জার্মানির স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাঃ আমাদের জন্য কেন শিক্ষণীয়??
বুয়েটের আর্কিটেক্ট এক সিনিয়র ভাই জার্মানিতে মাস্টার্স করতে এসেই জটিল রোগে আক্রান্ত হলেন। খাদ্যদ্রব্য পরিপাক শেষে ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে বৃহদান্ত্রে যাবার নালীপথটা ক্রমশ সরু হয়ে আসছে। জার্মান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সাফ জানিয়ে দিলেন, অবিলম্বে অপারেশন না করালে নিশ্চিত মৃত্যু।
হঠাৎ মৃত্যুভয়ে মুষড়ে পড়লেন উনি। নতুন এই দেশে এসে মাসে ৬০ ইউরো হিসেবে ৪ মাসে মাত্র ২৪০ ইউরো স্বাস্থ্যবীমার প্রিমিয়াম দিয়েছেন। অপারেশনের বিকল্প কোন ব্যবস্থার সন্ধান করতে লাগলেন ওনার চিকিৎসক সহধর্মিণী, কিন্তু নিরাশ হলেন।
এরপর অত্যন্ত জটিল এক অপারেশন শেষে ৮ দিন হাসপাতালে থেকে ফেরার সময় উনি আগ্রহভরে জানতে চাওয়ায় চিকিৎসক জানালেন, সব মিলিয়ে প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ লক্ষ টাকার মতো খরচ হয়েছে।
উল্লেখ্য, এর একটা টাকাও ওনাকে নিজের পকেট থেকে দিতে হয়নি। খুলতে হয়নি কোন ফেসবুক ইভেন্ট বা টাকা চাইতে হয়নি কারো কাছে বিকাশ একাউন্ট খুলেও। তাহলে কে বহন করলো এই বিশাল খরচ?
গাড়ি আর নিত্যনতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ছাড়াও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সফলতায় জার্মানিকে বলা হয় ‘মডেল দেশ’। এখানে ছাত্র-অছাত্র, ধনী-গরীব, দেশী-বিদেশী, সবার জন্য স্বাস্থ্যবীমা বাধ্যতামূলক। যার আয় কম তার ট্যাক্স ও অন্যান্য বীমার প্রিমিয়ামও কম, যার আয় বেশি তার ট্যাক্সসহ সবই বেশি (আয়কর বাড়ে ১৪ থেকে ৪২% হার পর্যন্ত)। বেকার, কর্মক্ষম বা রিফিউজি যারা, তাদের পুরো পরিবারের খরচ বহন করে সরকার, অর্থাৎ কর্মজীবীদের কষ্টার্জিত আয়ের ট্যাক্সের টাকা থেকে। মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আজকের এই আধুনিক জার্মানি।
ট্যাক্স এর সাথে সাথে স্বাস্থ্য, পেনশন, বেকারত্ব ও বার্ধক্যজনিত বীমার খরচগুলো মূল বেতন থেকে আগেই কেটে রেখে প্রায় অর্ধেক বেতন হাতে দেওয়া হয়। সরকারি বা বেসরকারি স্বাস্থ্যবীমা কোম্পানীর মাধ্যমে সবাই প্রতিমাসে বিপুল পরিমান প্রিমিয়াম দেয়। কেউ অসুস্থ হউক বা না হউক।
স্বাস্থ্যবীমার এই অদৃশ্য দেয়াল থাকায় এখানে চিকিৎসক-রোগীর মাঝে নেই কোন টাকা-পয়সা লেনদেনের সম্পর্ক। বাজেট ভর্তুকি আর সার্বিক মনিটরিং এ ‘লাঠিয়াল’ এর ভুমিকায় থাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ফলে নেই কোন দালালি বা কমিশন বাণিজ্য।
রোগী স্বাস্থ্যবীমার কার্ডটা নিয়ে যায় চিকিৎসকের কাছে বা ক্লিনিকে, জরুরী হলে যায় হাসপাতালের জরুরী বিভাগে। রোগী দেখে চিকিৎসক নেয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বা জটিল কেসে পাঠায় বিশেষজ্ঞের কাছে। এরপর খরচসহ তাদের সব টেস্ট-রিপোর্ট তারা নিজেরাই পাঠিয়ে দেয় রোগীর স্বাস্থ্যবীমা কোম্পানির কাছে। আর এখানেই আসে জবাবদিহিতার প্রশ্ন। বীমা কোম্পানী সেই ডকুমেন্টগুলো বিশেষজ্ঞ প্যানেল দিয়ে ভেরিফাই করে ডাক্তার-ক্লিনিকের ফি‘সহ সব খরচ মেটায়। বীমা কোম্পানিগুলো নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্যই কঠোর মান-নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে।
জবাবদিহিতার কারনেই এখানে চিকিৎসকের অনুমতিপত্র ছাড়া কোন ফার্মেসি মুড়ি-মুড়কির মতো এন্টিবায়োটিক বিক্রি করে না, প্রসব ব্যাথায় ‘বিনা প্রয়োজনে’ সিজারিয়ান সেকশন করে না কোন ক্লিনিক, সি-সেকশনের আব্দার করে কেউ যদি বলে ‘টাকা-শরীর দুটাই আমার, সিদ্ধান্তও আমার’, তবে সে ভুল দেশে এসে পড়েছে। অপারেশন শুরুর আগেই এর ভালো-মন্দ পূর্ণাঙ্গভাবে রোগীকে না বলা এখানে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এদেশে শুধু ডাক্তার কেন, যে কোন মানুষের গায়ে হাত তোলা, কটূক্তি বা হুমকি দিলে নগদে জেল-জরিমানা। কে চ্যান্সেলার আঙ্গেলা ম্যার্কেলকে ‘আপা’ ডাকে, আর কে ‘ম্যাডাম’ ডাকে, তা দেখার সময় নেই, বরং তাতে হিতে বিপরীতই হবে। আইনের প্রয়োগ এখানে এতোটাই কঠোর!!
আমেরিকার মতো ‘হাইটেক‘ দেশেও শুনেছি মানুষ অসুস্থ হলে শুধুমাত্র খরচের ভয়ে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে পড়ে পড়ে মরে। রোগীর টাকার সংস্থান না হলে বা ব্যাংক লোনের নিশ্চয়তা না থাকলে সেখানকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা নাকি এক পা ও নড়েন না।
আর আমাদের জন্ম সেই দেশে যেদেশে এখনো বাচ্চার ডায়রিয়া হলে মসজিদের বড় হুজুরের পড়া পানিই একমাত্র ভরসা, জরুরী নিরাপদ মাতৃত্ব যেখানে ডুকরে কাঁদে। জবাবদিহিতার অভাবেই এখনো যেখানে অষ্টম শ্রেণী পাশ কেউ নিউরো-মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সেজে রোগী দেখতে থাকে দিনের পর দিন, বিজ্ঞান না পড়েও হয় অজ্ঞানবিদ, ICU তে তিন দিন আগেই মৃত কাউকে অনায়াসে জীবিত বলে অনর্থক বিল বাড়ায় অসাধু ক্লিনিক ব্যবসায়িরা।
যদিও গ্রামীণ কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো সেবা চালু হওয়ায় তৃণমূল পর্যায়ে বাংলাদেশ অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত, কিন্তু জটিল রোগ-ব্যাধিতে?
বাংলাদেশের মোট ৬ কোটি শ্রমশক্তির মধ্যে সরকারকে আয়কর দেওয়া মাত্র ২৮ লাখ ‘দেশপ্রেমিক’ যদি মাসে পরিবার প্রতি ১০০ টাকা করেও স্বাস্থ্যবীমার প্রিমিয়াম দেয়, তাহলে প্রতিমাসে জমা হয় ২৮ কোটি টাকা। আর ১ কোটি পরিবার ১০০ টাকা করে দিলে হয় ১০০ কোটি টাকা। সবার চিকিৎসা খরচ মিটিয়ে এই টাকা দিয়ে কতগুলো নতুন বেডের হাসপাতাল বানানো যাবে বা নতুন চিকিৎসা উপকরণ কেনা যাবে, জানি না। কিন্তু ক্যান্সার, ব্রেন টিউমার বা অত্যন্ত জটিল রোগে আক্রান্ত অন্তত ১০০ জন রোগীকে হয়তো প্রতিমাসে বাঁচানো সম্ভব হবে।
আর যারা হরিণের মতো পেটে একটু ভুটভাট হলেই ভয়ে আজ ইন্দোর কাল ভেলোর পর্যন্ত ছুটে যায়, সেই উচ্চবিত্ত ধনীক শ্রেণি ‘শুধুমাত্র দেশেই চিকিৎসা করাতে হবে’ এবং ‘আয় অনুযায়ী হারে’ প্রিমিয়াম দেয়ার শর্তেই স্বাস্থ্যবীমা কোম্পানির সদস্যপদ পেতে পারে।
একটা জাতির উন্নতির মহাসড়কে মোমবাতি ধরবে ডাক্তার আর শিক্ষক জ্বালাবে আলো। কিন্তু আজ আমাদের দেশে এই দুই মহান পেশার লোকজনই পড়ে পড়ে মার খায়। খুবই আফসোস আর লজ্জার কথা।
আপনার বা আপনার পরিবারের কারো জটিল রোগে বা অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদে সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র যখন বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে, তখনই শুধু আপনি বুঝবেন যে দেশ উন্নত ও সভ্য হওয়ার পথে। তাছাড়া ‘উচ্চ-নিম্ন মধ্যম আয়ের‘ জিডিপির ওই ওঠানামাটা শুধুই একটা সংখ্যা মাত্র।
খাজা রহমান
রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার, লাইপজিগ, জার্মানি।
Nirmom shotyo!