প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, শনিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
মানব শিশু যখন জন্ম নেয়, জন্মাতে জন্মাতে সে নিজের মায়ের আর্তচিৎকার শোনে। বাংলাদেশ নামক দেশটিও যন্ত্রণাকাতর চিৎকার শুনে শুনে জন্ম নিয়েছে। তবে সবচেয়ে করুণ আর্তনাদ ছিল পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট। অপ্রত্যাশিতভাবে জন্মের অনেক পরে।
শেখ মুজিব- বাঙ্গালির সবচেয়ে বড় আবেগের জায়গা। যেখানে বেগ নেই শুধুই আবেগ, সেখানে সবচেয়ে বেশি শ্যাওলা জন্মে। ভয় হয় কবে জানি প্রবাহই বন্ধ হয়ে যায়! ক্ষমতার রদবদলে যে কত ছাত্রনেতা দেখলাম বোল পাল্টে মুজিবসেনা হয়ে গেলো। পরিচিতের ডিগবাজিতে চোখবুজে থাকা এক বিশেষ গুণ। আমরা সবাই প্রাকৃতিক ভাবে সে গুণে গুণী! কখনো কখনো খুব খারাপ লাগে ওই মানুষটির জন্য। শুধু মিথ্যেও ভাল, শুধু সত্য ভাল; কিন্তু সত্যমিথ্যার মিশেল যে ভয়ঙ্কর।
করোনার ভ্যাক্সিনের কেন প্রয়োজন হবে না বললেন বুঝি নি। ভ্যাক্সিন তো তাকেই দেওয়া হয় যে ভবিষ্যতে ঝুঁকিতে আছে। সরকারি হিসেবে এদেশে আক্রান্ত সংখ্যা মোট জনসংখ্যার অনেক কম। তবে তো ভ্যাক্সিনের গুরুত্ব আরো বেশি থাকার কথা।
সরকারি হাসপাতালে যে টেস্ট করতে ২০০ টাকা লাগে, বেসরকারি হাসপাতালে লাগছে ৪৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা। বাসের ভাড়া বাড়লো- আবার লোকও তুলছে ঠেসেঠুসে। এদেশে কেউ কী কিছু দেখে না? মাঝেমাঝে অবাক হই।
এন্টিভাইরাল ঔষধ গুলোর দাম অনেক। অনেকগুলো ট্যাবলেট লাগে। প্রতি ট্যাবলেট ১৭০ থেকে ২০০ টাকা। সাপ্লাই নেই। তবে হয়তো একদিন এ ট্যাবলেট গুলোও সরকারি হাসপাতালে ফ্রি হয়ে যাবে। তখন বুঝতে হবে ঘড়িতে প্রয়োজনের কাঁটা ঘুরে গেছে। টেস্ট করা নিয়ে যেমন অনেক অসন্তোষ আছে, রিপোর্ট দেয়া নিয়েও আছে অসন্তোষ। কোথাও কোথাও শুধু ‘পজিটিভ’ জানানো হয়, কোথাও তাও হয় না। অবিশ্বাস্য লাগে পাঁচমাস আগে আমি যে প্রথম স্যাম্পল দিয়েছিলাম- তার রিপোর্ট এখনো পাই নি। লোকমুখে শুনেছি ‘যেহেতু ফোন আসে নি তাই নিগেটিভ’। মোবাইলে বাজানো রেকর্ড প্রতিবার ফোন কলের আগে বাজতে পারে, আটআনা খরচ করে রিপোর্টের একটি এসএমএস দিতে পারে না! আবার কোনো নাম্বারও দেয় না। যে ফোন করে রিপোর্ট জানা যাবে।
এ সংসারে অনেক গুণ আছে। গুণ মানে স্পেশাল কোয়ালিটি। সত্য বলা, চুরি না করা, প্রতিবেশীকে ভালোবাসা, দান করা, গাইতে পারা, গুছিয়ে লিখতে জানা- সব বড়বড় গুণ। তবে সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে ‘দেখেও না দেখা’। হচ্ছে, হোক, হবে। অহেতুক তাকিয়ে লাভটা কী! নিজের বাকসো গুছিয়ে নেয়াই উত্তম।
তারা ক’জন একসাথে অফিস যান। সবাই সরকারি কর্মকর্তা। একজন স্যাম্পল দিয়েছেন। হয়তো জ্বর ছিল, গলাব্যথা ছিল, বা কনটাক্ট হিস্ট্রি ছিল। টেস্ট করতে যে দিয়েছেন- সম্পূর্ণ গোপন করে গেলেন। গায়ের সাথে গা লাগিয়ে এসি গাড়িতে বসেছেন। রাস্তায় টুকটাক আলাপচারিতা করেছেন। এখন পজিটিভ আসার পর ফোনে ফোনে বলছেন ‘সাবধানে থাকুন’! অনেক ডাক্তারও তাই। কাকে আর দোষ দিব। আমাদের ক্লাস থ্রি থেকে টেন পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষা পড়ানো হয়। আর এই হচ্ছে নীতি ও নৈতিকতার অবস্থা..।
…
আমি কথিত কোয়ারেন্টাইনে আছি। পনেরো দিন ডিউটি, পনেরো দিন কোয়ারেন্টাইন। আবাসন নেই, খাওয়ার ব্যবস্থা নেই, যাতায়াতের বাহন নেই- কেন যে এ কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা করে রেখেছে বুঝি না। এখন পনেরোদিন বাসা থেকে হাসপাতালে গিয়ে ডিউটি করি, আর বাকি পনেরো দিন এমনি এমনি বাসায় বসে থাকি। পনেরো দিন তো আরাম পাচ্ছি- অহেতুক কথা বলে লাভ কী! কেউ বলে না, আমিও বলি না। যথেষ্ট অন্ধ, যথেষ্ট বধির ও যথেষ্ট বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী না হলে এদেশে উপরে উঠা যায় না। এগুলো চর্চার ব্যাপার। চর্চা করি।
বাসার জানালা ধরে বৃষ্টি হয়, বৃষ্টি দেখি। এখনকার বৃষ্টিতে কোনো সাড়াশব্দ নেই। নীরবে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ে। এ কয়দিনে আকাশ পড়তে শিখে গেছি। মেঘ, হালকা ঠান্ডা বাতাস দেখে অনুমান করতে পারি- বৃষ্টি হবে, কতক্ষণ হবে। মাঝেমাঝে রাজেশ্বরীরা আসে গল্প নিয়ে। সমস্যা হচ্ছে রাজেশ্বরী এতো আস্তে কথা বলে ওর কথা শোনা যায় না। শুধু ওপাশ থেকে দোলার কথা শোনা যায়। এ দুই ছোট মানুষের পেটে এতো কথা কিভাবে জমে- অবাক হই। একদিন তারা বড় হবে। কে যে কোথায় হারাবে- নিজেরাই নিজেদের খুঁজে পাবে না। রাজেশ্বরীদের নিজস্ব বাসা, দোলারা ভাড়াটে। আমরাও ভাড়াটে ছিলাম। বাবার ছিল বদলির চাকরি। আমার ছোটবেলা আমি ভুলে গিয়েছি সে কবেই। অস্পষ্ট শুধু নামগুলো মনে আছে, অস্পষ্ট ভাবে চেহারা। দেখলে কাউকে চিনতে পারব না। আমার বন্ধুভাগ্য যেমন ঈর্ষনীয় তেমনি শোচনীয়। কারো কারো ভালোবাসা আকাশ ছুঁয়েছে কারো আকাশ ছুঁয়েছে বিশ্বাসভঙ্গতা। তারা ঠকিয়ে ‘জীবন’ শিখিয়ে গেছে।
ভাবি না এসব। ফুলই দেবতার পায়ে পড়বে, কাঁটা সে যতই ফুলকে সুরক্ষা দিক দেবাসনে প্রবেশাধিকার নেই।