প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৭ জুন ২০২০, বুধবার
ডা সুরেশ তুলসান
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ
খুলনায় ডা রাকিব উদ্দিন নামে একজন সিনিয়র ডাক্তার প্রকাশ্যে খুন হয়েছেন রোগীর স্বজনদের হাতে। ভাবা যায়, করোনার মত এই মহা দুর্যোগের মধ্যে হাজার হাজার ডাক্তার যেখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, আর দিনে দিনে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ডাক্তারদের মৃত্যুর মিছিল, এরকম একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও কিছু মানুষ একজন সিনিয়র এবং স্থানীয় ভাবে ভালো মানুষ হিসাবে যথেষ্ট সুনাম আছে এমন একজন ডাক্তারকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করতে পারে?
এটা শুধু বাঙালীদের দ্বারা বাংলাদেশেই সম্ভব, কারণ আমাদের মনের অজান্তেই লালিত আমাদের বংশপরম্পরার ডাক্তার বিদ্বেষ।
ডাক্তার বনাম জনগণ।
অতীত এবং বর্তমান- সামাজিক অবস্থান বাংলাদেশ, এই বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলেই আমরা বুঝতে পারবো, “ডাক্তার বিদ্বেষ কেন আমাদের অস্থিমজ্জায়”।
ইদানীং কালে বহুলভাবে ব্যবহৃত একটি কথায় আমার কান, চোখ, মগজ আর মন যেন ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। এবং সেই কথাটি হলো ডাক্তার বনাম সাধারণ জনগণ এর মুখোমুখি অবস্থান। সেবা গ্রহীতা বনাম সেবাদাতা। আর সেবার ধরনটাও কিন্তু সেইরকম। মানুষের সবচাইতে অমূল্য সম্পদ, মানবদেহ অর্থাৎ শরীর, সুস্বাস্থ্য এবং জীবনের সেবা।
বুদ্ধি হওয়ার প্রাক্কালেই জেনে এসেছি-
“নুন খেয়ে নিমক হারামি করা উচিৎ না।”
অথবা
“নুন খাই যার গুন গাই তার।”
অর্থাৎ
যার কাছ থেকে আমরা সেবা নিবো তার নিন্দা আমরা করতে পারবো না, গায়ে হাত তোলা তো অনেক পরের কথা।
এই কথাগুলোই আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ যে তা জানেন না, তা কিন্তু না। তারপরও কেন এত ডাক্তার বিদ্বেষ?
আরও একটা বিষয় কিন্তু পরিস্কার। সাধারণ জনগণ কিন্তু এটাও জানেন যে সুস্থ ভাবে জন্মাতে হলে, সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে হলে এবং স্বাভাবিক ভাবে মরতে হলে ডাক্তারকে তাদের লাগবেই। তা তারা যতই ডাক্তার বিদ্বেষী হন না কেন। ডাক্তারের প্রয়োজন এক্কেরে জন্মের দিন বা জন্মক্ষণ থেকে মৃত্যুর দিন বা মৃত্যুর মুহুর্ত পর্যন্ত। এমনকি মৃত্যুর পরও ডাক্তারের দেয়া ডেথ সার্টিফিকেট না হলে তাদের চলবে না।
উপরন্তু সাধারণ জনগণ এটাও ভালোভাবেই জানেন তাদের হাতে ডাক্তার ছাড়া ডাক্তারের বিকল্প কিন্তু কিছু নাই। অথচ ডাক্তারদের হাতে কিন্তু ডাক্তারি ছাড়াও বিকল্প অনেক পেশা আছে। বিকল্প পেশায় ডাক্তারদের ঈর্ষনীয় সাফল্যের অনেক উদাহরণ আছে পৃথিবী জুড়ে। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং তো আমাদেরই কেউ। লোটের রাষ্ট্র পরিচালনায় সাফল্য কিন্তু অভাবনীয়।
কারণ সমাজের বাছাই করা মেধাবী শিক্ষার্থীরাই ডাক্তার হয়। তা ডাক্তাররা যে পেশাতেই যাক না কেন ভালোভাবেই সাফল্যের শিখরে উঠে বাঁচতে পারবে।
হয়তো বা অন্য পেশায় এর চেয়েও অনেক ভালো কিছু করবে। তাহলে এতোকিছুর পরেও কেন ডাক্তার বিদ্বেষ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে?
অনেক ভেবেচিন্তে একটি প্রশ্ন মাথায় উঁকি দিচ্ছে বারংবার –
এই ডাক্তার বিদ্বেষের বীজ কি আমরা নিজেরাই নিজেদের অজান্তে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বপন করছি না? ঠিক যেভাবে আমাদের অবিভাবকরা এবং পুর্বপুরুষেরা আমাদের মধ্যে বপন করে গেছেন।
অবাক হচ্ছেন এ আবার কি অলুক্ষনে কথা? ভয় নাই ব্যাখ্যা দিচ্ছি।
শৈশবের কয়েকটি ছড়ার কথা মনে পড়ে গেল —
“খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিবো কিসে?”
অথবা
দাদি নানিদের ঘুম পাড়ানিয়া ভুতের গল্প।
তাইতো শৈশবের সেই বর্গী আর ভুতের ভয় আজও চিত্ত থেকে দূর হয় নি – যদিও ভুত বলতে আদতেই কিছু নেই এটা সকলেরই জানেন, বোঝেন এবং বিশ্বাসও করেন। এই ছড়াগুলো যেমন আমাদের মনে ভুত আর বর্গীদের ভয় জন্মিয়েছে তেমনই অনেক ছড়া ও অন্যান্য সাহিত্য কর্ম এবং আমাদের অনেক দৈনন্দিন বদ- অভ্যাস আমাদের মাঝে জন্ম দিয়েছে ডাক্তার বিদ্বেষের। যেমন, এরপর শৈশব কাটিয়ে বাচ্চারা যখন স্কুলে যায়, তখন অতি সাধারণ একটি ইংরেজি ট্রান্সলেশন “ডাক্তার আসিবার পুর্বেই রোগীটি মারা গেলো”।
দেশের নুন্যতম শিক্ষিত কেউ কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন এই ট্রান্সলেশন তিনি করেন নাই, এবং এই ট্রান্সলেশন করার সময় সেই রোগীটির মৃত্যুর জন্য মনে মনে সেই অদেখা কাল্পনিক ডাক্তারকে দোষী সাব্যস্ত করে অভিসম্পাত করেন নাই?
“সফদার ডাক্তার মাথাভরা টাক তার ক্ষিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ে,
চেয়ারেতে রাতদিন বসে গুণে দুইতিন, ক্ষিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ে ”
– এই ব্যাঙাত্বক কবিতা টিকে অনেকেই হয়তো একটি নিছকই নির্দোষ হাস্যরসের কবিতা বা ছড়া বলবেন।
আমার কাছে কিন্তু আমার ছেলেবেলাতেই এই কবিতাটিকে চরমভাবে ডাক্তার বিদ্বেষী মনে হয়েছিল।
কেন যেন মনে হয়েছিল কবি ইচ্ছাকৃতভাবে ভাবেই সমাজের কাছে ডাক্তাদেরকে হেয় করার জন্যই বেচারা সফদার ডাক্তারের মত একটি চরিত্র সৃষ্টি করে ডাক্তাদের সম্পর্কে এই রকম অ-সম্মানজনক, মানহানিকর কটু শব্দগুলো ব্যাবহার করেছিলেন। কারণ আমার স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হওয়ার। একটা সম্মানজনক এবং স্বাস্থ্যসেবার মত মহৎ পেশাকে হেয় করার মত,ভিলেন বানানোর মত কবিতা কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে! ভাবতেও অবাক লাগে।
মনে হলো আলেকজান্ডার দি গ্রেটের একটা কথা, তিনি এই দেশে (ভারতবর্ষে) এসে যথার্থই বলেছিলেন, “সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!”
ঠিক এভাবেই ডাক্তারদের হেয় করা হয়েছে, ভিলেন বানানো হয়েছে যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।
ঠিক এভাবেই ডাক্তার বিদ্বেষ আমাদের অস্থিমজ্জায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিস্থাপিত হয়ে আসছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।
তাইতো, ঔষধ তিতা হলে আমরা বাচ্চাদের বলি,
“এবারের মত খেয়ে নাও লক্ষী সোনা, ডাক্তার আসুক শালাকে ধরে আচ্ছামত পিটাবো, এত্ত বড় সাহস আমার বাবুসোনাকে তিতা ঔষধ দিছে”।
অথবা ইঞ্জেকশন এর ব্যাথা দিয়েছে নার্স অথবা কম্পাউন্ডার আর আমরা কিনা বাচ্চাদের বলি
“পাজি ডাক্তার ব্যথা দিয়েছে? বাবা একটু শান্ত হও, আবার আসুক আচ্ছামত পিটাবো ডাক্তারকে”।
আরও একটা অভিজ্ঞতা আমার মনে হয় কম বেশি সব ডাক্তারের হয়েছে, সেটা হলো যখন কোন রোগীর সাথে যদি কোন বাচ্চাকাচ্চা আসে এবং সেই বাচ্চা যদি ডাক্তারের চেম্বারে দুষ্টুমি করে তাহলে অবিভাবকেরা ডাক্তারের সামনেই বাচ্চাটিকে ভয় দেখায় এই বলে যে,
“ইনি ডাক্তার, দুষ্টুমি করলে মোটা সুঁই দিয়ে ইঞ্জেকশন দিয়ে দিবে কিন্তু”
— যেন ডাক্তার মানেই মস্ত বড় এক খলনায়ক!
ঠিক একারণেই যেভাবে আমাদের মাঝে ভুতের অস্তিত্ব না থাকা স্বত্বেও যেমন ভুতের ভয় তৈরি হয়ে আছে, ঠিক সেভাবেই তৈরি হয়েছে ডাক্তার বিদ্বেষ, এবং তা চলছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ঠিক যেন জেনেটিকস এর ধারাবাহিকতায় মেন্ডেলীয় মতবাদ মেনেই।
সেই সাথে আরও একটা ধারণা সেই শৈশব থেকেই আমাদের মনের অন্দর কোঠায় প্রথিত হয়ে আছে,
এবং সেটা হল, ডাক্তাররা হলো একপ্রকার আজ্ঞাবহ, নিরীহ, গোবেচারা, অবলা প্রাণী। এরা যখন তখন যে কোন রকমের হুকুম আবদার তামিল করবে। যখন তখন ডাকলেই কলে আসবে। আবার সেবা পছন্দ না হলে অথবা নেহায়েত ইচ্ছে হলেই যখন তখন যে কোন কারণে যে কোন ডাক্তারকে পিটানো যাবে, অপমান করা যাবে বা লাঞ্চিত করা যাবে। যেন দু-চারটে ডাক্তার মারা তেমন কোন কঠিন কাজ বা অপরাধের মত তেমন কিছুর পর্যায়ে পড়ে না। অনেকটা যখন তখন রাস্তার দুই একটা কুত্তা বিড়াল পিটানো বা এদের গায়ে গরম পানি ঢেলে দেয়ার মতই সহজ এবং সাধারণ একটা বিষয়। এখন তো সামাজিক চরম অবক্ষয় ধর্ষণের মত বিষয় যুক্ত হয়েছে নারী চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে, তাই তো কন্যা তুল্য কোন নারী চিকিৎসককে একজন ছাত্রনেতা হুমকি দিয়েছে, “বাইরে বের হ একবার, রেইপ করে ফেলবো”।
এই ডাক্তার মারার বিষয়টি যেন এতোটাই ছেলেখেলায় পরিনত হয়েছে যে, এর প্রতিফলন আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই যখন একজন জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদী কোন রোগে ভোগা কোন রোগী বা রোগীর আত্মীয়রা কথায় কথায় কথাচ্ছলে চেম্বারে এসে বলেন, স্যার দেশে বিদেশে অনেক ডাক্তার মারলাম কিন্তু কোন লাভ হলো না। এবং আমার কাছে কোন রোগী বা রোগীর আত্মীয়রা এধরণের কোন কথা বললে আমি তাদেরকে লজ্জা দেওয়ার জন্য হলেও একটা প্রশ্ন করি, আচ্ছা আপনি যে ডাক্তার মারলেন, তা কয়জন ডাক্তারকে কে মারলেন? কয়জন মিলে মারলেন? কিভাবে মারলেন? বা কি দিয়ে মারলেন?
এবার দুটি ঘটনার উল্লেখ করি।
(১) ঘটনা – ১, একটা দুষ্টু বাচ্চা ৯ বছর বয়স। মুসলমানি অর্থাৎ Circumcision দিবো বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি। অজ্ঞান করেই দিতে চেয়েছিলাম। অভিভাবকের অনুরোধে অবশ করে দেয়ার প্রয়াস। বাচ্চাটা একেবারেই Noncoperative। সমানে হইচই করছে ওটির টেবিলে তোলার পর থেকেই। বাচ্চাটার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বাচ্চাটার মামা ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। এক পর্যায়ে বাচ্চাটার মামা বাচ্চাটিকে বললেন “কাটার সময় ডাক্তার ওখানে ভালোমতো অবশ করে নিবে, তোমার কোন ব্যথাই লাগবে না। আরা যদি ডাক্তার তোমাকে একটুও ব্যাথা দেয় তাহলে তোমার ছোট চাচ্চুকে দিয়ে ডাক্তারকে আচ্ছামতো মার দেওয়াবো। (বাচ্চাটার ছোট চাচ্চু কিন্তু বেশ নাম করা একটা কিছু)।
বলাবাহুল্য – সেদিনের সেই বাচ্চাটাকে আমি ফেরত দিয়েছিলাম বুল্টিটা না কেটেই।
(২) ঘটনা -২,
এক ছাত্রনেতা। মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট। পায়ের কিছুটা অংশ কেটে গেছে বা থেতলে গেছে। পরিস্কার করে সেলাই বা একটা কিছু করার জন্য ওটির টেবিলে নিলাম।
পরিস্কার বা সেলাই বা কিছু একটা করা তো পরের কথা। অবশ করার ইঞ্জেকশন দেয়ার সময়ই ভীষণ হইচই।
ডাক্তারের মা-বাপ তুলে গালাগালি। মনে হলো ছেলেটির অবিভাবকেরা সেই বাচ্চাটার মামার মতোই হয়তো শৈশব থেকেই ওর মনে ডাক্তার বিদ্বেষ এর বীজ বপন করেছেন।
অনেকেই হয়তো বলবেন অসুস্থ ছেলেটা কি বলতে কি বলেছে। প্রথমত সে কিন্তু ছেলেটা না, রীতিমতো প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মানুষ।
ঔদার্য বা মানবিকতা? সেটা তো ডাক্তারদের মাঝে তিলে তিলে বিনষ্ট হয়েছে বা হচ্ছে আমাদের অতীত আর বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থার কারনেই।
সংগত কারনেই সেই ছাত্রনেতা কে ড্রেসিং দিয়ে রাজশাহীতে রেফার্ড করেছিলাম বাধ্য হয়েই।