লেখক : যায়নুদ্দিন সানী
পরিস্থিতি বেশ মজার হয়ে উঠছে। বিষয় বাংলা পরীক্ষার প্রশ্ন। সেখানে লেখা হয়েছে ‘লোভী ডাক্তার’। শুধু তা ই না, তিনি ইতিমধ্যেই বেশ অর্থ উপার্জন করেছেন, গাড়ী, বাড়ী করে ফেলেছেন। তবে সেটা সৎ না অসৎ পথে তা উল্লেখ না করে প্রশ্নকর্তা বেশ উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। তবে যা বলা হয়েছে, তা হচ্ছে, লোভের কারণে, তিনি অর্থ উপার্জন অব্যাহত রেখেছেন এবং এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে তাঁর ‘লোভ’কে। লেখাটি বেশ সংক্ষিপ্ত হওয়ায় অনেক কিছুই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তার একটি হচ্ছে, উপার্জন কিভাবে করছেন। একজন চিকিৎসকের বৈধভাবে আয়ের দুটিই উপায়, শিক্ষকতা আর পেশাগত আয়। এখানে সম্ভবতঃ দ্বিতীয় পদ্ধতির দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছে। এর পরের লাইনটি হচ্ছে, ‘তাঁর চাওয়া পাওয়ার শেষ নাই। অর্থ উপার্জনই তাঁর একমাত্র নেশা।’ চিকিৎসক সমাজ ধরেই নিয়েছে, এটি প্রতিটি ডাক্তারের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে।
ব্যাস, যথারীতি চিকিৎসক সমাজ ক্ষেপে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে সুশীলীয় প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, ‘মানব বন্ধন’। সেটা হয়ে গেছে। এরপরে আর কি কি হবে, এই মুহূর্তে ব্যাপারটা ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারছি না। সভা, সেমিনার করার সমস্যা আছে। কে বলবে, কতক্ষণ বলবে এনিয়ে বিস্তর রশি টানাটানি হয়। তার ওপর তো আছে দলবাজি। শুধু দলবাজি হলেও তো রক্ষা ছিল, সঙ্গে আছে গ্রুপবাজি। সো, মনে হয়না কাহিনী ঐ লাইনে এগোবে। যা হওয়ার তা সম্ভবতঃ বাঙ্গালির সাম্প্রতিক বিনোদন, ‘ফেসবুকে’ই হবে।
নিউজফিডে আসা জ্বালাময়ী সব স্ট্যাটাস দেখছিলাম। সবার সংগ্রহেই বেশ ভুরি ভুরি উদাহরণ। কোন ডাক্তার কবে কিভাবে মানবতা দেখিয়েছিলেন। কেউ কেউ এই ফাঁকে নিজের কিছু বিজ্ঞাপন সেরে ফেলছেন, ‘আজকে একজন রুগীকে চিকিৎসা দেয়ার লোভ সামলাতে পারি নাই’। মন্দ না। এদিকে সেদিকে আরও কিছু ঝগড়া দেখলাম। একজন দেখলাম রীট করবার চিন্তা ভাবনা শুরু করেছেন। সম্ভবতঃ চাঁদা প্রক্রিয়া শুরুও হয়ে গেছে। ডাক্তার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত বহুল প্রচলিত বিশেষণ, ‘কসাই’ পুনরায় ফেরত এসেছে। এই লাইনেও চলছে কথার ফুলঝুরি। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ মজাদার হয়ে উঠেছে।
আরও একটা ব্যাপার। উক্ত প্রশ্নে, সগীর নামক এক ভদ্রলোকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি নির্লোভ। কোন পেশার, তা হলা হয়নি। কিভাবে তিনি ধনী হলেন, সেটাও সাসপেন্সে রাখা হয়েছে। ‘নির্লোভ’য়ের ব্যাখ্যা স্বরূপ শুধু বলা হয়েছে, তিনি সামাজিক এবং জনকল্যাণমূলক কাজে বেশ দান খয়রাত করেন। প্রায় টিপিক্যাল রবিনহুড ফর্মুলা। এরপরে বোঝাবার চেষ্টা হয়েছে, ‘লোভ’ করলে এর শেষ কখনওই আসবে না। সো, যা আছে, সেটাতেই সন্তুষ্ট থাকলে, প্রবলেম সল্ভড। ‘নটে গাছটি মুরালো।’
আপাতত যা হচ্ছে, তা হল পেশাভিত্তিক রিয়াকশান। এটা বাংলাদেশে বেশ স্বাভাবিক। গাড়ির হেল্পারকে অ্যারেস্ট করলে, আর সে যদি নেতা হয়, ব্যাপারটা হয়ে যাবে, দরিদ্র হেল্পার সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন। শুরু হয়ে যাবে হরতাল। লঞ্চডুবির জন্য কোন আকশান নিতে গেলেই শুরু হয়ে যাবে লঞ্চ ধর্মঘট। ডাক্তাররা বরং এদিক দিয়ে বেশ দুর্বল প্রতিপক্ষ। বিকেলে বা চেম্বারের সময় মানববন্ধন করলে ভিড় জোটানো কষ্টকর হয়ে যায়। কিংবা প্র্যাকটিস বন্ধ রাখা টাইপ আন্দোলনের কোন সিদ্ধান্ত নেয়া কত কষ্টকর, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। এনিওয়ে, ডাক্তারদের এই রিয়াকশান দেখে আমি তেমন অবাক হইনি, তেমনি অবাক হব না, কিছুদিনের ভেতরে যখন সবাই সবকিছু ভুলে যাবে।
আমি ভাবছি অন্য কথা। লোভীর উদাহরণ হিসেবে আর কি পেশা দেয়া যেত? কৃষক? টাকা উপার্জনের জন্য সে সারাদিন কেবল চাষবাস করে? কেমন যেন শোনাত, তাই না। কৃষক মানেই গরিব, দুঃস্থ এক মানুষ। দিন আনে দিন খায়। দারিদ্র যার নিত্য সঙ্গী। সে লোভী হতে চাইলেও সুযোগ তেমন নাই। সো, বাদ। একই ফর্মুলায়, মৎস্যজীবী, শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, ড্রাইভার এরাও বাদ। ইনফ্যাক্ট সব গরীব মানুষই বাদ।
শিক্ষক? যিনি অর্থ উপার্জনের জন্য সারাদিন শুধু পড়ান? দেয়া যায়। ইদানীং প্রাইভেট পড়ানোকে অপরাধের স্ট্যাটাস দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। কোচিংয়ে পড়ালে ব্যাপারটাকে কটাক্ষ করা যেতেই পারে। বেশি ব্যাচ পড়ালে, কিংবা এক ব্যাচে অনেক ছাত্র রাখলে, কিছুটা উষ্মা অনেকেই প্রকাশ করেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, এনিয়ে কিছু ফিসফাস হলেও, সেভাবে আক্রমণ কখনওই হয়নি। আর স্বায়ত্ত্বশাসন থাকায়, তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু করাও সম্ভব না। মোদ্দা কথা, তাঁদের এই আয় জায়েজ। লোভী বলা যেতে পারে, ইনফ্যাক্ট ডাক্তারদের পরেই যে প্রফেশান নিয়ে অনেকেই নালিশ করে বেড়ান, সেটা হচ্ছে এই শিক্ষক সমাজ। তারপরও, উনাদের সাথে দারিদ্র ব্যাপারটা যত সহজে যায়, লোভী শব্দটা সেভাবে যোগ করার ক্ষেত্রে এখনও একটু ‘কেমন দেখায়’ ভাব কাজ করে। আর প্রশ্নকর্তা নিজেই যেহেতু শিক্ষক, সো, এমনটা না হওয়ারই কথা।
বাকী থাকল কি? পলিটিশিয়ান? এটা যদিও প্রফেশান না, তারপরও, বাংলাদেশে প্রফেশান। ইনফ্যাক্ট আমৃত্যু প্রফেশান। ‘লোভী রাজনৈতিক ব্যক্তি’ বললে কেমন যেন টাকা খেয়ে সুপারিশ করা টাইপ বোঝায়। ওটা অফিশিয়ালি বলার বোধহয় সমস্যা আছে। যেকোন নেতা ভেবে বসতে পারেন, তাঁকেই বলা হচ্ছে। বিরোধী দল একটা ইস্যু পেয়ে যেতে পারে। ভাবতে পারে, এটা সরকারের আসল চেহারা উন্মোচন করেছে, সো এই সরকারের এখনই পদত্যাগ করা উচিৎ। সো, ওটা দেয়া রিস্কি ছিল। তাই সম্ভবতঃ প্রশ্নকর্তা মহাশয় ওটা বাদ দিয়েছেন।
বিচারক? আমলা? ইনক্যাম ট্যাক্স অফিসার? পুলিশ অফিসার? আসলে কোনটাই দেয়া সম্ভব না। কারণ এসবের সবগুলোতেই এক্সট্রা আয়ের একমাত্র পন্থা, অসৎ উপায় কিংবা সৎ বাংলায়, ‘ঘুস’। বিচারক ঘুষ খেয়ে জামিন দিয়েছেন, বললে, প্রশ্নকর্তার খবর ছিল। উকিল বললে এতক্ষণে দুদশটা কেস হয়ে যেত। আমলা বললে তো কথাই নেই, প্রশ্নকর্তা বেচারা চাকরি হারাত। আর পুলিশ অফিসার বললে? চৌদ্দ শিক। সো? ডাক্তার, দ্যা কসাই গাই।
প্রশ্নটার আরও কিছু ব্যাপার বেশ মজা লাগল। লোভ বলতে উনি কি বোঝালেন? অর্থ উপার্জনকে? না জনকল্যাণমূলক কাজে খরচ না করাকে? যে উদাহরণ দিয়ে তাঁর বন্ধু সগীর সাহেবের লোভ না থাকা বোঝানো হল তা হচ্ছে ‘জনকল্যাণমূলক কাজে টাকা পয়সা দান করা’। আচ্ছা ডাক্তার ভদ্রলোক যদি টাকা আয় করে জনকল্যাণমূলক কাজে দান করতেন? প্রতি শুক্রবার ফকির খাওয়াতেন কিংবা দুঃস্থদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণের জন্য চাঁদা দিতেন? কিংবা প্রতি শুক্রবার নিজ এলাকায় গিয়ে ফ্রি রুগী দেখতেন? তাহলে? তিনি আর লোভী থাকতেন না?
এনিওয়ে, ‘লোভী ডাক্তার’ শব্দটা নিয়ে আমার তেমন কোন আপত্তি নাই। ব্যাপাটাকে রুগী দেখার লোভ বলেন, রুগীকে সুস্থ করে তোলার লোভ বলেন আর অর্থ উপার্জনের লোভ বলেন। একজন লোভী ব্যক্তি ডাক্তার হতে পারবে না, এমন তো আর না। ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পেলে আর ভালমত পড়াশোনা করলে, তাঁর ডাক্তার হওয়া আটকাবার সুযোগ নেই। আর ব্যাপারটা এমনও না যে চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়া শেষ হওয়ার সাথে সাথে তাঁর ভেতরের ‘লোভ’ উধাও হয়ে যাবে। একজন ব্যক্তির দোষ একজন ব্যক্তিরই। সে ডাক্তার হলেও লোভী হবে, উকিল হলেও হবে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলেও, সাংবাদিক হলেও। সো, লোভী মানুষের পক্ষেও ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সম্ভব। তাহলে বিতর্কটা কি নিয়ে? একজন ডাক্তার লোভী হলেও বলা যাবে না? না ‘লোভী ডাক্তার’ বললে পুরো চিকিৎসক সমাজকেই ‘লোভী’ বলা বোঝায়? নাকি গ্যারান্টি দিচ্ছেন, দেশে কোন লোভী ডাক্তার নেই?
তাহলে একজন ডাক্তার কি করবেন? তার প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জন হয়ে গেলে আর রোগী দেখবেন না?
নাকি যতজন রোগী দেখলে তার প্রয়োজন মিটে যাবে তারপর ফ্রিতে দেখবেন?(লাকী ড্রয়ের মত :-P)
জেগে জেগে ঘুমানো একটা লেখা। sorry to say but কিছুই বুঝলাম না পড়ে।
Example ta doctor kano?