সফলতা বলতে আসলে কি বুঝায়? ছোটবেলা পড়তাম আর ভাবতাম, ক্লাশে প্রথম দশজনের মধ্যে থাকায় সফলতা। রেজাল্ট ভাল হবে,আম্মা খুশী হবে, সবাই বলবে ভাল মেয়ে, ব্যস। আমার আম্মারে খুশী করা এত সহজ ব্যাপার ছিল না। আমাদের উঠোন থেকে কান্তাদের দোতলা দেখা যেত। ওদিকে তাকালেই দেখতাম, দোতলার জানালার পাশে পড়ার টেবিলে কান্তা বসে পড়ছে সারাদিন। আমার আম্মাও দিনরাত আমারে কান্তাকে দেখিয়ে খোঁটা দিত, ‘দেখ, কান্তারে দেখে শিখ,কেমন করে অধ্যবসায় করতে হয়’। আমি মনে মনে কান্তার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে পড়ার বইয়ের নীচে অতি যত্নে গল্পের বই সেট করে পড়তে বসতাম। আহারে এই গল্প পড়ার নেশাই আমারে স্কুল লাইফে সফল হতে দিল না। সবাই কেমন ড্রাম বাজাইতো, খেলায় পুরস্কার পাইতো। আর আমি স্কুলে গিয়েও ক্লাশের ফাঁকে, টিফিনের ফাঁকে এমনকি স্পোর্টস ডে তেও বান্ধবীদের সাথে ভাগাভাগি করে বই পড়তাম। মাঝে মাঝে আবার গল্পও লিখে ফেলতাম চুপেচাপে। স্টার মার্কস পেয়ে মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলাম, শেষ রক্ষা হল বলে। কিন্তু সে মুখেও ছাই দিয়ে দিল আমার ইংরেজী স্যার। মান্নান স্যার আমার বাবা-মাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার মেয়ের রেজাল্টে কি তোমরা খুশী? আমি কিন্তু খুশী না। তার কোয়ালিটি অনুযায়ী সে কিছুই করতে পারে নাই’। আমারে এই কথা বোঝানোর জন্য রেজাল্টের পরে আমরা বান্ধবীরা সবাই যখন স্যারের সাথে দেখা করতে গেলাম, স্যার আমার সাথে কথা বললেন না, এমনকি সবাইকে কালোজাম খাওয়ালেও আমাকে দিলেন না। বান্ধবীরা কেউ কেউ দয়াপরবশ হয়ে আমার মুখে মিষ্টি তুলে দিল নিজেদের ভাগ থেকে। আমার সফলতা কালোজামের কালোরঙের নীচেই চাপা পড়ে গেল।
ম্যাট্রিক পাশ করে রাজশাহী চলে গেলাম, রাজশাহী বিভাগের সেরা কলেজে পড়ব বলে। পড়লাম, কিন্তু পড়ার বইয়ের চেয়ে গল্পের বই বেশী। ইন্টার ফাইনালের এক মাস আগে হুঁশ ফিরল। বই নিয়ে বিছানায় বসবাস শুরু করলাম। বিছানার অর্ধেক জুড়ে থাকে বই,বাকি অর্ধেকে কুড়োমুড়ো হয়ে শুয়ে থাকি। যখন ইচ্ছা পড়ি,যখন ইচ্ছা ঘুমাই, দিনরাতের হিসাব রাখি না। রেজাল্ট বেরুল। বেশিরভাগ সাবজেক্টে ৪/৫/৬/৭ এরকম মার্কের জন্য লেটার পাইনি, কেবল ফিজিক্সে লেটার পেয়ে স্টার মার্কস। বান্ধবী আমারে বুক ফুলিয়ে খোঁটা দিয়ে বলল, ‘আমি স্টার না পেলে কি হল,বায়োলজীতে লেটার পেয়েছি। ফিজিক্সে লেটার সবাই পায়,বায়োলজীতে ক’জন পায় লেটার?’ বায়োলজীতে লেটারের থেকে চার মার্ক কম পেয়ে ১৫৬ পাওয়ার দুঃখে আমি মরমে মরে গেলাম।
শুরু হল ভর্তি যুদ্ধ। সে কাহিনী বলতে গেলে দুঃখে বুক ফেটে যায়। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ১২৩তম পজিশনে থেকে ঢাকা মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পাওয়ার পরেও ঘরের খেয়ে পড়ার জন্য রাজশাহী মেডিকেলেই ভর্তি হতে হল। বাপে তখন সরকারী চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে টাকা তোলার জন্য দৌড়াদৌড়ি করছে, আমার দুঃখ দেখার টাইম কই? ঢাকা ডেন্টালে চান্স পাওয়া এক বান্ধবী আমারে দেখে নাক সিঁটকায়ে বলল, ‘এইসব পেরিফেরীর মেডিকেলে পড়ে কোন লাভ আছে? পড়লে পড়তে হবে ঢাকায়।’ আমার সফলতা ঢাকা যেতে না পেরে পারিবারিক সীমাবদ্ধতার নীচে ঢাকা পড়ে গেল।
এমবিবিএস শেষ করে সংসার,বাচ্চা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রইলাম। ২২ তম বিসিএসেই বসতে পারলাম না ঠিকমত, পোষ্ট গ্রাজুয়েশন তো অনেক দূরের কথা। এক বন্ধু বাসায় এসে বলে গেল, ‘নীলাকে তো অনেক ভাল ছাত্রী জানতাম,প্রমাণ তো কিছু পেলাম না’। লজ্জা-অপমান গায়ে মাখতে না চাইলেও ছিটে এসে মনের উপরে পড়ে একটু ফোস্কাও ফেলে দিল। পার্ট ওয়ান পাশ করা বান্ধবীরা গলা ফোলা মোরগের মত সামনে এসে তিরস্কার করে যায়। আমি দাঁতে দাঁত চিপে থেকে আড়ালে গিয়ে কাঁদি।
মাঝে ২৪তম বিসিএসে ১৭ তম স্থানে নিজের নাম দেখে পুলকিত হলাম। কাছের একজন আত্মীয় তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,’এত খুশী হওয়ার কি আছে! মেধা তালিকায় থাকার জন্য তোমার বেতন বেশী হবে নাকি?’ এই একটা ছোট্ট প্রশ্ন আমার আপাতঃ সফলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিল এক নিমেষেই।
তাড়াতাড়ি পোষ্ট গ্রাজুয়েশন শুরু করা গলাফোলা বান্ধবীদের সেকেন্ড পার্ট পরীক্ষা দেয়া শুরু করার বহু পরে আমি কোর্সে আসলাম। দুই বছরের জুনিয়র কলিগ খোঁচা মেরে শুনিয়ে দেয়, তার মত এত কম বয়সে এফসিপিএস কোর্সে আসতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়। আমি সকাল-সন্ধ্যা বাসায় ফেলে আসা দুই বছরের ছেলের জন্য কাঁদি আর পড়ি। ক্লাশে গেলে ঢাকায় ট্রেনিং করা কোর্সমেটরা এমন ভাব দেখায় যেন, এ কোন নর্দমার কীট আমাদের সাথে কোর্সে এসেছে! ক্লাশের এককোণে বসে চুপচাপ ক্লাশ করি। আম্মা সাহস দেন, ‘যে দু’চার দশটা পাশ করে এক চান্সে, তারাও তো তোর মতই রক্ত-মাংসের মানুষ’। আমি বুকে ক্ষীণ আশা বেঁধে কাঁদি আর পড়ি। আল্লাহ্ কারিশমা দেখালেন। পাশ করে গেলাম একচান্সে। এরপর কত জনের কত কথা শুনলাম, একবারে পাশ করে আসার অপরাধে কত কাহিনী ঘটে গেল জীবনে, সে এক ইতিহাস। জুনিয়র কলিগ আমার বান্ধবীর সামনে আফসোস করে বলল, ‘নীলা আপা কি খুবই ভাল ছাত্রী? একবছর আগে আমাদের সমমানের কলিগ ছিল,এখন আবার সিনিয়র কলিগ হয়ে জয়েন করল, কেমন লাগে বলেন?’
পাশ করা নয় বছর পার হয়ে দশ বছর চলছে। প্রফেশনাল জীবনে তেমন কোন উন্নতি করতে পারি নাই, কেবল দু’চারটা অতি ভক্ত রোগী তৈরী করা ছাড়া। আমার অনেক পরে পাশ করে অনেক বান্ধবী,কলিগরা রোগী দেখে শেষ করতে পারছেনা বলে প্রায় আমাকে খোঁটা শুনতে হয়। কেউ কারেন্ট চার্জে এসিষ্ট্যান্ট প্রফেসর হয়ে, কেউ এটাচমেন্ট নিয়ে মেডিকেলে আছে, আমি আট বছর ধরে পেরিফেরীতে পড়ে আছি বলে যত্রতত্র খোঁটা দিতে দিতে মানুষও এখন ক্লান্ত হয়ে গেছে। ছাত্র পড়ানোর আকর্ষনীয় ইচ্ছাটা মনের ভেতরে চেপে রেখে আমি অসফলই রয়ে গেলাম।
সংসারের কথা আর উল্লেখ নাই করি। কারণ, দুপক্ষের মধ্যে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা, যদি প্রশ্ন তুলি, সংসারে অন্যায়ের প্রতিবাদে সফলতা নাকি হজম করাতে? এই একটি জায়গায় অন্যায়ের সংজ্ঞা নিয়েও তুলকালাম বেঁধে যেতে পারে। সংসার আপেক্ষিকতার সূত্র মেনে চলে,তাই সে ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকাই উত্তম বলে মনে করি। তবে আপাতঃ দৃশ্যমান হাসিখুশী সংসারের ছবি দেখে, উক্ত সংসারের প্রকৃত বাস্তবতা অনুমান করা যে আদতে দুস্কর, সেকথা হলফ করে বলতে পারি।
আজকাল টুকটাক লেখালেখি করি। এটাতে দারুণ মজা পেলেও মাঝে মাঝেই রাইটার্স ব্লক হয়। কেউ কেউ হাজার হাজার লাইক পায়,কারো শব্দচয়ন দেখে মুগ্ধ অভিভূত হয়ে বারবার পড়ি। ভাবি, আমি কি করে সফলতা পাব?
সফলতা আসলে কিসে? ভাল রেজাল্ট, ভাল চাকুরী, অনেক ডিগ্রী,অনেক নামযশ, অনেক প্রতিপত্তি, সুখের সংসার, কোনটা সাফল্যের পরিমাপক আজও অজানাই থেকে গেল। উত্তর খোঁজা যখন প্রায় ছেড়েই দিয়েছি তখন হঠাৎ এক গোলটেবিলে একজন স্যার বললেন, ‘যেদিন দেখবে সমসাময়িক কিংবা সমমানের কারো উন্নতি দেখে তুমি বিচলিত হচ্ছো না,সেদিনই বুঝবে তুমি একজন সফল মানুষ’।
আমি তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললাম। বেশ, বুঝলাম, আমি তবে একজন সফল মানুষ। কারো প্রফেশনাল উন্নতি, সে হোক গাণিতিক কিংবা অর্থনৈতিক অথবা দাপ্তরিক, কারো সাংসারিক সুখানুভব হোক তা দৃশ্যায়মান কিংবা অদৃশ্য, কারো ক্রিয়েটিভিটির স্বাক্ষরতা, হোক সে ক্ষণিকের প্রশংসালাভ বা স্বীকৃতি, এসবের কোনটাই আমাকে আর বিচলিত করতে পারেনা। এইরকম বিচলতাকে দুপায়ে মাড়িয়ে পেছনে ফেলে আসতে পেরেছি অনেকদিন আগেই। তাই বোধ হয়, আমিই প্রকৃত সফল একথা বলে কিছুটা পৈশাচিক আনন্দ আমি পেতেই পারি, এটাকে কেউ খোঁটা বা খোঁচা মনে করলে লেখক কিন্তু কোনভাবেই দায়ী থাকিবে না।
ডাঃ ফাহমিদা_নীলা
১২/০৮/২০১৮ইং
ফিচার রাইটার : জামিল সিদ্দিকী
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ