দুই মেজাজের সেখানে কষ্ট আরও বেশি। মানুষের মনে অনেকগুলো হাত আছে। কোন হাতের আঙ্গুল সঙ্গী পাচ্ছে না সেটা সে ছাড়া কেউ জানে না। না পারে সে কথাগুলো কাউকে বোঝাতে, না পারে মুখ ফুটে কাউকে বলতে। আমাদের সমাজে পাশাপাশি থাকতে পারলে, খাওয়া পড়ার অভাব না থাকলে, এক দুই বাবু হলেই “যথেষ্ট” ধরে নেয়া হয়। আপনি কাউকে বলতে পারবেন না আপনার কারণে অকারণে ঘুরতে মন চায়, নতুন কোনো গ্যাজেট কিনে সেটা নিয়ে সারাদিন পরে থাকতে ইচ্ছে করে, সপ্তাহে একদিন মুভি দেখতে ভাল লাগে। লোকে হাসবে এমন কথা শোনে। যে রোগ বইয়ে নেই সে রোগের চিকিৎসাও নেই। কিন্তু রোগ তো আছে!
দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির প্রাণী পাশাপাশি থাকলে তর্ক বিতর্ক হয় না। সে দুই মুখের ভাষা সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে। অথচ বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই দুইজন ভিতরে কতবার মরেছে। বিয়ের আগে একজন আরেকজনকে চেনার সুযোগটুকু তো দিতে হবে। কারো সাথে সারাজীবন একা থাকার চেয়ে অনেক ভাল নিজের সাথে একা থাকা। অবশ্য স্বস্তির কথা বেশিরভাগ মানুষ বুঝে নিয়েছে সংসার নিজের জন্য ছোট জায়গা। এক জন্মে এর কাছে কেউ বেশিকিছু আশা করে না। দাবিও করে না।
তবুও সতর্কতার মার নেই। ঈশ্বর ভুল করবেন না। কাউকে একা পাঠাবেন না। জোড়া সত্ত্বাটি আছে কাছেপিঠে কোথাও। কাছাকাছি ধরণের মানুষও আছে। এ সমাজ এমন ঘন বন যে একবার বিভ্রান্ত হলে আর পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। ঝড়ে উড়ে যাওয়ার চেয়ে ভুল গাছ আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার নামই ‘জ্ঞান’! বড্ড তাড়াহুড়ো সবকিছুতেই। আর বড্ড লোক দেখানো। একটু ভিন্নই এখানে ‘অস্বাভাবিক’। নিজের হাঁটাটিই কেউ হাঁটতে পারে না।