#খোকার_সাধঃ
১….
অসুস্থ এক আত্মীয়কে দেখতে এক কর্পোরেট হাসপাতালে যেতে হলো।আমি যখন দর্শন দিলাম, তারা তখন হাসপাতাল ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।যে রোগ(PUO) নিয়ে তারা হাসপাতালে প্রবেশ করেছিলেন, তার সুরাহা এখনো হয়নি। এ অবস্থায় হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাওয়াটা কোনো কাজের কথা না।
হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে চাইবার কারণ বের করলাম।যে ছোট খুপড়ি ঘরে আমি বসে আছি–প্রতিদিন এই ঘরে থাকার জন্য তাদের গুণতে হচ্ছে ৭,০০০ টাকা।
আমি ৭০০০ টাকার সাথে ৩০ গুণ দিলাম।১০ ফিট বাই ১২ ফিট মাপের এই রুমের মাসিক ভাড়া তাহলে ২,১০,০০০ টাকা!!!এই টাকায় অনায়াসে বনানীর কোনো এক ডুপ্লেক্স বাড়ীতে মাসখানেক ভাড়া থাকা যায়।
ব্যবসা খারাপ না!!
২….
আমার এক পেশেন্ট আগে আমাকে ভিজিট দিতে কখনোই কার্পণ্য করতেন না, তবে এখন করেন।কার্পণ্য করার কারণটা বলি।
রোড এক্সিডেন্ট হয়ে একবার ভদ্রলোককে ২২ দিন ICU তে থাকতে হলো।প্রতিদিন তাকে শুধু ICU ভাড়াই দিতে হয়েছে ২০,০০০ টাকা।নিম্নমধ্যবিত্ত লোক তিনি, জীবনের সব সঞ্চয় তাকে হাসপাতালে দিয়ে আসতে হয়েছে।
এই দেশের অধিকাংশ লোক মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত। যদি প্রয়োজন হয় তবে তাদের কয়জন প্রতিদিন বিশ হাজার টাকা খরচ করতে পারবেন? আমরা কয়জন পারবো? টাকার এই পরিমাণটা কতটা যৌক্তিক?
৩….
নিজের মা যখন পিজি/BSMMU এ ভর্তি ছিলেেন, তখন প্রায়ই Serum creatinine(এক ধরণের কিডনী ফাংশন মার্কার) নামে একটি পরীক্ষা করাতে হতো, পরীক্ষাটি আমি করাতাম কিডনী রিসার্চ ল্যাবে।
কিডনী রিসার্চ ল্যাবে যারা কাজ করতেন তাদের সাথে আমার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো।কথায় কথায় জেনেছিলাম প্রতিবার Serum Creatinine করতে খরচ হয় আনুমানিক ১৫-২০ টাকার মত, আনুসঙ্গিক খরচ বিবেচনা করে BSMMU তখন রাখত ৭০ টাকা।
একই পরীক্ষা করাতে দেশের নামীদামী হাসপাতালে ৫০০-৬০০ টাকা খরচ করতে হবে।
যতবড় কর্পোরেট হাসপাতালই হোক না কেনো, ৭০ টাকার জায়গায় তারা ৯০ টাকা নিতে পারেন, ১০০ টাকাও নিতে পারেন, ৫০০-৬০০ টাকা নিতে পারেন না, এটি রীতিমত দিনেদুপুরে ডাকাতি।
দা-চাপাতি-পিস্তল নিয়ে ডাকাতরা ডাকাতি করে -আমি এখন একথা আর বিশ্বাস করি না, স্যুট-টাই পরা লোকও এদেশে সমান তালে ডাকাতি চালিয়ে যাচ্ছে।
৪..
কয়দিন আগে পেপার পড়ছিলাম।খবরে দেখলাম এক প্রাইভেট হাসপাতাল উদ্যেগ নিচ্ছে যাতে প্রতিবার ডায়ালাইসিস করতে রোগীর খরচ পড়বে ১১০০ টাকা।সপ্তাহে সাধারণত তিনবার এই ডায়ালাইসিস নিতে হয়।
বর্তমানে কর্পোরেট হাসপাতালগুলোতে প্রতি ডায়ালাইসিসে খরচ পড়ে ৫০০০ টাকার মত ।
একটা তথ্য দেইঃ প্রতিবছর খরচ কুলাতে না পেরে ৪০,০০০ লোক ডায়ালাইসিসের অভাবে মারা যায়।
প্রশ্ন হলো–“চিকিৎসা” কি কোনো বিলাসী ব্যাপার? খরচের এত পার্থক্য কি মেনে নেয়া যায়? প্রতিবছর ৪০০০০ লোক কি মারা যাচ্ছেন নাকি আমরা তাদের হত্যা করছি?
৫….
আমার এক রোগী ক্লিনকাট হার্টের পেইন(IHD) নিয়ে ১-২ মাস পরপর আমার কাছে আসেন।ওষুধ দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও এখন আর লাভ হচ্ছে না। বহু আগেই কার্ডিওলজিস্ট এর কাছে রেফার করেছিলাম।
কার্ডিওলজিস্ট Angiogram করে হার্টে রিং লাগতে বলেছেন।দুইটার মত রিং লাগবে।রিং প্রতি খরচ লাখখানেক।দুই-আড়াই লাখ টাকা খরচ করে রিং লাগানোর ক্ষমতা উনার নেই।শেষবার বুকের ব্যাথার কারণে চোখে পানি নিয়ে বিদায় হলেন, আমি স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম।
লেটেস্ট আপডেট হলো, প্রতি রিং এর আমদানি খরচ ১৮,০০০ টাকা।হার্টে যখন এটি বসানো হয় তখন সেটি হয়ে যায় এক-দেড় লাখ টাকা।
মগের মুল্লুক বোধ হয় একেই বলে।
#Analysis….
■■স্বাধীনতার সমসাময়িক সময়ে এদেশে বিত্তশালী লোক ছিলো হাতেগোণা।স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এদেশে অনেকেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, এখনো হচ্ছে।কিভাবে এদেশের কিছু ব্যবসায়ী বিত্তবান হচ্ছে-সেটা বোঝার জন্য উপরের উদাহরণগুলো যথেষ্ট।
একটি ভুল ধারণা ভেঙ্গে দেয়া প্রয়োজন।স্বাস্থ্যখাতে যে দুর্বৃত্তায়নের কিছু চিত্র আমি তুলে ধরেছি, সেগুলোর সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিকিৎসক কিন্তু সংশ্লিষ্ট নন।চিকিৎসকদের ঘাড়ের উপর বন্দুক রেখে রেখে কিছু বিবেকহীন ব্যবসায়ী তাদের বিবেকবর্জিত ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে দিনের পর দিন আমরা চিকিৎসকরা ব্যাপারগুলোতে নীরব থেকেছি।দায়ভার কিছুটা আমাদের উপর বর্তায় তো বটেই।আমাদের ভুলে গেলে চলবে না– “The world will not be destroyed by those who do evil, but by those who watch them without doing anything”
■■সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে শুধুমাত্র একটি প্রশ্ন করিঃ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও কেনো একই পরীক্ষা এক হাসপাতালে ৭০ টাকা আর অন্য হাসপাতালে ৫০০, ৬০০ কিংবা ৭০০ টাকা? স্বাস্থ্যখাতের মত একটি সংবেদনশীল খাতে এটি কতটা মানানসই? আপনাদের আর চুপ থাকাটা কতটা শোভনীয়?
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি, Without any delay, I repeat, without any delay solve the issues. সচেতন নাগরিক হিসেবে বলছি-আপনারা জবাবদিহিতার উর্দ্ধে নন….
■■দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাই, সাধারণ জনগণদের একটা তথ্য দেই…
আমার এক পরিচিত কয়দিন আগে এক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।চিকিৎসকের ফি ও ইনভেস্টিগেশন বাবদ তার খরচ হয়েছে হাজার দশেক টাকা। চিকিৎসকের ফি ১০০০ টাকা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা খরচ ৯০০০ টাকার মত….
এবার দুঃখের কথা বলি।আপনারা একজন এক্সপার্ট আইনজীবীর ফি ২৫,০০০-৫০,০০০ টাকা দিতে কার্পণ্য করেন না, একজন ব্রিলিয়ান্ট ডক্টর এর ফি ১০০০ টাকা দিতে গিয়ে তোলপাড় শুরু করেন…..
আপনাদের এই তোলপাড়টা সঠিক জায়গায় করলে ইনভেস্টিগেশন খরচ ৯০০০ টাকার স্থলে ৪০০০ টাকায় করাতে পারতেন।চিকিৎসকদের ভিজিট নিয়ে সামনেপিছনে যে ডিগবাজীটা আপনারা দেন তার একদশমাংশ কষ্ট করলে ICU এর খরচ ২০,০০০ টাকা পার ডে না হয়ে ১০,০০০ টাকা পার ডে হতো, রুম কস্ট ৭,০০০ টাকা না হয়ে ৭০০ টাকা হতো, আপনারা লাভবান হতেন….
‘Alas! We don’t even know where to hit….’
#পরিশেষঃ
নগর পুড়লে দেবালয়ে কিন্তু আগুনের আঁচ লাগে।এই দেশের পরতে পরতে যখন দুর্বাত্তায়নের নগ্নলীলা চলে তখন তা থেকে স্বাস্থ্যখাতও বাদ যাবে না -সেটা স্বাভাবিক।কিন্তু মনে রাখতে হবে চিকিৎসা একটি মৌলিক অধিকার, যাচ্ছেতাইভাবে দুর্বৃত্তায়নের সুযোগ তাই এই সেক্টরে কাম্য নয়….
একটা কথা আমি প্রায়ই বলি, দেশটা আমার, দেশটা আমাদের।যারা এই দেশের স্বাস্থ্যখাতকে চুষে জোঁকের মত ফুলে উঠেছে-তারা আমাদের লোক হতে পারেনা….
এই দেশের আপামর জনতাকে যারা ঠকায়, তারা যতই শক্তিধর হোক-সেই শঠদের চোখ রাঙানিতে আমি ভীত নই।বাংলার পবিত্র মাটি থেকে এদের বিদায় নিতে হবে।আমরা সবাই জেগে উঠলে তা অসম্ভব নয়, সূর্যোদয় হলে আঁধার তিরোহিত হতে বাধ্য।প্রিয় কবি নজরুলের “খোকার সাধ” কবিতার দুটো লাইন বলে বিদায় নেইঃ
“আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!”
…
লিখেছেনঃ
ডা. জামান অ্যালেক্স
ডা.
So sab to be honest.