সম্ভাব্য কোভিড-১৯ রোগীঃ স্বজনরা কাছে যেতে অনিচ্ছুক, পাশে ডাক্তার

৫ এপ্রিল ২০২০: একজন কোভিড-১৯ সন্দেহযুক্ত শ্বাসকষ্টের রোগীকে CCU তে চিকিৎসা দেওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন চট্টগ্রাম মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও Coronary ইউনিট ইনচার্জ ডা. এস এম মুইজ্জুল আকবর চৌধুরী।

সংকট থাকবেই, থাকবে করোনা ঝুঁকি, তবুও স্বপ্নগুলো বেঁচে থাক। একদিকে নবজাতকের একজন মুমূর্ষু মা আর পেশাগত দ্বায়িত্ব, অন্যদিকে অন্যান্য রোগী-ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণের শংকা ও আমাদের সীমাবদ্ধতা।

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চারদিন আগে সিজারিয়ান অপারেশন হওয়া এক রোগী severe respiratory distress (শ্বাস কষ্ট) নিয়ে আমাদের চট্টগ্রাম মা- শিশু ও জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়। মেডিসিনে রোগীকে Post partum cardiomyopathy হিসাবে Provisional ডায়াগনোসিস করে এবং রোগীকে CCU তে পাঠায়। সিসিইউতে চিকিৎসা শুরু করা হয়। কিন্তু রোগীর Chest Examination এ Consolidation এর Findings পেলে urgent Chest X-ray করতে বলা হয়। কিন্তু রোগীর কন্ডিশন খারাপ। এক্স-রে করতে নেওয়া যাচ্ছে না। কন্ডিশন একটু ভাল হলে এক্স-রে করানো হয়। ফ্লিম যখন হাতে আসে তখন রাত ১টা। এক্স-রে তে Bi-lateral consolidation involving mid & lower zone suggesting Atypical Pneumonia। X-Ray দেখে শুরুতেই একটাই চিন্তা COVID-19! আর ইতিমধ্যেই CCU র সব ডাক্তার-নার্স-স্টাফ এক্সপোজড! যদি COV + ve হয় তবে সবারই সংক্রমণের শংকা!

শুধু কি ডাক্তার নার্স? আশে পাশের রোগীগুলোও ঝুঁকির মুখে। নিয়ম অনুযায়ী further evaluation, isolation & diagnosis confirmation এর জন্য করোনা নির্ধারিত হাসপাতালে patient transfer করে দিলেই বাঁচোয়া। কিন্ত বিবেক সায় দেয় না, পেশাগত commitment সায় দেয়না। এতো রাতে Transfer করলে পথে রোগীর যে কোন অঘটন হয়ে যেতে পারে, রোগীকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হবে। আর এই মাঝ রাতে রোগী কোথায় যাবে, কে ভর্তি নিবে? সেই সাথে ভর্তি জটিলতায় চিকিৎসার অভাবে ডাঃ তাজকিয়ার মায়ের মৃত্যুর মতো আরেকটা মৃত্যু হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন হাসপাতালের পরিচালক ডা. নুরুল হক ভাইকে ফোন দিলাম। তিনি দুই রিং হতেই ফোন ধরলেন। উনার সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিলাম সিসিইউ-র মধ্যেই রোগীর সর্বোচ্চ আইসোলেশন মেইনটেইন করে স্ক্রিন দিয়ে ঘিরে চিকিৎসা অব্যাহত রাখার। ইতিমধ্যে প্রায় ছয় ঘন্টা পেরিয়ে গেছে, রোগীও ট্রিটমেন্ট-এ কিছুটা রেসপন্স করছে, শ্বাসকষ্ট কিছুটা কমে আসছে। রেসপিরেটরি রেট, হার্ট রেট কমে আসছে, হাই ফ্লো অক্সিজেনে সেচুরেশন মেইনটেইন হচ্ছে। তবু সারাক্ষণ শংকায় কাটাচ্ছি। Inadequate Protection নিয়ে ডিউটি করছে আমাদের ডাক্তার-নার্স-স্টাফরা। ডিউটিতে ডা. নাজিমউদ্দীন মোঃ সৈকত। ওর commitment আর সাহস সত্যিই প্রশংসনীয়। কোন দ্বিধা ছাড়াই COVID হতে পারে জেনেও রোগীর পাশে থেকে সারা রাত চিকিৎসা দিয়ে গেছে আর নার্স-অন্যান্য স্টাফরাও কাজটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে সব ঝুঁকি মাথায় সারা রাত নিরলস কাজ করেছে। আমার সিসিইউ টিম নিয়ে আমার সত্যিই গর্ব হচ্ছে। নির্দ্ধিধায় বলতে পারি, এরাই হচ্ছে মহান চিকিৎসা পেশার প্রকৃত উত্তরাধিকারী।

সকালে রোগীর এক্স-রে, ECHO করালাম আর CBC, CRP, S Ferritin করতে পাঠালাম। এক্স-রে তে দেখলাম opacity আরো বেড়েছে আর ECHO-তে Normal LV function. তাই রোগীর Cardiomyopathy না। আমাদের মেডিসিন এন্ড এলাইডের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. শেখ মোহাম্মদ হাসান মামুন ভাইকে রোগীর অবস্থা অবহিত করলে তিনি রোগীর সর্বোচ্চ চিকিৎসার নির্দেশনা দেন।

এতো কিছুর মাঝেও মজার একটা অবজারভেশন আছে!
আমাদের মাঝে সারাক্ষণ অন্যান্য রোগীর মাঝে সংক্রমনের শংকা ছিলোই তাই সাসপেক্টেড করোনার চিকিৎসা চলছে এটা গোপন রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা শুরু থেকেই ছিল। কিন্তু অন্যান্য রোগী ও রোগীর স্বজনরা কোথা থেকে জেনে গেছে বা বুঝে গেছে একজন সাসপেক্টেড রোগী ওয়ার্ডে আছে! এতে তারাও খুবই আতংকিত হয়ে পড়ে শুধু তাই নয় তারা কোনো করোনা রোগী সাথে থাকবেনা, করোনা রোগী দ্রত সরাতেই হবে, করোনা হার্টের ওয়ার্ডে থাকতে পারবেনা। এটা মরণ ব্যাধি। তারা এই মরন ব্যধির ছোয়ায় মরতে চায় না! তারা রোগীকে নিয়ে বাইরে চলে যেতো কিন্তু করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসায় অন্য সিসিইউ ভর্তি নিবে না তাই যেতেও পারছেনা। অসংখ্য অভিযোগের আংগুল যথারীতি আছেই- ডাক্তারদের কোন বিবেচনা নাই, কান্ড জ্ঞান নাই, মানবিকতা নাই, দ্বায়িত্ব বোধ নাই ইত্যাদি ইত্যাদি।

আর অন্যদিকে মুমূর্ষু রোগীর স্বজনরাও চিকিৎসা চায়, রোগীকে বাচাতে চায় কিন্তু তারাও কেউ মরতে চায়না, তারা রোগীর সাথে দেখা করতে চায় না, নিজ হাতে রোগীকে খাওয়াতে চায় না, ওষুধ ও খাওয়াতে চায় না কিন্তু রোগীর চিকিৎসা চাই, সুস্থতা চাই, ক্ষুধার্ত দেখতে চাই না। এটা ডাক্তার -নার্স -স্টাফদের দ্বায়িত্ব ।

একদিকে মুমূর্ষু রোগী ও তার স্বজনরা আর অন্য দিকে অন্যান্য রোগী ও তাদের স্বজনরা। আর রোগীদের স্বজনদের হট্টগোল পুরো সময় জুড়েই ছিল। সবাই বাচতে চায় কিন্তু দায়িত্ব বা ঝুঁকি কেউ নিতে চায় না! আমরা স্বাস্থ্যকর্মীরা ভয়াবহ সংকটে।

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত গার্মেন্টস বন্ধ রাখার আহ্বান

Sun Apr 5 , 2020
৫ এপ্রিল, ২০২০: দেশের সব ধরনের পোশাক কারখানা আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ রাখতে মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। কোভিড১৯ এর সংক্রমণ প্রতিরোধে সারাদেশ যখন অবরুদ্ধ, তখন ৫ এপ্রিল থেকে পোশাক কারখানা খোলার কথা শুনে ঢাকায় আসতে শুরু করেন পোশাক শ্রমিকেরা। যান চলাচল বন্ধ থাকায় অনেকেই পায়ে হেঁটেই […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo