প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৯ জুন, ২০২০, সোমবার
লেখা: ডা. কামরুল হাসান সোহেল
সুনামগঞ্জ জেলার অন্তর্গত একটি দুর্গম উপজেলা শাল্লা। হাওড় উপজেলার আওতায় পড়ায় বর্ষাকালে একে মনে হয় বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি অংশ হিসেবে। উপজেলাটিতে সরকারি কিছু অফিস, কিছু স্কুল, মাদ্রাসা, একটা কলেজ ছাড়া আর কোনো উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ড দেখা যায়না।
বেহাল দশা রাস্তাঘাটের, আধা পাকা, আধা কাচা রাস্তাগুলো বর্ষাকালে তলিয়ে যায় পানির নিচে। কিছু ব্রিজ আছে যা কোন কাজের নয় কারণ ব্রিজের সাথে সংযোগ সড়ক নেই। ৬/৭ বছরেও শেষ হয় নাই দিরাই-শাল্লা সংযোগ সড়কের কাজ।
বর্ষাকালে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা বা স্পিড বোট, যা পাওয়াও দুঃসাধ্য। বিকাল ৫টার পরে কিছুই পাওয়া যায় না। শাল্লার আবহাওয়াটাও বৈরী। এই রৌদ্র আবার এই কিছুক্ষণ পরেই ঝড়ো হাওয়া সহ তুমুল বজ্রপাত ও বৃষ্টি। প্রতিবছরই বজ্রপাতে আর নৌকা ডুবিতে অনেক মানুষ মারা যায়।
শাল্লায় বিদ্যুৎ নিয়েও সমস্যায় পড়তে হয় জনসাধারণকে, ৫/৬ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকেনা, দিনের ১৮/২০ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ বিহীন থাকতে হয়। অফিসের সব কাজকর্ম জেনারেটর চালিয়েই সারতে হয়। সারাদিন পরিশ্রম শেষে রাতে ঘুমানো যায় না বিদ্যুৎ থাকেনা বলে, দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে নিজে অসুস্থ হয়েও রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন শাল্লার চিকিৎসক,নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা।
বিদ্যুৎ যেহেতু নাই সেখানে ইন্টারনেটের আর আশা কোথায় পাই? তবুও ইন্টারনেট চলে কচ্ছপের গতির ন্যায়, যার কারণে করোনা টেস্টের রিপোর্টগুলো সময়মত নিয়মিত আপডেট দেয়া যায় না। বাংলাদেশের অন্য উপজেলার মত সব সুযোগ সুবিধা পাওয়ার অধিকার শাল্লার জনগণেরও আছে।
‘শাল্লা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’ একটি জরাজীর্ণ, রুগ্ন হাসপাতাল। হাসপাতাল নির্মাণ হওয়ার পর আর কখনো কোনো সংস্কার কাজ করা হয়নি হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট দ্বারা, যদিও বা করে থাকে তবে তাও খুব দায়সারা গোছের। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ছাদের প্লাস্টার খসে পড়েছে, বৃষ্টির সময় ভিজে উঠে অফিস রুমের দেয়াল, জায়গায় জায়গায় প্লাস্টার খসে পড়েছে, এতে বড়সড় বিপদ ঘটে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনাও আছে। ছোট ছোট খুপড়ির মত অফিসের সবকটি রুম।
চিকিৎসকদের আবাসন সংকট চরম, ডরমিটরির রুমগুলো খুবই ছোট, জানালার গ্লাস নেই বা ভাঙ্গা, ছাদ থেকে প্লাস্টার খসে পড়ে রুমে, বাথরুমের অবস্থা জঘন্য। বসবাসের অনুপযোগী পরিবেশে থাকছে সব চিকিৎসকরা। তারপরও সবার জন্য ডরমিটরিতে সিট নেই। বাইরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হচ্ছে, তবুও উপজেলাবাসীর জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করে যাচ্ছেন শাল্লার চিকিৎসকরা।
খাবারের ব্যবস্থাও ছন্নছাড়া, নেই ভাল কোন হোটেল বা রেস্টুরেন্ট। ডরমিটরিতে যারা থাকে তারা সবাই মিলে একটা রুমকে ডাইনিং রুম হিসেবে ব্যবহার করে, সেই রুমের একটি জানালায়ও গ্লাস নেই। বুয়ার হাতের আজেবাজে রান্না খেয়ে তাদের ডিউটি করতে হয়। একই দুরবস্থা নার্স ডরমিটরি ও অন্যান্য ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ডরমিটরির।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স শুধু নামে মাত্র একটি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান, এখানে একটি প্যাথলজি ল্যাব নেই, নেই কোন এমটি- ল্যাব, কোন ধরনের টেস্ট হয় না এখানে, একটি ইসিজি মেশিন নেই, একটা এক্সরে মেশিন আছে কিন্তু তা চালু করা যাচ্ছেনা অবকাঠামো সুযোগ সুবিধার অভাবে এবং তা গত ১৫ বছর ধরে পরে থেকেই নষ্ট হয়ে গেছে খুব সম্ভবত। জনবল নেই, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী একদমই নেই, আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে কাজ চালানো হচ্ছে। ৩১ শয্যার জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের এক তৃতীয়াংশ জনবল নিয়ে সেবা কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে।
৫০ শয্যার নতুন হাসপাতাল ভবন, ডক্টরস ডরমিটরি, নার্সেস ডরমিটরির কাজ চলছে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে, আরো দুই বছর আগেই তাদের সব বুঝিয়ে দেয়ার কথা ছিল। আগামী এক বছর পরেও তারা তাদের অবশিষ্ট কাজ শেষ করতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে।
এই ভগ্ন, রুগ্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সীমিত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও সীমিত সুযোগ সুবিধা নিয়ে এই করোনাকালীন সময়ে কোভিড ও নন-কোভিড রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাত্র ৫টি আইসোলেশন বেড রাখার জন্য নির্দেশনা ছিল কিন্তু বর্তমানে ১৩ জন কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী চিকিৎসাধীন আছে। করোনা রোগীদের ভর্তি রাখা হচ্ছে কিন্তু তাদের সেবা দেয়ার জন্য তেমন কোনো সুযোগ সুবিধাই নেই, সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন তো দূরের কথা মাত্র ছয়টি অক্সিজেন সিলিণ্ডার আছে। আর কিছুই নেই তবুও করোনা রোগীদের ভর্তি করতে হচ্ছে, সেবা দেওয়া হচ্ছে তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ থেকে, মানবতাবোধ থেকে।
দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা সুযোগ সুবিধা নেই বলে মুখ ফিরিয়ে নিলে, দায়িত্ব না নিলে কোথায় যাবে এই অবহেলিত জনপদের মানুষগুলো?
শাল্লা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে উন্নততর চিকিৎসার জন্য সুনামগঞ্জ বা সিলেট রেফার করলে রোগী পরিবহনের জন্য নেই কোনো এম্বুলেন্স সুবিধা। তাই ঝুঁকি নিয়েই করোনা রোগীদের ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে এখানে। বেহাল দশা তবুও চলছে চিকিৎসা।
এখন পর্যন্ত ৩৫ জন পজিটিভ রোগীর মধ্যে ১৮ জন রোগী হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। আরো অনেকেই হোম আইসোলেশনে সুস্থ হওয়ার পথে। এত এত সীমাবদ্ধতার মধ্যে আর যাই হোক চিকিৎসা সেবা দেয়া প্রায় অসম্ভব। এই অসম্ভব কাজকে সম্ভব করে তুলছেন শাল্লা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক,নার্স ও অন্যান্য স্টাফরা।
নিজস্ব প্রতিবেদক
তাসনিম সানজানা কবির খান