প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৬ মে ২০২০, শনিবার
সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. রাজিবুল বারি
পিএইচডি গবেষক, টোকিও ইউনিভার্সিটি
সাবেক বিভাগীয় প্রধান, রেডিওলজি, শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
গেটস আর জাকারবার্গ যাদের নিয়ে ব্যস্ত তাদের নিয়ে দুকলম লেখার যোগ্যতা বা অধিকার কোনটাই আমার নেই বলেই মনে করি। তবে প্রশংসা নয়, আজ আমার কিছু অভিযোগ আছে। যতবার মেয়েটাকে দেখি ততবারই অসংখ্য ভাবনা আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে আমার ভাবনার এক্সপ্রেসওয়ে পেরিয়ে যায়। অনেকেই “সেঁজুতি মডেল” শব্দটা শুনে আর চেহারাটা মিলিয়ে চট করে বুঝে নেবেন যে এত সুন্দর শাড়ি পড়া মিষ্টি হাসির মেয়েটাকেই হয়ত “সেঁজুতি মডেল” নাম দিয়েছি। কিন্তু আসলে তা নয়। “সেঁজুতি মডেল” একটি প্রোটকলের নাম যেটা কিছু দেশে মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত শিশুর ক্ষেত্রে ফলো করা হয়। ঠিক যেমন করে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর নাম তাদের আবিষ্কারের সাথে জুড়ে দেয়া হয় নামটা স্মরণীয় রাখতে।
এবার অভিযোগের কথায় আসি। সেঁজুতিকে নিয়ে এখন মিডিয়াগুলো তোলপাড়। সম্ভবত বাবা-মেয়ে বেশ ব্যস্ত টেলিভিশনকে সময় দেয়া নিয়ে। আমার মত শত শত মানুষ কী-বোর্ড দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন গর্বের ঠেলায়। আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার, বাংলাদেশের গর্ব, ইত্যাদি নানান বিশেষণ দিয়ে। কিন্তু এই সেঁজুতি যখন নিজেকে গড়েছে তখন আমরা কোথায় ছিলাম? মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে একটা মেয়ের যে যুদ্ধ সেই যুদ্ধের গল্প কি খুব একটা প্রচার হয়? বিদেশে যেতে কত বাঁধা সেটা কোন টিভি চ্যানেলে দেখায়? পড়াশোনা নিয়ে কয়টা অনুষ্ঠান হয়? সরকার কয়টা স্কলারশিপ দিয়ে বিদেশে পাঠায়? সেটা তো পরের কথা, সরকারের কাছে কি তালিকা আছে কোন ছাত্রটা কী পড়ছে? না, নাই। দেশে সরকারী প্রতিষ্ঠানের গবেষণার দুর্নীতি, হালহকিকত নিয়ে কয়দিন রিপোর্ট হয়েছে? একজন আরেকজনকে টেনে ধরার রেওয়াজ নিয়ে কে কবে কথা বলেছে? সচিবালয় থেকে তদবির করে স্বজন আর অদক্ষ লোকদের বিদেশে পাঠিয়ে দেবার রেওয়াজ নিয়ে কয়দিন কাগজে লেখা হয়েছে? উল্টো ডাক্তারদের শিক্ষাছুটি দিতে সরকারের চরম অনীহা দেখা যায়। ডাক্তারদের শিখতেও দেবেনা, আবার ভালো চিকিৎসাও চায়! সরকার জোর করে আইন করেছে যে চাকরির বয়স ২ বছর না হলে শিক্ষাছুটি দেয়া যাবেনা। শুধু তাই নয়, তদবির করেও বেশিরভাগ সময় শিক্ষাছুটি পাওয়া যায়না। একটানা কয়েকশত পরিচিত নাম আমি বলে দিতে পারব যারা অত্যন্ত মেধাবী ছিল, কিন্তু আজ গ্রামে বসে পঁচতেছে। উপজেলা লেভেলে চেয়রাম্যান-মেম্বারের বাসায় গিয়ে বউদের প্রেশার মাপতেছে।
আর বিদেশে পড়তে যাবার কথা অনেকেই চিন্তাও করেনা। সরকারী ডাক্তারদের বহিঃবাংলাদেশ ছুটি যেন সোনার হরিণ। ছুটি শেষ হলে সেটা বাড়ানোর জন্য নেই কোন সহজ প্রক্রিয়া। বেশিরভাগ ছুটি দেয়া হয় বিনা বেতনে। বহু ছুটি বাতিল করে দেবার উদাহরণও আছে। বেসরকারির ছেলেমেয়েদের জন্য নাই কোন ব্যবস্থা। তারা জানেইনা কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় উচ্চতর পড়াশোনা করতে যেতে হয়। যারা চলে গেছে তাদের এদেশে মর্যাদার সাথে ফিরিয়ে এনে ভালো যায়গায় রাখার কোন ব্যবস্থাও নেই। আমি আরও শ খানেক নাম বলতে পারবো যারা এদেশে আর ফিরে আসবেনা। অপরদিকে, পড়াশোনা করতে না পেরে বহু মেধাবী মেয়েরা আজ সংসারের চুলোয় খড়ি ঠেলতেছে। বহু মেধাবী ছেলে ক্লিনিকের ছাদে ঘণ্টা-চুক্তি ডিউটি করছে।
অথচ এই জাপানে আমি দেখেছি প্রতিবছর ইয়াং ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার পথ চেনাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এগজিবিশনের আয়োজন হয়। কলেজ পাশ করার আগেই ব্যাচ ধরে ছেলেমেয়েরা পিকনিকের মত একসাথে এসে দেখে যায় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন, কোথায় কী পড়ায়, কতদিন লাগবে, কত টাকা লাগবে, কত কঠিন, কত মজার। একটা বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, লাইব্রেরী ঘুরতে ঘুরতে মনের মধ্যে স্বপ্ন দানা বাঁধে। উৎসাহ জাগে।
অথচ আমাদের দেশে বিদেশি প্রফেসরের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে বললে সিনিয়রদের ভাব এমন হয় যেন তার জমির ভাগ চাচ্ছি। তার গোপন সম্পদে হাত দিয়েছি। ভাবটা এমন যে আমি কত কষ্ট করে লাইন করেছি, আর তোমাকে সেই লাইন এত সহজে চিনিয়ে দেব? প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে একজন ছাত্রের উপরে যাবার পথ থমকে যায়। প্রতিটা দিন অন্তত একবার করে প্রতিটি ছাত্রের স্বপ্নের মৃত্যু হয়। আমরাই গলাটিপে হত্যা করি ওদের কল্পনাগুলোকে। অথচ কে না জানে, আমার দেশের প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকে একেকটা সেঁজুতি।
আর যখন তারা উঠে দাঁড়ায় তখন নির্লজ্জের মত সরকার বা আমরা দাঁত কেলিয়ে তাদের বলি “আমাদের গর্ব, বাংলাদেশের গর্ব!” প্রয়োজনের সময় কোথায় ছিলো তথাকথিত ‘বাংলাদেশ?’ সেঁজুতিকে নিয়ে গর্ব করার অধিকার একমাত্র তার বাবা-মায়ের। হাজার প্রতিকূলতা, মেয়ের নিরাপত্তা, স্কুল-কলেজের প্রতিযোগিতা, ভিসা, পিএইচডি, ক্যারিয়ার- প্রত্যেকটা পদের কোথায় কী করতে হবে, কোথায় কী বাঁধা, কিভাবে পেরোতে হবে ইত্যাদি বিষয়ের সকল দায়িত্ব তারা পালন করেছেন। কোথাও আর কেউ এগিয়ে আসেনি। কেউ না। কেউই না।
অতএব সরকারের কাছে আবেদন, স্বাস্থ্যখাত আজ তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়েছে। কী অবস্থা সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। শিক্ষাও একটা মৌলিক অধিকার। মৌলিক বুলি নয়। শিক্ষার ভাঙ্গনটা সুনামির মত করে আসেনা। তাই হয়ত করোনার মত প্যান্ডেমিক আকারে টের পাওয়া যায়না। কিন্তু ক্রমশ আমরা ভেঙ্গে পড়ছি। আপনারা কি দেখতে পান? মনে রাখবেন, শুধু দালানের নামকরণ করলেই দালান ইতিহাসে ঠাঁই পায় না। দালানের ভেতরে যারা কাজ করে তাদের যত্ন নিতে হয়। দালানটি যাদের উপর দাঁড়ানো তাদের মেরামত করতে হয়। রাজনীতিকে রাজনীতির যায়গায় রাখেন। বড় বড় ডিজিটাল বুলি নয়, শুভঙ্করের ফাঁকি দেয়া পরিসংখ্যান নয়, লোক দেখানো প্রণোদনা-বৃত্তি ঘরে ঘরে ট্যাবলেট নয়, শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার পথটা সহজ করে দেন। আপনারা রাজনীতিবিদরা নিজেদের সন্তানদের যেমন বিদেশের ভালো স্কুলে পড়িয়েছেন, আমাদের ছেলেমেয়েদের অন্তত দেশে পড়ার পরিবেশ-সুযোগটা করে দেন। গবেষণার বরাদ্দ দেন। বিদেশে যারা যেতে চায় তাদের প্রসেসটা সহজীকরন করুন। বাকিটা পথ তারাই যেতে পারবে। এসব যেদিন বাস্তবায়ন হবে, শুধুমাত্র সেদিনই স্বাধীন বাংলায় সেঁজুতিদের নিয়ে গর্ব করার অধিকার আমরা পাবো।
(প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব)